
২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে কিয়েভের বেবিন ইয়ার হলোকাস্ট স্মৃতিস্তম্ভে জেলেনস্কি
২৭ জানুয়ারি তারিখে আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট স্মরণ দিবস উপলক্ষে, ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর গায়কদল স্মৃতিসৌধে পরিণত ইউরোপের বৃহত্তম হলোকাস্ট গণহত্যার স্থানে ইউক্রেনীয় সৈনিকদের হিব্রু গান পরিবেশন করার একটি ইউটিউব ভিডিও প্রকাশ করেছে। ভিডিওটিতে এক মুহুর্তের জন্যে ক্যামেরাটি বিভিন্ন প্রতীকের একটি জটিল মিশ্রণ পরিবেশকের একটি চিহ্ন – ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতীক একটি ত্রিশূলের পাশে ক্রিমীয় তাতারদের শৌর্যের প্রতীক তামগার উপর ফোকাস করে। এই ভিডিওটি তৈরি হয়েছে মস্কোর ইউক্রেনকে “নাজিমুক্ত” করার প্রেক্ষাপটে আক্রমণের দাবির বিপরীতে। হলোকাস্ট হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি পার্টির পরিচালনায় জার্মান নাৎসি সামরিক বাহিনী কর্তৃক ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের উপর চালানো গণহত্যা।
ভিডিওটির প্রতীকটিতে একাধিক স্তর রয়েছে: “সিজারিয়া (একটি ফিলিস্তিনি/ইসরায়েলি শহর) ভ্রমণ” (১৯৪২) গানটি লিখেছেন বুদাপেস্টে নাৎসি প্রতিরোধে কর্মরত ২৩ বছর বয়সে ১৯৪৪ সালে বন্দী ও নিহত হাঙ্গেরীয়-ইসরায়েলি কবি হান্না সানাস (সেনেশ)। ইসরায়েলে প্রতি বছর জাতীয় হলোকাস্ট স্মরণ দিবসে পরিবেশিত গানটি ভিডিও ক্লিপটির প্রস্তুতকারকদের বার্তা আন্তর্জাতিক শ্রোতাদের শোনানোর উদ্দেশ্যকে ইঙ্গিত করে।
ভিডিওটি কিয়েভে গণহত্যার একটি কুখ্যাত অকুস্থল বেবিন ইয়ারে চিত্রায়িত হয়েছে। এখানে নাৎসিরা সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী ও ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের সাথে কিয়েভের হাজার হাজার ইহুদি এবং (দক্ষিণ ভারতীয়) রোমাদের খুন করে গিরিখাতে ফেলে রাখলেও প্রায়শই নাৎসি সহযোগী কিয়েভবাসীদেরকেও হলোকাস্টের অপরাধী বলে অভিযুক্ত করা হয়। বেবিন ইয়ারের ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে নিজস্ব দুটি স্মরণ দিবস রয়েছে যেদিনগুলিতে স্থানীয় নাগরিকরা এই স্থানে নাৎসিদের হাতে নিহত প্রায় ৩৩,৭৭০ জন ইহুদিদের জন্যে শোক প্রকাশ করে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে, এই দিনটিকে চিহ্নিত করা এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে ইউক্রেনের ইহুদি সম্প্রদায়ের ইতিহাস বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীগুলি অতীত সন্ত্রাসের তুলনায় বরং বর্তমান যুদ্ধে তাদের দুঃখকে একত্রে মোকাবেলা করছে বলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও বৈরিতাগুলি একপাশে রেখে দেওয়া হয়েছে।
জেলেনস্কি: শক্তিশালী প্রতীকবাদের সন্ধানে
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণের তারিখ থেকে কিয়েভ রুশ প্রচারণা মোকাবেলা করার উপায় খুঁজ্ছে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় কৌশলের অন্যতম হলো তার ভূখণ্ডে সংঘটিত বিভিন্ন গণহত্যাকে তুলে ধরা। এর মধ্যে ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে স্তালিনের তৈরি হলোডোমোর হলোকস্ট হিসেবে পরিচিত দুর্ভিক্ষ এবং বর্তমান রুশ যুদ্ধ ও দখল মিলে ইউক্রেনে এখন পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি বেসামরিক প্রাণ হারিয়েছে বলে মনে করা হয়।
আজকাল প্রতিটি ইউক্রেনীয় কর্মী নাৎসি-নেতৃত্বাধীন ইহুদিদের নির্মূলের সাথে সমান্তরালভাবে ২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ নৃশংসতার কথা উল্লেখ করে।
🕯️Today the world is honors the memory of the Holocaust victims. Their tragedy should have served as a warning to prevent new crimes against humanity. But today, in the very center of Europe, a genocide of Ukrainians is occuring.
