অনলাইনে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা: ভারতে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের একটি হাতিয়ার

Mapping Online Violence Against Women. Image via Flickr by AltCity Media/Nadine Mouawad from Nasawiya. CC BY-NC-SA 2.0.

নারীর বিরুদ্ধে অনলাইন সহিংসতার মানচিত্রায়ন। নাসাভিয়া থেকে ফ্লিকারের মাধ্যমে অল্টসিটি মিডিয়া/ নেদাইন মুওয়াদের ছবি। সৃজনী সাধারণ অবাণিজ্যিক একইরকম ভাগাভাগির অনুমতি ২.০।

সাংবাদিক ও নারী মানবাধিকার রক্ষাকারীরা বিশ্বব্যাপী অনলাইন লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার (ওজিবিভি) নিয়মিত লক্ষ্যবস্তু। এই পরিবেশে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনাকারী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ বিকাশ লাভ করে। সাংবাদিক রানা আইয়ুবের উদাহরণ ব্যবহার করে এই নিবন্ধটি অন্বেষণ করবে ভারতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কিভাবে লিঙ্গ-ভিত্তিক অনলাইন সহিংসতা ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের জন্যে একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।

ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিক কেন্দ্রের (আইসিএফজে) ১৫টি দেশের (ভারত ছাড়া) উপর পরিচালিত একটি বৈশ্বিক সমীক্ষায় ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা কোনো না কোনো ধরনের অনলাইন লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানিয়েছে। কারো শরীর, মন, আবেগ ও আর্থিক সুস্থতার উপর এই ধরনের সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব নথিভুক্ত করা সমৃদ্ধ সাহিত্য রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে ওজিবিভি এর অভিজ্ঞতা্র ফলে কেউ নীরব এবং আত্মসংযমী হয়ে যেতে পারে। গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিকদের কথা না বলার একটি ‘শিক্ষা’ হিসেবে অ্যাপে নিলামে তোলা বা ট্রলের (পরিকল্পিত উৎপাতের) মাধ্যমে থামিয়ে দেওয়া একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। উপরন্তু, অনলাইন সহিংসতার নেতিবাচক মানসিক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে এবং সাংবাদিকদের কাজকে প্রভাবিত করতে পারে। ইউনেস্কো-আইসিএফজে সমীক্ষায় দেখা গেছে ১১ শতাংশ নারী ওজিবিভি’র নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে কর্মত্যাগ করেছে, ৩৮ শতাংশ “নিজেদের কম দৃশ্যমান করেছে,” ৪ শতাংশ চাকরি ছেড়েছে, এবং ২ শতাংশ সাংবাদিকতা পেশা ছেড়েছে৷ সমীক্ষায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে নারীদের নীরবতা নারীকে গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সাংবাদিকতার প্রতি জনগণের আস্থাকে ক্ষুন্ন করেভারতে লিঙ্গ-ভিত্তিক অনলাইন সহিংসতা: নারীর বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধ এবং সামাজিক গণমাধ্যমে সংখ্যালঘু শীর্ষক ২০২১ সালে প্রকাশিত ভারতে নারীবাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে যে নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইন নির্যাতন ভারতে একটি গুরুতর সমস্যা হলেও নারী ও অন্যান্য ভুক্তভোগীদের এই হুমকি বোঝা এবং কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয় সমর্থনের অভাব রয়েছে।

রানা আইয়ুবের ঘটনা

Rana Ayyub at Times Litfest 2016. Image via Wikimedia Commons by Satdeep Gill. CC BY-SA 4.0.

টাইমস সাহিত্য উৎসব ২০১৬-তে রানা আইয়ুব। উইকিমিডিয়া সাধারণে সতদীপ গিলের ছবি। সৃজনী সাধারণ একইরকম ভাগাভাগির অনুমতি ৪.০

ভারতের একজন স্পষ্টভাষী মুসলমান অনুসন্ধানী সাংবাদিক রানা আইয়ুব প্রায়ই অনলাইন সহিংসতা ও হুমকির লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। অনলাইন লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার উপর গবেষণার ফলাফলের সারসংক্ষেপের একটি মতামত অংশে জুলি পোসেটি ও কালিনা বোনচেভা উল্লেখ করেছে পোস্ট করার “মুহূর্তের মধ্যে” দুর্ব্যবহার পাওয়া রানা আইয়ুব সারা বিশ্বে “সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত সাংবাদিকদের” একজন। তিনি ট্রল, ছবি পরিবর্তন, যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ, মৃত্যু ও শারীরিক সহিংসতার হুমকি, ডক্সিং (অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে কাউকে অনলাইনে অনুসন্ধান) এবং পরিকল্পিত হিংস্রতা্র মতো অনেক ধরনের ওজিবিভি’র অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। লেখকবৃন্দ এই ধরনের লক্ষ্যবস্তু হওয়া কী প্রভাব ফেলতে পারে তা তুলে ধরে বলেছে: “আইয়ুবের মতো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনলাইন সহিংসতা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মধ্যে একটি মিথোজীবী সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে শীতল করে পরেরটির জন্যে আরো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।” লেখকরা উল্লেখ করেছে প্রতিকূল প্রভাব সত্ত্বেও কীভাবে মূল দুটি ক্রীড়নক: সরকার ও মঞ্চ আত্মতুষ্টিতে ভোগে। উপরন্তু, তারা এই ধরনের সহিংসতায় জড়িত ব্যবহারকারীদের কতগুলি সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাকাউন্টকে প্রধানমন্ত্রী মোদী অনুসরণ করেছেন সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

এছাড়াও স্বাধীন জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা সাংবাদিককে লক্ষ্য করে “সংগঠিত অনলাইন গোষ্ঠী”র ব্যাপক দুর্ব্যবহারের নিন্দা করেছে। বিশেষজ্ঞরা আরো উল্লেখ করেছে: “সরকারের নিন্দা ও যথাযথ তদন্তের অভাবের পাশাপাশি মিসেস আইয়ুবের উপর চালানো আইনী হয়রানি আক্রমণ ও আক্রমণকারীদের মিথ্যে বৈধতা দেওয়া ছাড়াও তার নিরাপত্তাকে আরো বিপন্ন করেছে।” এখানে উল্লিখিত আইনি হয়রানিটি এই বছরের শুরুর দিকে অর্থ পাচারের অভিযোগ এবং তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার সাথে সম্পর্কিত। পুরো অগ্নিপরীক্ষাটির জবাবে আইয়ুব টুইটারে বলেন, “আমার কলম কখনোই স্তব্ধ করা যাবে না…”

ভারতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনলাইন লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা

রানা আইয়ুব লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত দেশের অনেক সাংবাদিকদের একজন। ভারতে নারী সাংবাদিকরা নিজেদের ট্রল এবং মৃত্যু ও ধর্ষণের হুমকির শিকার, অ্যাপে নিজেদেরকে আপত্তিকর অবস্থায় এবং পেগাসাসের মতো গোয়েন্দা সরঞ্জামের নজরদারির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত দেখতে পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপের ফলে নারী সাংবাদিকদের উপর নজরদারি করা, তাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা এবং তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেছে ওজিবিভি প্রায়শই অফলাইনের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করে বলে তা বাস্তব জীবনে ফলাফল বয়ে আনে। উপরন্তু গল্পগুলিকে জনগণের কাছে নিয়ে আসার জন্যে সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ বলে এই ব্যবস্থাগুলি তথ্যের উৎসকে সীমিত করে।

নারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হামলা যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক যা তাদের পেশাগত ভূমিকার বাইরে চলে যায়। প্রায়শই নারী সাংবাদিকদের চুপ করার একটি কৌশল এটি। একটি সাক্ষাৎকারে পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক নেহা দীক্ষিত ব্যাখ্যা করেন: “আমি যে গল্পগুলি লিখি তার জন্যে আমাকে অপদস্থ করা হলে সবাই শেষ পর্যন্ত আমাকে ট্রল করা নিয়ে কথা বললেও আমি যে কারণ নিয়ে লিখছিলাম তা নিয়ে বলে না। ফলে ট্রল একাধিক ক্ষেত্রে আমাদের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে।”

উপরন্তু ডিজিটাল নারীবাদী গণমাধ্যম সংস্থা ভারতে নারীবাদের একটি বিশ্লেষণ সাংবাদিকরা কীভাবে প্রায়ই রাজনীতি ও ধর্মের মতো বিষয়গুলির উপর আক্রমণের আকৃষ্ট করে প্রতিবেদন করে তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়াও গবেষণা দেখা যায় সাংবাদিকসহ নারীদের মুখোমুখি হওয়া লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন জাতপাত ও ধর্মের মতো কারণে বহুগুণ বেড়ে যায়। আলজাজিরার প্রতিবেদন অনু্সারে দলিত কর্মী এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী কিরুবা মুনুসামি যুক্তি দেখিয়েছেন, “অনলাইনে দুর্ব্যবহার ও সহিংসতা লিঙ্গভিত্তিক হলে সেটি আরো খারাপ হয় যখন অপব্যবহারকারীরা জানতে পারে ছবি পোস্ট করা ব্যক্তিটি  ‘নিম্ন বর্ণের।’ সংক্ষিপ্ত পোশাকের উপরের মন্তব্যগুলি তখন একটি নিম্নবর্ণের নারীর সেটা পরিধান সম্পর্কে মন্তব্যে পরিণত হয়।” একইভাবে ভারতে অস্বাভাবিক পরিমাণে মুসলমান সাংবাদিকদেরও প্রায়ই ইসলামভীতি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। অনেক বিশিষ্ট মুসলমান সাংবাদিকও নিজেদেরকে ‘বুল্লি বাঈ এবং সুল্লি লেনদেন’ এর মতো অ্যাপে নিলামে দেখতে পেয়েছে

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ

ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি বিশৃঙ্খল কিন্তু মিথোজীবী সম্পর্কের সাথে যুক্ত। নারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক অনলাইন নির্যাতন দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ বিকাশের একটি পরিপক্ক পরিবেশ তৈরি করে যা আবার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দমন করতে ব্যবহৃত হয়। বৈশ্বিক গণমাধ্যম পর্যবেক্ষক সীমান্তবিহীন প্রতিবেদক (আরএসএফ) ঘোষিত বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২২-এ ভারত ২০২১ সালে ১৪২ থেকে ১৫০-এ নেমে এসেছে

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .