- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

অবিস্মরণীয়: ক্রোয়েশিয়া এবং স্লোভেনিয়ায় ‘মহান কৃষক বিদ্রোহের’ ৪৫০ তম বার্ষিকী

বিষয়বস্তু: পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ, ক্রোয়েশিয়া, ইতিহাস, চলচ্চিত্র, নাগরিক মাধ্যম, যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ, শিল্প ও সংস্কৃতি, দ্যা ব্রিজ (সেতুবন্ধন)
[1]

ওতন আইভেকোভিচের আঁকা জাগ্রেবের সেন্ট মার্কস চার্চের সামনে ১৫৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে মাতিয়া গুবেকের মৃত্যুদণ্ডের একটি উপস্থাপনা। উইকিপিডিয়ার প্রকাশ্য ডোমেইনের ছবি [2]

ঠিক ৪৫০ বছর আগে মহান ক্রোয়েশীয়-স্লোভ কৃষক বিদ্রোহ [3] শেষ হয়। ১৫৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সেই সময়ে হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যে [4]র অংশ ক্রোয়েশিয়া রাজ্যের রাজধানী জাগরেবের প্রধান চত্বরে বিদ্রোহের নেতা মাতিয়া গুবেকে [5]র মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল।

সামন্ততন্ত্রের অবসান এবং অযৌক্তিক কর আরোপ ও নারী নির্যাতনসহ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অবসানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সমতা এই অভ্যূত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল। নিষ্ঠুর ব্যারন ফেরেঙ্ক তাহি [6]সহ স্থানীয় অভিজাতদের নিপীড়ন আর সহ্য করতে অনিচ্ছুক, ক্রোয়েশীয় জাগোর্জে [7] অঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এবং স্লোভেনিয়ার কিছু অংশ সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি ভ্রাতৃত্ব গঠন করে। তারা সম্রাটে [8]র অধীনস্তদের থেকে সুরক্ষার দাবিতে তার কাছে পৌঁছানোর ব্যর্থ চেষ্টাও করে। বিদ্রোহীরা দাসত্ব বিলুপ্ত করে সম্প্রসারণশীল ওসমানীয় তুর্কিদের [9] বিরুদ্ধে আগে থেকেই প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন হিসেবে কাজ করা সত্ত্বেও তাদের সীমান্তরক্ষী [10] মর্যাদা দেওয়ার অনুরোধ করে।

একটি লাল মোরগের পতাকা উড্ডীন করা ভ্রাতৃত্বটি দ্রুত সমন্বয়ের উপায় না পেয়ে আগে থেকেই প্রথম তুষারপাতের সময় আক্রমণ করতে সম্মত হয়। বিস্মিত আভিজাতদের বিরুদ্ধে কিছু প্রাথমিক সাফল্যের পরে মাত্র ১২ দিনের মধ্যে তাদের দুর্বল সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী স্তুবিকার যুদ্ধে গুঁড়িয়ে যায়। মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের প্রথম দিকের অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ [11] পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের মতো রক্তাক্ত প্রতিশোধ নেওয়া হয়।

বিদ্রোহটি স্বল্পস্থায়ী হলেও এটা এই অঞ্চলের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, একটি লালিত ঐতিহ্য ছিল এবং এখনো আছে। ১৯৭৫ যুগোস্লাভ/ক্রোয়েশীয় ঐতিহাসিক নাটকীয় সিনেমা “খ্রিস্টাব্দ ১৫৭৩ [12]” এই ঘটনাবলীর একটি চমৎকার শৈল্পিক চিত্র প্রদান করে। ভাত্রোস্লাভ মিমিকা [13] পরিচালিত সিনেমাটি সমগ্র যুগোস্লাভিয়ার বাছাই করা শিল্পীরা অভিনয় করে এবং ১৯৭৬ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনীসহ আন্তর্জাতিক সমালোচকদের প্রশংসা পায় [14]

১৯৮০’র দশকে সারা যুগোস্লাভিয়ায় সরকারি টিভিতে এই ধরনের ঘরোয়া ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রগুলি প্রায়ই পুনঃপ্রচার করা হতো। ছোটবেলায় এটা দেখার কথা মনে থাকলেও আমার মধ্যে ব্রুগেলের [15] চিত্রকর্মের মতো এর দৃশ্যগুলির অস্পষ্ট ছাপ ছিল। আমি অনলাইনে বেশ কয়েকটি কপি পাওয়া যায় দেখে আমি একজন প্রাপ্তবয়স্কের চোখ দিয়ে এটি আবার দেখতে পারার জন্যে আনন্দিত হয়েছিলাম। কেউ বলতে পারেন এই সিনেমাটি যথেষ্ট পুরনো এবং ইউটিউবে ইংরেজি সাবটাইটেলসহ এর একটি সংস্করণ পাওয়া চলচ্চিত্র এবং ইতিহাস প্রেমীদের বিশ্ব সম্প্রদায়ের উভয়ের জন্যেই সুসংবাদ বটে।

পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে ১৫৭৩ সালের কৃষক বিদ্রোহটি বলকান এবং তার  বাইরে এখনো ভালোর জন্যে পরিবর্তনের আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে এবং অসংখ্য স্বাধীনতামূলক কর্মকাণ্ডকে অনুপ্রাণিত করেছে।

গত ১৫ বছর [16] ধরে ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেবের কাছে প্রতি বছর বিদ্রোহের চূড়ান্ত প্রদর্শনী – স্তুবিকা যুদ্ধের একটি পুনরাভিনয় [17] অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবছর এটি হয়েছে ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে।

১৫৭৩ সালের শীতের অস্থির ঘটনাবলী কেন্দ্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র যুগোস্লাভিয়া [18]র সমস্ত স্কুল শিক্ষার্থীদের পাঠ্য ১৮৭৭ সালের উপন্যাস সেলজাকা বুনা (“কৃষক বিদ্রোহ”) এর শীর্ষস্থানীয় ক্রোয়েশীয় লেখক অগাস্ত সেনোয়া [19] এবং পেট্রিকা কেরেম্পুহর গীতিনাট্যে [20]র (১৯৩৫) মাধ্যমে পরাজিত কৃষকদের মর্মবেদনাকে অমর করে রাখা মিরোস্লাভ ক্রিলেখা [21]র মতো অসংখ্য শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

যুগোস্লাভ নেতা জোসিপ ব্রোজ টিটোর পড়ার ঘরের শোভা বর্ধন করা [22], প্রায়শই বিভিন্ন প্রকাশনায় উল্লেখিত এবং ১৯৭৩ সালের ডাক টিকেটকে অলঙ্কৃত করা স্তুবিকার যুদ্ধের একটি প্রতিভূ চিত্র [23] এঁকেছিলেন বিখ্যাত ক্রোয়েশীয় চিত্রশিল্পী ক্রিস্তো হেগেদুসিচ [24]

[25]

১৯৭৩ সালের যুগোস্লাভ ডাক টিকেটে ক্রিস্তো হেগেদুসিচের আঁকা স্তুবিকার যুদ্ধ চিত্রকর্মের একটি অংশ দেখানো হয়েছে। উইকিপিডিয়ার প্রকাশ্য ডোমেনের ছবি [26]

ওতন ইভেকোভিচে [27]র (১৯১২) আরেকটি প্রতিভূ চিত্রকর্মে “রাজত্ব” নিয়ে ব্যঙ্গস্বরূপ মাথায় লাল টকটকে-গরম লোহার “মুকুট” পরিয়ে হত্যা করা বিদ্রোহী নেতা মাতিয়া গুবেকের নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড দেখানো হয়েছে।

গুবেক নিজেই তার জন্মস্থান জাগোর্জে [28] এবং এর বাইরেও স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে [29]র সময় (১৯৩৬-১৯৩৯) প্রজাতন্ত্রের সেনাবাহিনীতে ক্রোয়েশিয়ার কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন স্বেচ্ছাসেবকরা গুবেকের নামে একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের বেঁচে থাকা যোদ্ধারা যুগোস্লাভ পার্টিজান [30] বা জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মূল গঠন করে, যার মধ্যে মাতিয়া গুবেকের নামে একটি করে ক্রোয়েশিয়া [31] এবং স্লোভেনিয়া [32]য় মোট দুটি ব্রিগেড ছিল।

কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে একটি সাম্প্রতিক শিল্পকর্ম হলো ক্রোয়েশীয় শিল্পী এবং সম্পাদকীয় কার্টুনিস্ট নিক টাইটানিকে [33]র একটি গ্রাফিক উপন্যাস, যিনি পুনরাভিনয়ে তার অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাও ভাগাভাগি করেছেন।

প্লেগ শুরু হওয়ার ঠিক দুই বছর আগে আমি পাহাড় এবং ন্যায়বিচারের জন্যে (ঠিকভাবে এবং মদের উপর কম করের জন্যে) মহান কৃষক বিদ্রোহের চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশ নিয়ে সম্মানজনকভাবে মৃত্যুবরণ করার সম্মান পেয়েছি। প্রায় একই সময়ে আমি আমার প্রথম গ্রাফিক উপন্যাস “১৫৭৩” প্রকাশ করি।

ইতিহাসগ্রন্থগুলিতে উল্লেখ করা হলেও সমসাময়িক জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে কৃষক বা জনপ্রিয় বিদ্রোহগুলি খুব বেশি মনোযোগ পায়নি। এমনকি ইতিহাসপ্রেমীদেরও, বিশেষ করে উচ্চ শ্রেণী পরিচালিত যুদ্ধের সিনেমার তুলনায় এই ধরনের ঘটনা নিয়ে অনেক বড় চলচ্চিত্রের কথা মনে করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ ইংরেজ সমাজকে ক্রুসেডের মতো বা তারও বেশি প্রভাবিত করার মতো ওয়াট টাইলারের বিদ্রোহ নামেও পরিচিত ১৩৮১ সালের মহাবিদ্রোহে [37]র অস্তিত্ব কিন্তু জনসাধারণের জ্ঞানের অনেক বাইরে।

চিরায়ত রোমান্টিসিস্ট ওয়াল্টার স্কটে [38]র উপন্যাস এবং অর্ধ-মধ্যযুগীয় মহাকাব্যের ফ্যান্টাসি গল্প থেকে শুরু করে নানা উপজাত নিয়ে টলকিয়েনের লর্ড অফ দ্য রিংসের মতো উভয় রোমান্টিক ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য সাধারণত সামাজিক স্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে না এবং কৃষকদের গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে। বিজ্ঞানী এবং লেখক ডেভিড ব্রিন টলকিয়েন এবং আধুনিকতা সম্পর্কে তার ২০০২ সালের মূল প্রবন্ধে সেগুলি সাধারণত অভিজাত বা “নির্বাচিত ব্যক্তিদের” দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা [39]র কথা উল্লেখ করেছেন।

একটি সাম্প্রতিক ব্যতিক্রম হলো নেটফ্লিক্সের ডাইনী: রক্তের উৎসে [40]র গল্পরেখায় থাকা দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ। তবে সামগ্রিক আখ্যানটি কয়েকটি “উচ্চতর” প্রাণীর এবং তাদের উত্তরসূরীদের শোষণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেও মিছিলের গান “কালো গোলাপে [41]” জড়িত আবেগের কিছু উপলব্ধি প্রদান করলেও এই বিদ্রোহটিকে বেশ ম্লান ও সাধারণভাবে প্রায় একটি পাদটীকার মতো করে দেখানো হয়েছে।

আর তাই আপনি কৃষক বিদ্রোহের বিষয়ে আগ্রহী হলে আমি আপনাকে নেটফ্লিক্সের ধারাবাহিকের তুলনায় অনেক কম উন্নত প্রযুক্তিতে হলেও তার চেয়ে অনেক বেশি হৃদয় দিয়ে তৈরি করা “১৫৭৩” চলচ্চিত্রটি দেখার অনুরোধ করবো।

আর সিনেমা প্রেমীদের জন্যে আরেকটি মজার তথ্য হলো: ১৯৭৫ সালে কিশোর বয়সে “খ্রিস্টাব্দ ১৫৭৩” (তার পিতার পরিচালিত) চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্র কৃষক “পিটার”-এর ভূমিকায় অভিনয় করা সার্জিও মিমিকা-গেজান [42] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়ে স্টিভেন স্পিলবার্গে [43]র সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ব্যাটলস্টার গ্যালাকটিকা, হিরোস, রাইজড বাই উলভস এবং দ্য পিলারস অফ দ্য আর্থ-এ কাজ করে তিনি এখন টাইম টিভি ধারাবাহিকের একজন বড় পরিচালক।