- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

মেটার সালিশি বোর্ড ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের অস্বচ্ছ বিষয়বস্তু নির্দেশনা নিয়ে লড়াই করছে

বিষয়বস্তু: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নজরদারী, নাগরিক মাধ্যম, প্রযুক্তি, মানবাধিকার, সেন্সরশিপ, জিভি এডভোকেসী

ছবির সৌজন্যে জিওভানা ফ্লেক

সামাজিক গণমাধ্যম সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে মানবাধিকার রক্ষাকারীদের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবন রজ্জু হতে পারে। অনলাইন মঞ্চগুলির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা মূলধারার গণমাধ্যমের এড়িয়ে যাওয়া বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পারে এবং এমনকি যুদ্ধাপরাধের মূল্যবান সাক্ষ্য প্রদান করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে পারে [1]

সাম্প্রতিক মাসগুলিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক (উভয়ই মেটার মালিকানাধীন) ব্যবহারকারীরা মেটার অ্যালগরিদম এবং অস্বচ্ছ বিষয়বস্তু নির্দেশনার ইচ্ছেধীন হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করেছে। ফলে, মেটার “সালিশি বোর্ড” (মেটা প্রতিষ্ঠিত একটি আবেদন পদ্ধতি যারা মনে করে যে তাদের বিষয়বস্তু ভুলভাবে সরানো হয়েছে) মেটার মূল সিদ্ধান্তগুলিকে শুধু বিপরীত করেনি বরং প্রযুক্তি দৈত্যটিকে আরো ভালভাবে ব্যবহারকারীদের অধিকারের সুরক্ষা দিতে সক্ষম করতে নীতি নির্দেশনা জারি করেছে।

উদাহরণস্বরূপ বোর্ডটি সম্প্রতি নাইজেরিয়া [2]য় সন্ত্রাসী হামলার রক্তাক্ত পরিণতি দেখানো একটি ইনস্টাগ্রাম ভিডিও মুছে ফেলার মেটার সিদ্ধান্তকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তীব্র, জান্তব সহিংসতার ভিডিও নিষিদ্ধ এবং মানুষের যন্ত্রণাকে চিত্রিত করার চিত্রের প্রতি ধর্ষকামী মন্তব্য সম্বলিত বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ করা মেটার নীতির কারণে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বোর্ডের অধিকাংশের মতে  ভিডিওটির সাথে থাকা ক্যাপশন বা হ্যাশট্যাগগুলির কোনোটিই অন্যের দুঃখকষ্টে থেকে আনন্দ জানানো বা আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে করা না হলেও তা সরানো হয়েছে। বরং, পোস্টারগুলি তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। নাইজেরিয়ার সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার কভারেজ দমিয়ে রাখার চেষ্টার সত্যতা বোর্ডের ব্যবহারকারীদের বাকস্বাধীনতা বজায় রাখার সিদ্ধান্তের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণভাবে বোর্ড উল্লেখ করেছে যে “ধর্ষকামী” শব্দটি সম্পর্কে মেটার উপলব্ধি সর্বজনীনভাবে প্রকাশ করা হয়নি এবং প্রযুক্তি দৈত্যের সঞ্চালকদের দেওয়া অভ্যন্তরীণ নির্দেশিকা খুব বেশি বিস্তারিত ছিল।

তাত্ত্বিকভাবে “হিংসাত্মক ও জান্তব বিষয়বস্তু নীতি [3]” ব্যবহারকারীদের “মানবাধিকার লঙ্ঘন, সশস্ত্র সংঘাত বা সন্ত্রাসবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়” সম্পর্কে নিন্দা ও সচেতনতা বাড়াতে দিলেও বোর্ড উল্লেখ করেছে: “হিংসাত্মক ও জান্তব বিষয়বস্তু নীতিটি স্পষ্ট করে না মেটা কিভাবে সচেতনতা বাড়াতে বা নথির অপব্যবহারের জন্যে ব্যবহারকারীদের জান্তব বিষয়বস্তু ভাগাভাগি করার অনুমতি দেয়।”

এবারই প্রথম বোর্ড এই ধরনের উদ্বেগ উত্থাপন করেছে তা নয়। এই সিদ্ধান্তের আগে মেটা বেসামরিক সরকারকে সরিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সুদানের সামরিক বাহিনীর অপমানজনক প্রতিক্রিয়া নথিভুক্ত করা [4] একটি ভিডিও মুছে ফেলে। কোম্পানিটি তখন জনস্বার্থে বিষয়বস্তুকে দৃশ্যমান রাখার অনুমতি দেওয়া একটি “সংবাদযোগ্যতা” ব্যতিক্রমের অধীনে তার সিদ্ধান্তটি ফিরিয়ে দেয়। বোর্ড মেটার এই উল্টো-হাঁটা অনুমোদন করলেও সংবাদযোগ্যতা নীতি “সংবাদযোগ্য” শব্দটির স্পষ্ট সংজ্ঞার অভাবে কখন ব্যবহারকারীদেরকে অনুমোদন থেকে উপকৃত “স্বেচ্ছাচারী” ও “অসামঞ্জস্যপূর্ণ” নৃশংসতার নথিভুক্ত বিষয়বস্তুর ঝুঁকিতে ফেলবে সেটা স্পষ্ট করেনি বলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তদুপরি ২০২২ সালের মার্চের ১২ মাস আগে মেটা তার হিংসাত্মক বিষয়বস্তু নীতির অধীনে শুধু ১৭টি “সংবাদযোগ্যতা” ছাড় জারি করেছিল। মেটা ২০২১ সালের প্রথম তিন ত্রৈমাসিকে এই সম্প্রদায়গত মানদণ্ডের অধীনে কোন ছাড় না দিয়ে জনস্বার্থের হতে পারে এমন স্পষ্ট উদ্বেগ থাকা ৯ কোটি ৭ লক্ষ বিষয়বস্তু সরিয়ে দেয়।

বোর্ডের সমালোচনার আরেকটি লক্ষ্য হলো বিপজ্জনক ব্যক্তি ও সংস্থা [5]র প্রশংসা নিষিদ্ধ করা মেটার নীতি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বোর্ড নিরপেক্ষ আলোচনা, নিন্দা ও সংবাদ প্রতিবেদনের জন্যে ব্যতিক্রম সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের বোঝার জন্যে মেটা বিস্তারিত মানদণ্ড ও দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণের সুপারিশ করেছে [6]। বোর্ড বলেছে যে এমনকি “প্রশংসা” শব্দটিকেও সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। মেটার অভ্যন্তরীণ নির্দেশনা পর্যালোচকদের “বক্তার অভিপ্রায় সম্পর্কে ‘প্রশংসা'র অর্থ কমানোর বদলে শ্রোতাদের প্রভাবিত করে [7]” একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী “সম্পর্কে জনগণকে আরো ইতিবাচক চিন্তা্ করালে” প্রশংসার বিষয়বস্তু সরানোর নির্দেশ দেয়। আর তাই ব্যবহারকারীরা স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করছে [8] বা এমনকি নীতির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত একটি সংস্থার উল্লেখ করায় তাদের তালেবানে [7]র কার্যকলাপ সম্পর্কে নিরপেক্ষভাবে জানানো পোস্টগুলিও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেটা তার বিপজ্জনক সংস্থার তালিকা জনসাধারণের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে বলে এটি আরো বেড়েছে।

এসব উদ্বেগ নতুন কিছু নয়। একটি ব্যাপক বিশ্লেষণে [9] বেসরকারি সংস্থা ধারা১৯ উল্লেখ করেছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রভাবশালী সামাজিক গণমাধ্যম দৈত্য – ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার এবং গুগলের পরিষেবার শর্তাবলীতে স্বচ্ছতার অভাব এবং বাক স্বাধীনতার নিম্নমান চিহ্নিত হয়।

বিষয়বস্তু সঞ্চালনার দলগুলিকে শক্তিশালী করার জন্যে মেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইতোমধ্যে কোম্পানির নিয়ম লঙ্ঘনের জন্যে মানব পর্যালোচকদের চিহ্নিত ছবিগুলিকে সনাক্ত করে সরিয়ে দেয়ার “গণমাধ্যম সাদৃশ্য পরিষেবা ভাণ্ডার” এর একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রাথমিকভাবে মেটাকে দ্রুত গতিতে অনেক পরিমাণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করার জন্যে পরিকল্পনা করা হয়েছে যা এই ধরনের ব্যবস্থাগুলিতে মানবিক ত্রুটিজনিত সিদ্ধান্তের প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলেছে।

একটি ঘটনায় কলম্বীয় পুলিশের সমালোচনা [10] করে একটি কার্টুন পোস্ট করা একজন ব্যবহারকারীর মন্তব্য সমস্যাযুক্ত হিসেবে একজন মানব পর্যালোচকের চিহ্নিত একটি চিত্রের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলে যাওয়ার পরে তাদের মন্তব্য সরিয়ে দেওয়া হয়। বোর্ডের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় কর্মীদের বা কর্মের সমালোচনা করা কার্টুনের স্পষ্ট লক্ষ্যের প্রেক্ষিতে ফেসবুকের এটিকে ভাণ্ডারে যুক্ত করাটাই প্রথম ভুল ছিল। মেটার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আরো শত শত ব্যবহারকারীর একই কার্টুন করেছিলেন সরিয়ে দেওয়া উদ্বেগটিকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এই অপসারণের বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীদের মধ্যেকার ২১৫ জন আবেদন করে ৯৮% সফলতা লাভ করা সত্ত্বেও গণমাধ্যম ভাণ্ডার থেকে কার্টুনটি সরাতে মেটা দেরী করে।

বিপরীতভাবে ইথিওপিয়া [11] সম্পর্কিত একটি সিদ্ধান্তে বোর্ড জাতিগত উত্তেজনা ও সশস্ত্র সংঘাতকে উৎসাহ দেওয়া বিষয়বস্তুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে খুব ধীর হওয়ার জন্যে মেটার সমালোচনা করে। বোর্ডের মতে: “মেটার ব্যবস্থাগুলি একটি সংঘাত এবং সমস্ত সশস্ত্র সংঘাতের সময় বিশ্বস্তভাবে সমানুপাতিক কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্যে আরো স্বচ্ছতা দরকার।” রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সময় মেটাকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে দেখা গে্লেও ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারের মতো অন্যান্য সংঘাত-পীড়িত অঞ্চলে খুবই ধীর গতির ছিল। ইথিওপিয়ার সিদ্ধান্ত চলমান সশস্ত্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বক্তব্য নজরদারিতে কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি করে। একজন শিক্ষাবিদের করা একটি প্রকাশ্য মন্তব্য অনুসারে, “ইথিওপীয় সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত না থাকাটাই সমস্যা ছিল।” মাতৃভাষায় কথা বলা সঞ্চালকের অভাবের কারণে আফ্রো-এশীয় টাইগ্রেয়দের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার বিষয়বস্তু “বিচ্যুতি” ঘটেছিল। এর একটি উদাহরণ হলো আমহারা অঞ্চলের টাইগ্রেয়দের সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো একটি ফেসবুক পোস্ট মঞ্চে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ছিল। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ব্যুরোর একটি প্রতিবেদনে [12]র উদ্ধৃতি দিয়ে মন্তব্যকারী উল্লেখ করেছেন ঘৃণামূলক অনলাইন প্রচারণাগুলি গন্ডার শহরে বসবাসকারী টাইগ্রেয়দের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারকে প্ররোচিত করেছে।

মেটা তার মঞ্চগুলিতে নিয়ন্ত্রিত বিষয়বস্তুর মোট পরিমাণের প্রেক্ষিতে – ২০২২ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে হিংসাত্মক ও জান্তব বিবেচিত ২ কোটি ৩২ লক্ষ পোস্টের বিরুদ্ধে “ব্যবস্থা গ্রহণ” করায় – এটি অনিবার্য যে সংস্থাটি ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং এবং ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম যেন অবৈধ বিষয়বস্তুর অভয়াশ্রম হয়ে না ওঠার মধ্যেকার সূক্ষ্ম রেখাটি অনুসরণ করবে। অনলাইন বিষয়বস্তু সরবরাহকারীদের ভুল তথ্য ও ঘৃণাত্মক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার বৈশ্বিক প্রচেষ্টা [13] শুধু এই প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত ঝুঁকিগুলিকে বাড়িয়ে তুলবে। বোর্ডের নীতি সুপারিশগুলি ভারসাম্য ঠিক রাখা সম্পর্কে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দান করলেও সেখানে একটি ধর্তব্য রয়েছে:

নামানুসারে সুপারিশগুলি শুধুই উপদেশমূলক। মেটা (৬০ দিনে [14]র মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও) সেগুলি বাস্তবায়নে বাধ্য নয় । মানবাধিকার রক্ষাকারীদের জন্যে একটি নিরাপদ স্থান হিসেবে থাকতে হলে মেটাকে সালিশি বোর্ডের সাথে ঐকান্তিক ও সরল বিশ্বাসে জড়িত থাকতে হবে।