- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

স্থায়ী জরুরি অবস্থার মধ্যে আটকে আছে তিউনিসিয়া

বিষয়বস্তু: মধ্যপ্রাচ্য ও উ. আ., তিউনিশিয়া, নাগরিক মাধ্যম, নির্বাচন, মানবাধিকার, রাজনীতি, সরকার, কোভিড ১৯

মধ্য তিউনিসের প্রধান চত্বরে এভিনিউ হাবিব বোরগুইবা একটি ঘড়ির স্তম্ভ। ডিসেম্বর ২৬, ২০২২। সাওসেন বেন শেখের ছবি। অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

তিউনিসিয়া আবার ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত [1] জাতীয় জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়েছে। পর্যটনের জন্যে পরিচিত [2] দেশটি ২০১১ সালে তিউনিসীয় বিপ্লবে [3]র পর থেকে প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি কাইস সাইদ গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ভেঙ্গে ফেলায় [4] দুর্ভাগ্যজকভাবে এই ব্যতিক্রমটিকেই স্থায়ী বলে মনে হচ্ছে।

রাজনৈতিক অবরোধ 

আরব বসন্তে [5]র সূতিকাগার তিউনিসিয়া বর্তমানে ১২ বছরে ১০টি ভিন্ন সরকারে [6]র ঘূর্ণায়মান দরজা চিহ্নিত একটি গভীর রাজনৈতিক সংকট নিয়ে লড়ছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুর্দশা এই রাজনৈতিক সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, তীব্র আঞ্চলিক বৈষম্য এবং ব্যাপক দুর্নীতির মতো কিছু ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ উত্তর আফ্রিকার দেশকে জর্জরিত করে রেখেছে। এই অসুবিধাগুলি এমনিতেই ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা [7], কফি, দুধ, রুটি এবং আরো অনেক প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতিতে থাকা তিউনিসীয়দের দৈনন্দিন জীবনকে ক্রমেই কঠিন করে তুলেছে। সামনে সুস্পষ্ট কোন পথ না থাকায় তিউনিসীয়রা পা দিয়ে ভোট দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, ফলে মেধা পাচার [8] হচ্ছে। এই নিম্নগামী সর্পিলতার কারণে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছে। তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসের এক হোটেল পরিচারক কায়েস গ্লোবাল ভয়েসেসকে তিক্তভাবে বলেছেন:

তিউনিসিয়া যেন একটি ডুবন্ত নৌকা। সম্মিলিতভাবে উল্টে যাচ্ছে বলে লোকেরা তাদের ভবিষ্যত সুরক্ষার জন্যে পৃথকভাবে সমাধান খুঁজছে। নৌকার সাথে ডুবে না যাওয়ার জন্যে তারা পালানোর চেষ্টা করছে।

অবৈধ অভিবাসনসহ আরো সমৃদ্ধ উপকূল দিয়ে আইনসম্মত পথের অনুসন্ধান সাধারণ হয়ে ওঠায় তা সব ধরনের ও বয়সের [9] মানুষকে প্রভাবিত করছে৷

দেশকে “আসন্ন বিপদ” থেকে বাঁচাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি সাইদ

তিউনিসীয়রা অনেক আশা নিয়ে ২০১৯ [10] সালে রাষ্ট্রপতি কাইস সাইদকে নির্বাচিত করেছিল। তিনি নিজেকে রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে এবং বিশেষ করে তিউনিসীয়দের খুব ক্লান্ত হয়ে পড়া ইসলামি এন্নাহদা [11]র ঊর্ধ্বে নিজেকে একজন গুণী প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এবং দরিদ্রদের মধ্যে সম্পদ ও ক্ষমতা পুনর্বন্টন করার প্রতিশ্রুতি দেন [12]। ২০২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারী ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তার উপরে আরোহন করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন তিউনিসিয়া “আসন্ন বিপদের [13]” দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

সরকার ও সংসদ ভেঙে দিয়ে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ সাংবিধানিক [14] ক্ষমতা প্রদান করেন। অনেক বিরোধী ও বিশ্লেষক এটিকে “অভ্যুত্থান [15]” হিসেবে দেখলেও অনেক তিউনিসীয় [16] এটিকে শক্তিশালী ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘ ইতিহাসের [17] একটি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখে স্বস্তি পেয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী খাদিজা গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন:

সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে আমরা একটা অচলাবস্থায় আছি। দেশটি শাসনের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল, সার্কাসের মতো এর সংসদে মারামারি এমনকি হামলা ছিল সাধারণ ব্যাপার। কাইস সাইদকে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা সঠিক না হলেও আপাতত এটিই আমাদের দরকার। হতাশার বিষয় হলো আমরা কোন উন্নতি দেখছি না। আসলে প্রতিদিনই জিনিসগুলি আরো ভেঙ্গে পড়ছে।

স্থায়ী জরুরি অবস্থা

তিউনিসিয়ার জরুরি অবস্থার কালানুক্রম। সাওসেন বেন শেখের তথ্যলেখচিত্র

তিউনিসিয়ার বিপ্লবের শুরুতে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে [18] কর্তৃপক্ষ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে [18]। সাধারণ উপায়ে মোকাবেলা সম্ভব নয় এমন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নাগরিক অস্থিরতা, যুদ্ধ বা মহামারীর মতো একটি ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় সাময়িক ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা হিসেবে জরুরি অবস্থা জারি হলেও তা একটি জাতির অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলে দেয় — তিউনিসিয়াতে এটি শাসনের একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এটি নির্বাহীকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করে জরুরি অবস্থাকে চিরস্থায়ী শাসনের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছে।

বর্তমান আকারে খসড়া আইনটি অবিশ্বাস্য রকমের সুদূরপ্রসারী [19]। জরুরি অবস্থার অধীনে বিচারিক কোন পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই নির্বাহীর বিবেচনায় সমাবেশ, নিজেকে প্রকাশ করার বা ভ্রমণের অধিকারের মতো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা স্থগিত করা যেতে পারে। কতোবার জরুরি অবস্থা [20] ঘোষণা বা নবায়ন করা যেতে পারে তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা এবং সময়সীমা নেই। আশ্চর্যজনকভাবে জরুরি অবস্থাটি ২০১১ সাল থেকে প্রতিবারে সাধারণত দুই থেকে তিন মাস হিসেবে ৫১ বার বাড়ানো হয়েছে। তবে ২০২১ সালে কায়েস সাইদ ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অভূতপূর্বভাবে টানা ১১ মাসের জন্যে [21] জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়িয়েছেন, যা এখন পর্যন্ত প্রয়োগ করা দীর্ঘতম সময়। জরুরি অবস্থার আহ্বান বা নবায়ন সিদ্ধান্তটি এখনো প্রতিষ্ঠিত না হওয়া [22] সংসদীয় অনুমোদন বা সাংবিধানিক আদালত থেকে যাচাই-বাছাই ছাড়া শুধু নির্বাহী ক্ষমতার হাতেই থাকে।

২০১১ সালে ঘোষণার [23] পর থেকেই জরুরি অবস্থাটি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রায়শই বিনা কারণে অত্যধিক ও অযৌক্তিক বলপ্রয়োগ [24] করে জনগণের চলাচল সীমিত এবং গৃহবন্দীত্ব আরোপ করার অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা প্রদান করেছে। “নিরাপত্তা বজায় রাখার” অজুহাতে জরুরি অবস্থা বিস্তৃত স্তরের নাগরিকদের [25] বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সক্রিয় কর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভিন্নমতাবলম্বী কণ্ঠস্বরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।

তিউনিসীয় কর্তৃপক্ষের চর্চা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার ঝড় তুলেছে। একটি বিরোধী দল প্রজাতান্ত্রিক গণইউনিয়ন [26] ঘোষণা করেছে:

আমরা জরুরি অবস্থা অব্যাহত রাখার কোনো কারণ দেখি না। আসন্ন বিপদের জন্যে এটি ব্যবহৃত হয়। এটি এমনকি অন্য কোথাও বিদ্যমান সন্ত্রাসবাদের জন্যেও ব্যবহার করা যাবে না কারণ কোনো দেশ এটিকে জনগণের স্বাধীনতা হরণের জন্যে ব্যবহার করেনি… জরুরি অবস্থায় কোনো দায়বদ্ধতা বা তদারকি ছাড়া শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাজনৈতিক সমস্যা নিষ্পত্তি করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

একটি জাতিসংঘ প্রতিবেদনে [27] তিউনিসীয় কর্তৃপক্ষকে “আন্তর্জাতিক আইনে অবমাননাকর ও বেআইনিভাবে – প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক করে তোলার একটি ব্যতিক্রমী আইনী ব্যবস্থা – জরুরি অবস্থার মাধ্যমে পদ্ধতিগতভাবে আইন প্রয়োগকারীকে প্রদত্ত ব্যতিক্রমী ক্ষমতা বিস্তার ঘটানোর চর্চার অবসানের জন্যে অবিলম্বে পদক্ষেপ” নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্লান্তির মধ্যে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে কাইস সাঈদের সাম্প্রতিক ক্ষমতা দখল [14], একটি পুতুল সংসদ গঠন এবং বিচার বিভাগের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া রাজনৈতিক উত্তরণকে বাধা দেওয়ার আরেকটি প্রচেষ্টা মাত্র। সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক হিসেবে রাষ্ট্রপতি হয়ে সাঈদ এখন ব্যাপক নির্বাহী ক্ষমতা আইনকে দিয়েছেন [4]। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জরুরি অবস্থার এই স্বাভাবিককরণ রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র [28] ডয়েচেভেলেকে বলেছেন “কায়েস সাঈদ তিউনিসিয়াকে প্রাক-বিপ্লব যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।”

ভেতরে ভেতরে দুটি বৈরী স্রোত সমান্তরালভাবে চলছিল। মুক্ত সংবাদমাধ্যম, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ২০১৪ সালে একটি নতুন সংবিধানের মতো প্রগতিশীল আদর্শ গ্রহণের পাশপাশি দেশটি জরুরি অবস্থা সম্প্রসারণের মাধ্যমে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে প্রাণবন্ত সুশীল সমাজ ও মুক্ত সংবাদমাধ্যম ভঙ্গুর এবং পশ্চিমা এজেন্ডা ও অর্থায়নের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক গতিপথের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। আরব বসন্তের একমাত্র সাফল্যের গল্প হিসেবে, বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা এটিকে ব্যর্থ দেখতে চান না। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলি তিউনিসিয়াকে গণতান্ত্রিক পথে ফিরে আসার জন্যে আর্থিক প্রণোদনা (যেমন আইএমএফ ঋণ) প্রদান এবং গণতান্ত্রিক পথে ঠেলে দিতে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সহায়তার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক স্খলন ঠেকাতে পারে।

কিন্তু কোন কিছুই নিশ্চিত নয়। প্রধানত ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ তাড়িত পশ্চিমা শক্তিগুলি [29]র কার্যকলাপ শীতল কৌশলগত প্রয়োজনে আরব একনায়কদের স্থান দেওয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে। ইউক্রেনে মহাদেশের নতুন যুদ্ধক্ষেত্রের অগ্রাধিকার ও সংস্থানগুলি ইউরোপে ভেতর ও বাইরে রুশ প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অগ্রাধিকার স্বল্পমেয়াদী স্থিতিশীলতা হলেও এর অর্থ স্বৈরাচারের দিকে চোখ বন্ধ করা হতে পারে।