- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

মিয়ানমার: জান্তা, বৌদ্ধধর্ম ও যুব সম্প্রদায়

বিষয়বস্তু: পূর্ব এশিয়া, মায়ানমার (বার্মা), নাগরিক মাধ্যম, নির্বাচন, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সেন্সরশিপ, Civic Media Observatory, Country Monitor Observatory 2021-2022

এই গল্পটি গ্লোবাল ভয়েসেসের নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দিরের [1] সংবাদপত্র আন্ডারটোনসের অংশ। এটিতে মিয়ানমারের গণমাধ্যম প্রতিবেশের উপর এক বছরের গবেষণা এবং ২০২৩ সালে আমরা কী আশা করতে পারি তার সারসংক্ষেপ। লেখার হাইপারলিংকে ক্লিক করলে আপনি এটিকে ধরে রাখা দেখতে বিভিন্ন আখ্যান এবং গণমাধ্যমের পোস্ট পাবেন। আন্ডারটোনসের সদস্য হোন [2]

মানমন্দিরটি ২০২০ সাল থেকে মিয়ানমারকে পর্যবেক্ষণ [3] করতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করার প্রবণতা এবং উন্নয়ন চিহ্নিত করেছে আমাদের গবেষকরা। তারপর ২০২১ সালের শুরুর দিকে মিয়ানমারের সামরিক ক্ষমতা দখল নাগরিক আস্থা জয়ের বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালায়। গত দুই বছরে ক্ষমতা দখল, ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে চরম সহিংসতা এবং রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকে ন্যায্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে জান্তার আখ্যান পরিবর্তন ও রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করেছে সামরিক সমর্থকরা বিশেষ করে ফেসবুক এবং টেলিগ্রামের মতো অনলাইনে, এমনকি জান্তারা সেই স্থানগুলি নিয়ন্ত্রণ [4] করার চেষ্টার মাধ্যমেও এই আখ্যানগুলিকে জোরদার করেছে।

একটি অভ্যুত্থানের উৎপত্তি

মিয়ানমারের ২০২০ সালের নির্বাচনে অং সান সু কির দলের ভূমিধ্বস বিজয়ের মাত্র কয়েক মাস পরে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জনগণের কাছে একটি সম্পূর্ণ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার ইঙ্গিত দিয়ে, সামরিক বাহিনী একটি অভ্যুত্থান ঘটায়।

জান্তা এবং এর সহযোগী দল ইউনিয়ন সংহতি উন্নয়ন দল (ইউএসডিপি) ‘নির্বাচনী জালিয়াতি [5]’র ন্যায্যতা হিসেবে উল্লেখ করে গণতন্ত্রের জন্যে জাতীয় লীগ দল (এনএলডি) এর নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। প্রকৃত নির্বাচনের কয়েক মাস আগে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এবং রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের মঞ্চ তৈরির জন্যে “অং সান সু কি আর তার দলকে বিশ্বাস করা যায় না [6]” এই আখ্যানটি অনলাইনে প্রচার করে।

ডানপন্থী বৌদ্ধদের এক দশকের অপপ্রচার

বছরের পর বছর ধরে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা অং সান সু চি এবং তার এনএলডি দলকে অসম্মান করার চেষ্টা করেছে। এনএলডি ২০১৫ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং অনলাইনে ইসলামভীতি বেড়ে চলার বৌদ্ধ ধর্ম এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত বামার (বর্মী) গোষ্ঠীকে রক্ষা করার একটি আইনের বিরোধিতা করে। এই ভোট শক্তিশালী ডানপন্থী বৌদ্ধ অংশের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ২০২০ সালে ফেসবুকে জনপ্রিয় আখ্যান ছিল “প্রকৃত বৌদ্ধদের এনএলডি পার্টিকে ভোট দেওয়া উচিত নয় [7]” এবং “এনএলডি’কে ভোট দিলে বৌদ্ধধর্ম শেষ হয়ে যাবে [8]।”


“গণতন্ত্র = বিশৃঙ্খলা”

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভের প্রসার ঘটলে, সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া ক্রমশ সহিংস হয়ে ওঠে। জান্তা তার ক্ষমতা দখলকে “দেশের স্থিতিশীলতার জন্যে প্রয়োজনীয় [9]” বলে ন্যায্যতা দিয়েছে। এক বছর পরে এটি মিয়ানমারকে “বিশৃঙ্খলার মধ্যে” রয়েছে দাবি করে তার শাসনকে আরো বর্ধিত করে নেয়।

এই আখ্যানটি কীভাবে উত্থাপিত হয়েছে তা বোঝার জন্যে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। মিয়ানমার ২০১১ সাল পর্যন্ত কয়েক দশক ধরে সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। শান্তির জন্যে বর্মী সামরিক শাসন প্রয়োজন [10] বলে সামরিক শাসনের পক্ষাবলম্বনকারীরা যুক্তি দেয়। সর্বোপরি বিপরীত সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেওতারা যুক্তি দেয় কেবল অভ্যুত্থানের পরে দেশটি শুধু কার্যকরীই নয়, বরং আরো ভাল করছে।

বৃহৎ গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনগুলি ছোট ছোট, সশস্ত্র গেরিলা দলে বিভক্ত হয়ে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালালে এই আখ্যানগুলি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। “জন সুরক্ষা বাহিনী [11]”র ছত্রছায়ায়, দেশের কিছু যুবক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে এবং তাতমাদাওর (সামরিক শাসনের) বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনেকেই জাতিগত সংখ্যালঘুদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে শব্দটির মানে সম্মান ও গৌরব নির্দেশক “রাজকীয় সশস্ত্র বাহিনী” হওয়ায় বর্মী জনগণ সামরিক বাহিনী সম্পর্কে কথা বলার সময় তাতমাদাও শব্দটি ব্যবহার করে না [12]

“[প্রতিরোধ]এর সামরিক কর্মী, তথ্যদাতা এবং সরকারি ভবনগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করাকে একটি শান্তিপূর্ণ বর্মী সমাজকে ব্যাহত করার চেষ্টা করার জন্যে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে দেখা হয়েছে”, নিরাপত্তার কারণে বেনামী থাকা আমাদের গবেষকরা ব্যাখ্যা করেন৷ ফেসবুকের পোস্টগুলি এসব গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদের [13] আকর বলে অভিযুক্ত করেছে।

একইভাবে সামরিক বাহিনী একটি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো কোন নৃশংসতা করার পর এটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি পরিচালিত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই [14] বলে তার কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা দেয়।


“এটা মূর্খ যুবকের দোষ”

তরুণরা সারাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহী সশস্ত্র দল গঠন করেছে। অভ্যুত্থানের দেড় বছর পরে সামরিক বাহিনী “সন্ত্রাসী” তকমায় কম জোর দিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে “বিপথগামী, অনৈতিক এবং মাদকাসক্ত যুবক [15]” হিসেবে চিত্রিত করে যুবকদের সম্পর্কে তার সুর পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে।

সামরিক বাহিনী ২০২২ সালের মাঝামাঝি ঘোষণা করে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি ছেড়ে যারা সমাজে পুনরায় যোগদান করবে তাদের হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করা হবে। আমাদের গবেষকরা বলেছে, “এটিকে অনেকটা তরুণদেরকে ফাঁদে ফেলার সূক্ষ্ণ পর্দাযুক্ত একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে।”


ঝুঁকিতে রক্ষণশীল বৌদ্ধ মূল্যবোধ

সামরিক শাসন এবং এর সমর্থকদের একটি বড় অংশ হলো রক্ষণশীল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী। অং সান সুচির পার্টি প্রদর্শিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি সহনশীলতার মতো প্রগতিশীল মূল্যবোধগুলির বিরোধী। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে এনএলডি মুসলমান রাজনীতিবিদ, নারী এবং এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অধিকারের জন্যে আরো নাগরিক সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

অনেকে আসলে এনএলডি এবং অং সান সু চি প্রগতিশীলতা থেকে অনেক দূরে মনে করলেও ডানপন্থী বৌদ্ধদের যুক্তিতে “বেসামরিক সরকারের মূল্যবোধ বৌদ্ধধর্ম ও মিয়ানমারের বিপরীত [16]।” ২০২০ সালে অনলাইনে ব্যাপকভাবে নারীদের রাজনীতি [17] এবং বৈচিত্রের সংস্কৃতি [18] বিরোধী আখ্যান ছড়িয়ে পড়ে এবং নৈতিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকারের পরিণতির চিত্র অঙ্কিত হয়।

আর তাই স্মৃতিবেদনাতুর সামরিক সমর্থকদের একটি পুরানো প্রজন্ম মনে করে যে “শুধু সামরিক সমর্থকরাই বৌদ্ধধর্মকে মূল্য দেয় এবং জাতির প্রতি যত্নশীল [19]।” এই গোষ্ঠীর মতে শুধু তারাই প্রকৃত অর্থে বৌদ্ধ মূল্যবোধ বোঝে এবং রক্ষণশীল থাকাটা তাদের জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

অভ্যুত্থানের আগে অনেকাংশে যৌনতাবাদী, সমকাম এবং ইসলামবিরোধী মনোভাবাপন্ন এই অংশ ফেসবুক তাদের মতামতকে দমিয়ে দিচ্ছে বলে দাবি করে। “সামরিক সমর্থকরা সামরিক শাসনের অধীনে এই মতামত প্রকাশ করা নিরাপদ বোধ করে বলে অভ্যুত্থানের পরে এসব চরম ক্ষতিকারক পোস্টের প্রচলন আরো বেড়ে যায়”, আমাদের গবেষকরা বলেছেন। “তারা এগুলিকে গণতন্ত্রপন্থী সমর্থকদের প্রতি সামরিক বাহিনীর সহিংসতার ন্যায্যতা হিসেবেও উল্লেখ করে।”

অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে জীবনযাত্রার মান ও অর্থনীতিতে ধ্বস নামলে আবারো জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ আখ্যান দেখা যায় যা জনগণকে একটি তুষ্ট (এবং দরিদ্র) বৌদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে “সামরিক শাসনে খাপ খাইয়ে নিতে হবে [20]” বলে ইঙ্গিত দেয়। অর্থনৈতিক কষ্টকে পরিত্রাণের প্রয়োজনীয় উপায় হিসেবে দেখিয়ে সামরিক বাহিনী সৃষ্ট অর্থণৈতিক অব্যবস্থাপনাকে ইতিবাচকভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।


২০২২ সালে সমীক্ষা করা প্রধান থিমগুলো

নীচের মিথষ্ক্রীয় তালিকাটিতে আপনি আমাদের অধ্যয়ন করা প্রধান প্রধান থিম এবং সামগ্রিক আখ্যানের কাঠামোগুলির মধ্যে সম্পর্ক দেখতে পারেন।

২০২৩ সালে কি আশা করা যায়

সামরিক গোষ্ঠী ২০২৩ সালের আগস্টে অনুষ্ঠেয় একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। এনএলডি পার্টি এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনটি বয়কটের অঙ্গীকার করেছে। আমাদের গবেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে “২০২৩ সালের বেশিরভাগ আখ্যান হবে এই আসন্ন সামরিক-সংগঠিত নির্বাচনকে ঘিরে” এবং এগুলো আসবে সামরিক সমর্থক ও সামরিক বিরোধী প্রতিরোধ গোষ্ঠী থেকে।

আমাদের গবেষকরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশকে স্থিতিশীল করেছে, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তারা বৈধ শাসক এমন দাবি করে আসন্ন নির্বাচনের প্রচারের পাশাপাশি নির্বাচনের জন্যে হুমকি এনএলডি সমর্থক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নৃশংস দমনের আহ্বান জানানো আখ্যান আশা করছে। জাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচারিত ‘অ্যামিও-বাথা-থার্থনা’ (জাতি, ভাষা এবং ধর্ম) সুরক্ষা সম্পর্কিত আখ্যানও প্রত্যাশিত।

আদর্শিক বর্ণালীর অন্য প্রান্তে থাকা বিরোধী দলগুলি সামাজিক গণমাধ্যমে প্রক্রিয়াটিতে জালিয়াতির সম্ভাবনা দাবি করে জনগণকে নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান জানাবে এবং সামরিক-সংগঠিত নির্বাচনের বিরোধিতার আখ্যানটি জোরদার করবে।

এসব অনলাইন আখ্যানের সাথে সাথে সারাদেশে তীব্র সশস্ত্র সংঘাত, ডিজিটাল নজরদারি বৃদ্ধি, সামরিক কর্তৃপক্ষের জান্তাবিরোধী সমালোচকদের নৃশংস দমন ও গ্রেপ্তার, এবং ভোটকেন্দ্র ও প্রশাসনিক দপ্তরগুলিতে বিরোধী সামরিক হামলার মতো অফলাইন ঘটনাবলী বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

মিয়ানমারে প্রচারিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য আখ্যান: