গেল জানুয়ারি ছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের মানুষের কাছে ‘ভয়ংকর’ একটি মাস। এ মাসে মোট ৯ দিন ঢাকার বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল — গত ৭ বছরে সর্বোচ্চ। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচকে স্কোর ৫০ বা তার নিচে থাকলে বায়ুর মান ভালো বসে ধরা হয়। স্কোর যতো বাড়ে, বায়ুর মান ততো খারাপ বলে গণ্য করা হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর। আর ৩০১-এর বেশি হলে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা বলে ধরা হয় যা সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে এবং সংবেদনশীল মানুষদের জন্যে মাঝারি থেকে গুরুতর শ্বাসকষ্ট তৈরি করতে পারে।
বায়ু দূষণ ঢাকায় একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা যা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে এই মারাত্মক দূষিত বায়ু নিয়মিতভাবে গ্রহণের ফলে ঢাকাবাসীর গড় আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে!
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে জানুয়ারি মাস খারাপ বায়ু প্রবাহের মাস হিসেবে পরিচিত। ঠান্ডা আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে এ সময় বায়ুদূষণ আরো বেড়ে যায়। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র। তাদের হিসেবে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বায়ুদূষণে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ দিনের সংখ্যা ছিল ৫। ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত পাঁচ বছরে এমন দিনের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪,৪,৪,৭ ও ১।
ঢাকার বাতাস ‘দুর্যোগপূর্ণ’ হওয়ার কারণ কি?
ঢাকায় যে পরিমাণ বায়ু দূষণ হয় তার অধিকাংশের পেছনে রয়েছে মূলতঃ তিনটি উৎস – ঐতিহ্যবাহী ইটের ভাটা, শীতের মৌসুমে বাতাসে ভেসে বেরানো ধূলিকণা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া।
বৃহত্তর ঢাকার আশে পাশে এক হাজারেরও বেশি ঐতিহ্যবাহী ইটের ভাটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বায়ু দূষণ সৃষ্টি করে। এর সাথে নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, ইটভাটা, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়ি, মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো—মূলত এসব মিলে ঢাকা শহরের বাতাস বিপজ্জনক করে তুলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্র বায়ুদূষণে কার কেমন ভূমিকা তার একটি হিসাব দিয়েছে। তাদের হিসেবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের দূষিত বায়ু। দূষণের আরও উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈববস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা।
শীত মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় নির্মাণ কাজের পরিমাণ বাড়ে। ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি বেড়ে যাওয়ায় এবং যত্রতত্র খোলা মাটি ও নির্মাণ বর্জ্য ফেলে রাখায় বায়ুতে ধুলো কণা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও যত্রতত্র আবর্জনা পোড়ানো বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে বলে ইউনিসেফ বাংলাদেশ টুইট করেছে:
The burning of garbage in the Buriganga area of #Dhaka is a significant contributor to hazardous levels of air pollution.
Our future.
Our responsibility.#COP25 #ClimateAction© UNICEF/Khan pic.twitter.com/qR3uA4KMDx
— UNICEF Bangladesh (@UNICEFBD) December 13, 2019
ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে আবর্জনা পোড়ানো বায়ুদূষণ বিপজ্জনক হওয়ার পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
আমাদের ভবিষ্যৎ
আমাদের দায়িত্ব
ঢাকার যেসব জায়গায় বড় বড় নির্মাণ কাজ চলছে, সারাদিনই যানজট লেগে থাকে, সেসব স্থানে বায়ুদূষণের পরিমাণ বেশি বলে ডেইলি স্টার টুইটে জানিয়েছে:
The sites with major construction and persistent traffic in Dhaka city have the highest level of air pollution.#Bangladesh #AirPollution https://t.co/YXiyFSXWyV
— The Daily Star (@dailystarnews) December 4, 2022
ঢাকা শহরের বড় বড় নির্মাণ কাজ এবং সারাক্ষণ যানজট লেগে থাকা জায়গায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি।
‘ঢাকায় বাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে’
২ কোটির বেশি মানুষ শহর ঢাকায় বসবাস করেন। জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর। ঢাকার ইতিহাস প্রাচীন হলেও রাজধানী হিসেবে এর ইতিহাস ৪০০ বছরের। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে এক নতুন স্বাতন্ত্র্য পায় এই ঢাকা। গ্রাম ও মফস্বল শহর থেকে দলে দলে লোকজন এসে এই শহরে বাস করা শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে আকার-আয়তনে, অবকাঠামো উন্নয়নে বড় হতে হতে এটি মেগাসিটিতে পরিণত হয়। আর মেগাসিটির সচলতার জন্য সরকার মেট্রোরেল, পাতাল রেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শহরজুড়েই চলছে সেগুলোর কর্মযজ্ঞ।
ঢাকার বায়ুদূষণকে এই ‘উন্নয়নের’ ফলাফল হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ:
যে ধারায় ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে মানুষের এই বিষাক্ত যাত্রা তারই ফল। বিশুদ্ধ নিরাপদ বাতাস, নিরাপদ পানি, নিরাপদ খাবার, নিরাপদ জীবন সবই এখন ধরাছোয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। শুধু থাকছে ‘উন্নয়নের’ পরিসংখ্যান!
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী, টাইম ম্যাগাজিনের ‘হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট’, ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্ট প্রাইজ’ বিজয়ী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দায়ী করেছেন:
আমরা কথিত উন্নয়নের বিকল্প উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারতাম। পোড়ানো ইটের বিকল্প পথে যেতে পারতাম। সরকার চাইলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জবাবদিহির আওতায় এনে বায়ুদূষণ কমাতে পারতো। গাছ লাগিয়ে, জলাশয়গুলো রক্ষা করেও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। বায়ুদূষণ মানুষের জীবনের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করছে, মরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, মানুষকে কঠিন কঠিন অসুখ দিচ্ছে। এদিকে আমরা ন্যূনতম মনোনিবেশ করছি না। এ কারণেই পরপর পাঁচদিন আমাদের প্রাণপ্রিয় নগরী দূষণের শীর্ষে থাকছে।
দূষণের কারণে ঢাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে টুইট করেছেন ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট ফারজানা ফারুক ঝুমু:
Living in Dhaka is getting harder everyday with the air pollution. #AirPollution https://t.co/2OxeRsK17K
— FARZANA FARUK JHUMU (@FarzanaJhumu) February 9, 2022
বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় বাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
#বায়ুদূষণ
দূষণে বাড়ছে অসুখ-বিসুখ
বছরের পর বছর ধরে চলা এই বিপজ্জনক বায়ু দূষণ এই শহরের মানুষের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে — বিশেষ করে বিভিন্ন রোগ বালাই হচ্ছে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এজন্য, বিশেষজ্ঞরা বায়ুদূষণকে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন।
গত নভেম্বরে বিশ্বব্যাংক ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ারপলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ মারা যান।
বায়ুদূষণের পেছনের কারণ চিহ্নিত করে পরিবেশ অধিদপ্তর ‘বায়ুদূষণ রোধ নির্দেশিকা’ তৈরি করলেও ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে কেবল রাস্তায় পানি ছিটানো ছাড়া সরকারের আর কোনো উদ্যোগ খুব একটা দৃশ্যমান নয়।