We will neither forgive nor forget anything.
— Andriy Yermak (@AndriyYermak) January 27, 2023
🕯️আজ বিশ্ব হলোকস্টের শিকারদের স্মৃতিকে সম্মান করছে। তাদের বিয়োগান্তক ঘটনা মানবতার বিরুদ্ধে নতুন অপরাধ প্রতিরোধে সতর্কতা হিসেবে কাজ করা উচিত ছিল। কিন্তু আজ, ইউরোপের একেবারে কেন্দ্রে, ইউক্রেনীয়দের গণহত্যা ঘটছে।
আমরা কিছুই ক্ষমা করবো না বা ভুলবোও না।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হলোকস্টকে চরম অসংবেদনশীল এবং হলোকস্ট অস্বীকারের সমান নিকৃষ্ট অন্যকিছুর সাথে তুলনা করা প্রায় অকল্পনীয়। রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আক্রমণের প্রথম মাসে ইসরায়েলি সংসদে জুম বক্তৃতা দেওয়ার পরে বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরা ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির বিরুদ্ধে ঠিক এই অভিযোগ করে।
কিন্তু জেলেনস্কি নিজেই সরাসরি নাৎসিদের ভোগান্তির শিকার একটি ইহুদি পরিবার থেকে আসায় তার ব্যক্তিগত ইতিহাস তাকে এই সমান্তরাল টানার বৈধতা দেয় বলে তিনি মনে করতে পারেন।
তবে জেলেনস্কি তুলনা শুরু করেননি, এমনকি তিনি তার ইহুদি উৎসের উপরও জোর দেননি। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার অব্যবহিত পরে কিয়েভ নেতৃত্ব পালাবে না এবং এর জনগণ যে যুদ্ধ করবে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইহুদি গণমাধ্যমের জন্যে একটি আইকন হয়ে ওঠেন। এখন তারা তাকে নাৎসিসহ নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইহুদিদের প্রতিরোধ ইতিহাসের একটি উদাহরণ “আধুনিক ম্যাকাবি” বলে ডাকে।
ইউক্রেনীয় ইহুদি ইতিহাস বৈষম্য ও নিপীড়নের সাথে জড়িত বলে ২০২২ সালে, বিশ্বব্যাপী অনেক ইহুদি গর্বের সাথে তাদের ইউক্রেনীয় শিকড় পুনরাবিষ্কার করেছে এবং রাশিয়ায় তাদের মুখোমুখি হওয়া নিপীড়নের পারিবারিক গল্প ভাগাভাগি করেছে।
যুদ্ধের সময় কি সত্যিই ইতিহাস পুনর্বিবেচনার সময়?
উদ্ধৃত সমান্তরালটি ইউক্রেনীয় সমাজের বিভিন্ন অংশ ও প্রজন্মের মধ্যে বিবাদের উৎস হিসেবে বিদ্যমান ইহুদি-ইউক্রেনীয় সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সত্য হলো দেশটি এখনো তার ২০ শতকের ইতিহাস ইহুদি বিরোধী পোগ্রোম, নাৎসি-যুগের নিপীড়ন এবং সোভিয়েতপুষ্ট ইহুদি বিদ্বেষের পরস্পরবিরোধী আখ্যানগুলির মধ্যে মিটমাট করতে পারেনি।
বিশেষ করে রুশ এবং সোভিয়েত উপনিবেশবাদের বিরোধিতার জন্যে আজ মূলধারার আলোচনায় ইউক্রেনীয় দেশপ্রেমের বীর বিবেচিত বোহদান খমেলনিৎস্কি, সাইমন পেৎলিউরা বা স্তেপান বান্দেরার মতো কিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বহির্বিশ্বের কাছে সাধারণত ইহুদিদের বড় গণহত্যার সাথে জড়িত এবং তারা ইহুদি সম্মিলিত স্মৃতিতে গভীর চিহ্ন রেখে গেছে।
অস্বাভাবিকভাবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সাথে তাদের সমান্তরালে জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত ইহুদিদের “আপনি” বললেও কখনো “আমরা” হিসেবে উল্লেখ করে না। উদাহরণস্বরূপ নেসেটে হলোকস্ট ও ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের কথা উল্লেখ করে জেলেনস্কি তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, “এই সমান্তরাল এবং এই তুলনা করার অধিকার আমার আছে।” তিনি এমনভাবে আরো বলেন: “আমাদের ইতিহাস এবং আপনার ইতিহাস। আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,” যেন ইহুদিরা কখনোই স্থানীয় সমাজের অংশ ছিল না।
১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে বিদেশী অর্থায়নের কারণে দেশে ইহুদি অধ্যয়ন এবং হলোকস্ট গবেষণা, শিক্ষা এবং স্মরণ ফুলেফেঁপে ওঠার বিপরীতে স্থানীয় তৃণমূল উদ্যোগ এবং ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি প্রকৃত সহানুভূতি ও আগ্রহ অবদমিত হয়েছে।
তবে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে রাশিয়াই (আন্তর্জাতিকভাবে,প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রায়শই শুধু “রাশিয়া” হিসেবে উল্লেখ করা হয়) যুক্ত থাকলেও এখনো ইউক্রেনীয়দের ব্যাপকভাবে নাৎসি দোসর হিসেবে দেখা হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের আলোচনায় গণমাধ্যম ও পাঠে ব্যাপকভাবে “ইউক্রেনীয় দোসর” অভিব্যক্তিটি ব্যবহৃত হয়, যা বিশ্বযুদ্ধের সময় সকল ইউক্রেনীয়দের দোসর থাকার ধারণাটিকেই শক্তিশালী করে। ইউক্রেনের তার সোভিয়েত অতীতকে প্রত্যাখ্যান করা এবং রাশিয়ার ইউক্রেনীয় বিরোধী ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ছড়িয়ে দেওয়ার কার্যক্রম এই অবস্থার জন্যে ব্যাপকভাবে দায়ী। আধুনিক ইউক্রেনে রেড আর্মি যোদ্ধাদের মধ্যে কয়েক হাজার ইউক্রেনীয় থাকা সত্ত্বেও তাদের দখলদার বিবেচনা করা হয়।
গণমাধ্যমের আলোচনায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা অ্যান্ড্রি ইয়ারমাকের টুইটার পোস্টে হলোকস্ট এবং ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের মধ্যে সমান্তরাল টানা ব্যবহারকারীদের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে, যেমন:
We also remember the genocide of hundreds of thousands of Syrians just a few short years ago
— Free Syria Media Hub (@Free_Media_Hub) January 27, 2023
আমরা মাত্র কয়েক বছর আগে লক্ষ লক্ষ সিরীয় গণহত্যার কথাও স্মরণ করি
আরেকজন লিখেছেন:
It's just so bad to draw parallells from the Holocaust to the war in Ukraine.
— Anna Tema (@Anatema0) January 27, 2023
হলোকস্টের সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের তুলনা করা খুবই খারাপ।
স্তেপান বান্দেরা এবং ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের সংগঠনের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠন পর্যালোচনা ও পুনর্মূল্যায়নের চেষ্টা হলেও ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আক্রমণের পাশাপাশি রাশিয়ার ইউক্রেনীয় সমাজকে অবিরাম বিভ্রান্তিকর আক্রমণ বিষয়টিকে অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক এবং কারো কারো কাছে বিষাক্ত করে তুলেছে এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে দেশপ্রেম ও জাতীয় ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণার জরুরি প্রয়োজনীয়তা।
আজকের বাস্তবতা হলো ইউক্রেন এখন ইউরোপের সবচেয়ে কম ইহুদি-বিদ্বেষী দেশের মধ্যে অন্যতম।