যুব বেকারত্ব ভারতের জন্যে আসল চ্যালেঞ্জ

ভারতীয় রুপির (আইএনআর) একটি ঘনিষ্ট ছবি। পেক্সেলের সৌজন্যে। মুক্ত ব্যবহারের জন্যে

ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। ২০২৮ সালের মধ্যে জাপান ও জার্মানিকে ছাড়িয়ে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এছাড়াও ভারতে ৪৭.৬৬ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বে চীনের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমশক্তি রয়েছে। সকল ইতিবাচক লক্ষণ সত্ত্বেও ভবিষ্যতের জন্যে বেশ কয়েকটি জাজ্জ্বল্যমান জটিলতা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির মধ্যেও এটি কর্মীবাহিনীতে প্রবেশ করছে বা করতে প্রস্তুত লক্ষ লক্ষ নতুন কর্মীকে ঠিকঠাক জায়গা দিতে পারছে না। ১০০ জনের মধ্যে ৪২ জনের বেশি যুবকর্মী তাদের পছন্দসই কাজের ক্ষেত্রে চাকরি খুঁজে পায় না। অর্থাৎ প্রায় ৭ কোটি ৩০ লক্ষ বেকার যুবক এবং বর্তমানে এক লক্ষ নতুন কর্মী চাকরির জন্যে অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে। এটা আমাদের নাকের নীচে থাকা বিপর্যয়কে প্রকাশ করে।

প্রতিটি অর্থনীতিতে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক দু’টি কর্মসংস্থানের খাত রয়েছে। প্রথমটি হলো কর্মসংস্থানের সুস্পষ্ট শর্তবিশিষ্ট সরকারি তত্ত্বাবধানাধীন বেশিরভাগ দাপ্তরিক কাজ, কারখানার কাজ বা আমলাতান্ত্রিক পদের মতো কর্মসংস্থান। নামের মতোই পরবর্তীটি কাজের কম নিরাপত্তা প্রদান করে, প্রান্তিক মজুরিতে কর্মীদের নিয়োগ করে এবং সরকার এর তদারকি করে না। অনানুষ্ঠানিক চাকরির কিছু উদাহরণ হতে পারে খাবারের হকার, মৌসুমী কৃষি কর্মী বা ফ্রিল্যান্স মেরামতকারী ব্যক্তি। ২০১৬ সালে ভারতীয় নোটের বিমুদ্রাকরণ, কোভিড-১৯ মহামারী এবং শ্রমের কৃষি থেকে পরিষেবা খাতে স্থানান্তরের ব্যর্থতা এই বিপর্যয়ের কারণ। বিমুদ্রাকরণ সমগ্র মধ্য-নিম্নবিত্ত জনসংখ্যাকে স্থবির করে দেয়। ২০১৬ সালে ৬০ কোটিরও বেশি ভারতীয়র কোন ব্যাংক হিসেব ছিল না বলে নোট জব্দের সরকারি আদেশের পরে অনানুষ্ঠানিক কর্মীদের পারিশ্রমিক দেওয়ার কোনও উপায় ছিল না। কোভিড-১৯ সৃষ্ট নিছক অস্থিরতাকে অতিরঞ্জিত না করেও বলা যায় মহামারীটি ২০২০ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক কর্মীদের ঋণগ্রস্ত হতে বাধ্য করে

বিমুদ্রাকরণ এবং কোভিড-১৯ এর প্রভাব

২০১৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার প্রচারণার অংশ হিসেবে ২০২২ সালের মধ্যে যুবকদের জন্যে ১০ কোটি নতুন চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন। এখানে আমরা ২০২৩ সালে থাকলেও মোদি অর্থনীতিতে কতগুলি চাকরি যোগ করেছেন তারুণ্যের কথা মনে না রাখায় তা এখনো বোধহয় নির্ধারণ করা হয়নি। ২০১৬ সালে বেকারত্ব সৃষ্টিকারী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে একটি হলো বিমুদ্রাকরণ। ২০১৬ সালের8 নভেম্বরে ৫০০ রুপি (প্রায় ৬৪৩ টাকা) এবং ১,০০০ রুপি (প্রায় ১২৮৫ টাকা) নোট নিষিদ্ধ করে মোদি সরকার নগদ প্রবাহের ৮৬ শতাংশ মুদ্রা অবৈধ ঘোষণা করে।

এই নীতিতে প্রধান একটি অবদান রেখেছে অবৈধভাবে কালোবাজারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির কালো অর্থনীতি যা ভারতের ২০১৬ সালের স্থূল জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ। এই বাজারের অর্থ হলো ভারত সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর রাজস্ব এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারাচ্ছে। বিমুদ্রাকরণ নীতি সফলভাবে সেই সমস্যাটির মোকাবেলা করলেও কয়েক কোটি নাগরিককে আর্থিকভাবে পঙ্গু করেছে। নীতিগত পদক্ষেপটির ফলে পরবর্তী দুই ত্রৈমাসিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। এটি অনানুষ্ঠানিক খাতকেও উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত করে। খোলা বাজারে নোটগুলি ক্রয় ক্ষমতা হারনোর ফলে নিয়োগকর্তারা তাদের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেননি। আগে থেকেই ক্রমহ্রাসমান শ্রমশক্তিকে কমিয়ে দিয়ে অনেক কর্মচারীকে চলৎশক্তিহীন করে যুব বেকারত্বের হারকে বিমুদ্রাকরণ দুই বছরে ০.৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে দেয়। তবে এটি ২০১৯ সালে প্রায় ০.৩ শতাংশ পুনরুদ্ধার করলেও কোভিড-১৯ এর দুর্ভাগ্যজনক অনুপ্রবেশে জাতীয় অর্থনীতি ধ্বসে পড়ে।

কোভিড প্রায় ১৮ মাস ধরে বিশ্বের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্যকে অস্থির করে দেয়। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত, ভারতের জিডিপি ২৪.৪ শতাংশ সংকুচিত হয়, যা ২০২০/২১ অর্থবছরের সামগ্রিক জিডিপি সংকোচন ৭.৩ শতাংশ রেকর্ড করেছে। এটা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ আর্থিক বছর। মহামারীটি ২৫ মার্চ, ২০২০ তারিখ থেকে ৬৮ দিনের জন্যে সমগ্র দেশ এবং এর ১৩০ কোটি নাগরিককে আটকে দেয়। এটি শ্রম শিল্পকে যতোটা মারাত্মকভাবে না পঙ্গু করে তার চেয়েও বেশি আর্থিক সংস্থান বাঁচানোর জন্যে অনেক ব্যবসা তাদের কর্মচারীদের ছাঁটাই করে। লকডাউন শিক্ষা খাতকেও স্থবির করে দেয়। ঐতিহ্যগতভাবে পরিবারগুলি কম্পিউটার, ট্যাবলেট ইত্যাদির মতো দৈনন্দিন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে না বলে শিক্ষার্থীরা তাদের ফোনের মাধ্যমে ক্লাস করতে বাধ্য হয়। ফলে নতুন স্নাতক শিক্ষার্থীর দল আগের নতুন কর্মীদের মতো দক্ষ বা প্রশিক্ষিত হয়নি।

হারিয়ে যাচ্ছে নারী শ্রমশক্তি

নারী শ্রমের কর্মসংস্থানও ইতিহাসের নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২১ সালে ভারতীয় নারী কর্মসংস্থান নারী জনসংখ্যার ১৯ শতাংশে নেমে আসে, যা পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের তুলনায় কম। বিশাল যুব জনসংখ্যা সত্ত্বেও ভারতে যুবকরা শ্রমশক্তির সর্বনিম্ন অংশ – মাত্র ১৯ শতাংশ – যেখানে যুবতী নারীরা শ্রমশক্তির মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থনীতিও চাকরির বাজারে প্রবেশকারী নতুন কর্মীদের চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৯ সালে এক লক্ষেরও বেশি তরুণ দক্ষিণ এশীয় দৈনিক চাকরির বাজারে প্রবেশ করলেও তাদের প্রায় অর্ধেক চাকরি খুঁজে পায়নি, যা ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে স্পষ্টভাবে ব্যাপক দুর্বলতা প্রদর্শন করে।

কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা

আরেকটি অবদানকারী নিয়ামক হলো ভারতে চাকরির বন্টন। ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে প্রায় ৪৩ শতাংশ চাকরি কৃষি খাতে, ২৫ শতাংশ শিল্প খাতে এবং ৩২ শতাংশ পরিষেবা খাতে। ৪৩ শতাংশের কৃষি কর্মসংস্থানের অংশ বিশ্বের গড় ২৭ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বিপরীতে, সেবা খাতের কর্মসংস্থানের অংশ ৩২ শতাংশ বিশ্বের গড় ৫১ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। পরিশেষে, বিশ্বগড় ২৩ শতাংশের তুলনায় শিল্প খাতে ২৫ শতাংশ কর্মসংস্থান রয়েছে।

বিমুদ্রাকরণ এবং কোভিড-১৯ এর গুরুতর পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিসংখ্যানগুলি নতুন চাকরি প্রদান এবং বর্তমান কর্মসংস্থানের হার বজায় রাখার জন্যে কৃষি খাতের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা দেখায়। কৃষি খাতের ৪৬.৫ কোটি শ্রমিকের মধ্যে ৯১ শতাংশের কাছাকাছি অনানুষ্ঠানিক শ্রমিক। কাজের নিরাপত্তা, নিয়মিত মজুরি এবং সরকারি তদারকির অভাবের কারণে এই শ্রমিকরা প্রায়শই তাদের পরিবারের ভরণপোষণ দিতে পারে না এবং চাকরির খোঁজে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। আনুষ্ঠানিক খাতের চাকরিগুলি অনানুষ্ঠানিক খাতের চাকরির চেয়ে বেশি কাঙ্খিত, এবং কেন: সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকরির নিরাপত্তা, নিয়মিত বেতন এবং সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার কারণে তা বোঝা সহজ।

২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি বিহার রাজ্যে রেলের ৩৫,০০০ করণিক পদের জন্যে আবেদন পদ্ধতিতে “অনিয়ম” নিয়ে যথেষ্ট বিক্ষোভ হয়। ৩৫,০০০টি শূন্যপদের জন্যে ১ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি আবেদনকারী থাকায় অতিরিক্ত বেশি আবেদনকারীর কারণে রেল মন্ত্রণালয় আবেদনকারীদের প্রাথমিক যোগ্যতা উচ্চ বিদ্যালয় পাশ থেকে আরো ভাল যোগ্যতাসহ দরখাস্তের মানদণ্ড উত্থাপন করে। সঙ্গত কারণে বিহারে বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হলে একটি পরিত্যক্ত রেলের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়

পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজন এখন

“এই প্রবৃদ্ধির অনেকটাই হলো বেকার বৃদ্ধি,” ভারতের রেকর্ডভাঙ্গা প্রবৃদ্ধির বিষয়ে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন৷ এটি নিখুঁতভাবে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সম্পদ – কর্মসংস্থানযোগ্য তরুণদের – পুঁজি করতে না পারা উন্নয়নশীল ভারতীয় অর্থনীতিকে বর্ণনা করে। ২০৩০ এর দশকে এই জনসংখ্যা বয়স্ক হয়ে যাবে বলে সরকারের যুবকদের আরো কর্মসংস্থান দিয়ে এখনই তার অর্থনীতি সংশোধন করার সুযোগ। এছাড়াও আরো বেশ কিছু সমাধান আছে।

কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুমুখীকরণ জরুরি। ভারত তার শিক্ষিত কর্মীদের চাকরি দেওয়ার জন্যে এবং পেশা ও শিক্ষার স্তরের মধ্যে দক্ষতার ব্যবধান কমাতে কৃষির উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। শিল্প ও সেবা খাতের প্রতি দৃষ্টান্ত সরাতে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকা এবং খাতগুলো বেগবান করতে সম্পূর্ণ ব্যাপক সরকারি সহায়তায় আরো বেশি কর্মীকে উৎসাহিত করা দরকার। সরকারকে প্রাথমিক স্তরে উদ্যোক্তাদের সমর্থন ও উৎসাহ দিতে হবে। ফলে ছোট ছোট ব্যবসাগুলি খুব বেশি ঋণগ্রস্ত হওয়ার ভয় ছাড়াই বৃহৎ পরিসরে চাকরি তৈরি করতে পারে। পরবর্তী সংস্কার হলো নারীর কম কর্মসংস্থান মাত্র ১৯ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করা। নারীর কর্মসংস্থান নিষিদ্ধ ও সীমাবদ্ধকারী আইন প্রত্যাহার করে সরকারের উচিৎ স্বনির্ভর গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা এবং চীনের মতো নারী-কেন্দ্রিক কর্মসূচি চালু করা। এই সমাধানগুলি স্বল্পমেয়াদে দ্রুত এবং কার্যকর হয় কিনা তা এখনো দেখা বাকি হলেও চাকরির অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে না পারলে ভারতের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .