ইউক্রেনীয় দ্বন্দ্ব ও চীন-মার্কিন উত্তেজনার মধ্যে সূক্ষ্ম পূর্ব-পশ্চিম ভারসাম্য বজায় রেখেছে লাতিন আমেরিকা

এরিক রেটানার অলংকরণ

কানেক্টাস সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য লিওনার্দো অলিভার লেখা এই নিবন্ধটি একটি গণমাধ্যম অংশীদারিত্বের অধীনে গ্লোবাল ভয়েসসে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান তিনটি “অজানা উড়ন্ত বস্তু” (ইউএফও) গুলি করে ভূপাতিত করার পর থেকে মার্কিন ফুটবল সুপার বোল উন্মাদনায় ভেসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইউএফও শব্দটি টুইটারে চাউর হয়। এই অদ্ভুত ইউএফওগুলি পৃথিবীকে জয় করতে আসা আগন্তুকদের সম্পর্কে ষড়যন্ত্র এবং অতিপ্রাকৃত তত্ত্বের জন্ম দিলেও হোয়াইট হাউসের সংবাদ সচিব কারিন জাঁ-পিয়েরকে স্পষ্ট করতে হয় সনাক্ত এই বস্তুগুলিতে “আগন্তুক বা বহির্জাগতিক কার্যকলাপের কোন অস্তিত্ব নেই।”

মার্কিন ভূখণ্ডের অনেক উপর দিয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ১৮ হাজার মিটার উড়ে যাওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্র চীনা ৬০ মিটার বেলুনটি গুলি করার পরে এই রহস্যময় পর্বগুলি সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি বেইজিংয়ের প্রতি ওয়াশিংটনের ক্ষোভের জন্ম দেয়। বেলুনগুলির ব্যবহারকে গুপ্তচরবৃত্তি কর্মসূচির অংশ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বছরে দশবারের বেশি বেলুন দিয়ে তার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে একটি কূটনৈতিক উত্তেজনাকে উস্কে দিয়ে গত দশকে দুই শক্তির মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি করেছে বলে চীন দাবি করে।

চীন-মার্কিন উত্তেজনাটি শুরু হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ইউরোপকে যুদ্ধে এবং বিশ্বকে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া ইউক্রেন-রুশ যুদ্ধের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে।

ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে বোমা বিস্ফোরণ অব্যাহত থাকলেও এবং যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি “ঠান্ডা যুদ্ধ” পরিস্থিতির মধ্যে, লাতিন আমেরিকা দূর থেকে এই সশস্ত্র, কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সংঘর্ষগুলি দেখছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার দূরত্বে থেকে সংঘাতকে দেখতে থাকা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে তাদের “নিরপেক্ষতা” পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন

“আমরা লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের সমস্ত নেতাদের এই তথাকথিত নিরপেক্ষতাকে ঝেড়ে ফেলে ইতিহাসের সঠিক দিকে যাওয়ার আহ্বান জানাই,” ইউক্রেনের রাজধানী থেকে এই অঞ্চলের সাংবাদিকদের সাথে একটি ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেছেন।

লাতিন আমেরিকার নেতৃবৃন্দের অবস্থান

১১ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার বৈঠকে এই দূরত্ব বা বরং অস্পষ্ট অবস্থানটি স্পষ্ট হয়। সেখানে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে একত্রিত করার জন্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে যোগ দিতে রাজি হওয়া তো দূরে থাক ব্রাজিলের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নিজেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেকার সংঘাত সমাধানের জন্যে ভারত ও চীনের মতো দেশগুলিকে যুক্ত করে একটি “শান্তি ক্লাব”-এর নেতা হিসেবে প্রস্তাব করেন।

দুই সপ্তাহ আগে লুলা ইউক্রেনে গোলাবারুদ পাঠানোর জন্যে ব্রাজিলে সরকারি সফরে থাকা জর্মন প্রধানমন্ত্রী ওলাফ শোলজের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। “রুশদের উস্কানি দিতে” না চাওয়ার কথা বলে তিনি জানান যে “রাশিয়া অন্য দেশের ভূখণ্ডে আক্রমণ করে একটি বড় ভুল করেছে। কিন্তু আমি মনে করি কেউ [আলোচনা] করতে না চাইলে , আমরা কেউই [কথা] বলতে পারি না।”

এক বছর আগে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে বেশিরভাগ লাতিন আমেরিকার দেশগুলির অবস্থানের সাথে লুলার হস্তক্ষেপ না করা মিলে গেছে। নিকারাগুয়া, কিউবা এবং ভেনিজুয়েলার পাশাপাশি এবং বলিভিয়াও আক্রমণটিকে কিছুটা ছাড় দিলেও বাকি সরকারগুলি যতটা সম্ভব দূরে থাকতে পছন্দ করেছে। তারা মস্কোর বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয়নি বা ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্রও পাঠায়নি। “এটা কিছুটা আফ্রিকার মতো একই লাইনের,” এমনি বিশ্লেষণ ইউক্রেনের কিছু লড়াই কভার পূর্ব-ইউরোপ বিশেষজ্ঞ আর্জেন্টিনীয় সাংবাদিক ইগনাসিও হুতিনের।

লাতিন আমেরিকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্য যে কেউ, সেটা বিবেচ্য নয়। কারো সাথে ঝগড়া করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ভ্যানি পেতিনা তার অংশের জন্যে একমত যে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে লাতিন আমেরিকায় একটি “নিশ্চিত শীতলতা” রয়েছে। এবং রাশিয়াকে উত্তর আমেরিকার আধিপত্যের ভারসাম্য হিসেবে বিবেচনা করে তিনি এটির একটি ঐতিহাসিক দিক ব্যাখ্যা করেছেন। মেক্সিকো কলেজের ঐতিহাসিক পাঠের গবেষক পেতিনা নিশ্চিত করেছেন:

মার্কিন হস্তক্ষেপের উপস্থিতিতে এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হলেও অন্য কোনো শক্তি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সময় হয় না।

রাশিয়া ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার লাতিন আমেরিকায় কিছুটা উপস্থিতি বজায় রেখেছিল, যাকে অনেকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে দেখলেও অন্যরা তা এড়িয়ে গেছে। মস্কোতে চিলির প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত পাবলো ক্যাব্রেরা বলেছেন: ” কিছু দেশে সামরিক সরবরাহ বিক্রির বাইরে রাশিয়ার খুব একটা প্রভাব রয়েছে, আমি কখনোই মনে করিনি। সম্ভবত স্নায়ুযুদ্ধের সময় বরং আরো বেশি প্রভাব থাকলেও কিউবা এবং ভেনেজুয়েলায় এর আপেক্ষিক সম্পৃক্ততা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে সেটা শেষ হয়ে যায়।” অন্যদিকে হুতিন এই অঞ্চলে রাশিয়ার উপস্থিতিকে মূল্য দিলেও ইউক্রেন আক্রমণের পরে কূটনৈতিক স্তরে এর প্রভাব হারানোর কথা স্বীকার করেন। তিনি রো বলেন:

কিন্তু বাণিজ্যিক ভাষায় আমি বলবো যে লাতিন আমেরিকা রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। মস্কো ব্রাজিলের কাছে যে সার বিক্রি করে তা বেশ বিখ্যাত এবং তারা ব্রাজিলের কাছে বিক্রি বন্ধ করবে না।

পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি বিধান

লাতিন আমেরিকা কোনো শক্তিকে বিচ্ছিন্ন না করার কঠিন রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে বলে মনে হলেও ক্ষণস্থায়ী মনে হওয়া এক বছর পর যুদ্ধটি (স্থান ও) কালের সাথে ছড়িয়ে পড়ার হুমকি দিচ্ছে বলে কলম্বিয়ার মতো বিভিন্ন দেশের উপর দিয়েও উড়ে যাওয়া রহস্যময় চীনা বেলুনগুলির দিকে বিশ্ব নজর দিয়েছে।

লাতিন আমেরিকার সরকারগুলি কি কোন পক্ষাবলম্বন না করে পূর্ব ইউরোপে বোমা হামলার সমস্যার ক্ষেত্রে তারা যেমন করেছে  তেমনিভাবে ক্ষমতার মধ্যে এই দ্বন্দ্বগুলিকে দূর থেকে দেখা অব্যহত রাখতে পারে? “প্রত্যেকের স্বার্থেই অন্তত রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সময়ের ক্রমবর্ধমান উন্মুক্ত শত্রুতার মতো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দশকব্যাপী প্রতিযোগিতাটি উচ্চকিত হবে না,” পেতিনা জবাব দেন।

স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ কমিয়ে দেশগুলিকে কারো না কারো পক্ষে নিজেদের সারিবদ্ধ করতে বাধ্য করা ব্লকভিত্তিক বৈশ্বিক বিভাজনে প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যপটটি ঐতিহাসিকভাবে আর লাতিন আমেরিকার পক্ষে যায় না।

প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ক্যাব্রেরা মনে করেন যে রুশ আগ্রাসনের মুখে লাতিন আমেরিকার “আদর্শগত বিভাজন এই ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” এবং ” ঐতিহ্য অনুসারে, যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা মেনে চলার ক্ষেত্রে এটির একটি সাধারণ অবস্থান থাকা উচিত ছিল।” ক্যাব্রেরা বাজি ধরে বলেন ২০২৩ সালে এই অঞ্চলটি একটি সংঘাতের সম্ভাব্য সম্প্রসারণের মুখে এই মনোভাবটি গ্রহণ করবে, যা খুব একটা দূরবর্তী নয়।

হুতিনের অনুমান অনুযায়ী ইতোমধ্যে আক্রমণের প্রথম বার্ষিকীতে “সম্ভবত আগামী সপ্তাহগুলিতে রুশ সৈন্যদের একটি বড় সামরিক বৃদ্ধি ঘটবে,” শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যার তাৎক্ষণিক ও দ্ব্যর্থহীন নিন্দা করেছে৷ চীন প্রাথমিকভাবে দূরে থাকলেও মার্কিন আকাশের উপর দিয়ে গোয়েন্দা (বেইজিংয়ের মতে আবহাওয়াগত প্রকৃতির) বেলুন পাঠিয়ে, তাইওয়ানে হুমকিমূলক সামরিক মহড়া প্রদর্শন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জয়হীন বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে ক্রমেই মস্কোর কাছাকাছি অবস্থান করছে।

পণ্ডিত এনরিক গোমারিজ মোরাগা যেমন লিখেছেন, একটি দ্বিমেরু বিশ্বের দিকে বৈশ্বিক রূপান্তরের লক্ষণ রয়েছে। তার ভাষায়, কর্তৃত্ববাদ ভিত্তিক একটি নতুন ইউরেশীয় ক্ষমতা কেন্দ্র আটলান্টিক জোট এবং পাশ্চাত্য-ঘরাণার গণতন্ত্র কেন্দ্রিক পুরানোটিকে স্থানচ্যুত করতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে লাতিন আমেরিকার সরকারগুলিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা নতুন শীতল যুদ্ধের হাওয়ায় ভেসে বিপদসঙ্কূল অস্পষ্টতার কঠিন পথে হাঁটবে কিনা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .