- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

ভারতের তরুণরা কি এখন আগের চেয়ে বেশি রাজনীতিবিমুখ?

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, ভারত, উন্নয়ন, নাগরিক মাধ্যম, ব্যবসা ও অর্থনীতি, যুবা, রাজনীতি, শিক্ষা, সরকার, দ্যা ব্রিজ (সেতুবন্ধন)

গোয়াতে নরেন্দ্র মোদির বিজয় সংকল্প সমাবেশ। ফ্লিকারে [1] জোগোয়াইউকে গোয়া [2] এর ছবি (সৃজনী সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি লাইসেন্স ২.০ [3])।

গ্লোবাল ভয়েসেসের তরুণ কণ্ঠ ধারাবাহিকের অংশ হিসেবে এই নিবন্ধটি লিখেছেন বর্তমানে ওবারলিন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্র বিশাল রাজাদুরাই। এই ধারাবাহিকটি তরুণদের যুব-ভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন, প্রযুক্তি, রাজনৈতিক সমস্যা ও প্রবণতা নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার একটি জায়গা দেয়। এখানে আমাদের তরুণ কণ্ঠ: নাইজেরিয়া [4] ধারাবাহিক পাবেন।

ভারতে বিশ্বের বৃহত্তম যুব জনসংখ্যা রয়েছে: ১৪০.৮ কোটি লোকের প্রায় ৪৯ শতাংশ ১৫-৪০ বছর বয়সী। বিশেষ করে ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে এই জনসংখ্যা একটি জাতির ভিত্তি, তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৃদ্ধির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে উন্নয়নশীল সমাজ সমীক্ষা কেন্দ্র (সিএসডিএস) – কনরাড এডেনৌয়ার স্টিফটুং (কেএএস) প্রকাশিত প্রতিবেদন [5] অনুসারে ভারতের যুব জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশের কোনো রাজনৈতিক আগ্রহ নেই, এমনকি যারা আগ্রহী তাদেরও কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা নেই বলে মনে হয়, যা দেশের বিশাল প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতে [6]র জন্যে দুর্ভাগ্যজনক।

জরুরী অনেক সমস্যাতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ এবং যুক্ত হওয়া  প্রয়োজন বলে এটি বিশেষভাবে চিন্তার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, কোভিড-১৯ মহানারী [7]র দীর্ঘায়িত স্বাস্থ্যসেবার চাপ, বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য [8] এই সমস্ত সমস্যার দ্রুত সমাধান দরকার। ইউনিসেফের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে [9] জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের শিশুরা সবচেয়ে “ঝুঁকিতে” রয়েছে, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং উন্নয়নের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দেশের অগ্রগতির জন্যে নতুন তরুণ রাজনৈতিক মন দিয়ে এই জাতীয় সমস্যাগুলি উজ্জ্বল সমাধান করা দরকার। কিন্তু সেটা এখনো সুদূর পরাহত।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা [10]র পর থেকে ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে অপরিবর্তিত রয়েছে। গত সাড়ে সাত দশক ধরে এটি কার্যত অস্পষ্ট রাজনৈতিক প্রচারণার একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে মাত্র দুটি দল দেশ শাসন করেছে – ভারতীয় জনতা পার্টি [11] (বিজেপি) এবং ভারতীয় জাতীয় কংরেস [12] (কংগ্রেস বা আইএনসি)। উভয় দলই একই জনগোষ্ঠীর হিন্দু মধ্যবিত্তদের প্রতিনিধিত্ব করে। উভয়ের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের একটি ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, আর বিজেপি একটি অতি-ডানপন্থী হিন্দু কৌশল [13]কে মেনে চলে। প্রথমোক্তটির এই জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকার কারণে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকলেও তারা ব্যাপক স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতিতে ভুগছে। গত ২০ বছরে বিজেপির প্রগতিশীল কর্মসূচি প্রচার ও সংস্কারে সফলতা [14] কংগ্রেসকে সুবিধা করে দিয়েছে।

মৌলিক সমস্যা

ভারতের রাজনীতি দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২১ সালের দুর্নীতি উপলব্ধি সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৮৫তম [15]। ফলে রাজনীতিকে ঘিরে বেশিরভাগ আলোচনাই নেতিবাচক। এটি তরুণদের রাজনীতিতে জড়িত হতে নিরুৎসাহিত করে, যা তখন বদ্ধ তথ্যের বোঝা এবং কীভাবে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র চালানো উচিত সেটা বুঝতে পারার বাধা তৈরি করে।

আমি ভারতীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। উটির একটি বোর্ডিং স্কুলে আমি আট বছর পড়াশোনা করেছি। এতগুলি বছরে কোন রাজনৈতিক আলোচনা আমার মধ্যে কখনো উত্তেজনা বা উৎকণ্ঠা তৈরি করেনি।

দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও উগ্র জাতীয়তাবাদে পরিপূর্ণ ব্যবস্থার কারণে রাজনীতিতে “আগ্রহ” দাবি করাটা সহস্রাব্দ ও বিগত নব্বইয়ের প্রজন্মের জন্যে চ্যালেঞ্জিং। ২০১১ সালে কংগ্রেসে দলের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী পরিবারের কারণে তার রাজনীতিতে প্রবেশের কথা স্বীকার করেন [16], যা স্বজনপ্রীতির একটি চরম উদাহরণ। অনেক দল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোট টানতে তাদের প্রচারণায় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য করে। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির সদস্য নরেন্দ্র মোদির দল মুসলমানদের বিরুদ্ধে জঘন্য কুসংস্কারমূলক আলোচনা [17] ঠেলে দিয়ে একটি বিশাল হিন্দুপন্থী ভোটারকে তার প্রচারে যোগ দিতে রাজি করিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সরকারের কর্মক্ষমতার সমালোচনাকারী কর্মী ও সাংবাদিকদের সহিংস দমনের জন্যে সম্প্রতি মানবাধিকার পর্যবেক্ষক (এইচআরডাব্লিউ) মোদি সরকারকে চিহ্নিত করেছে। [18] সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু জ্বালা ধরানো নীতিও পাস করেছে — সম্প্রতি ২০২২ সালে কর্ণাটক রাজ্যে বিজেপি সরকার ক্লাসরুমে হিজাব নিষিদ্ধ করে [19]। রাজনীতিকে ঘিরে থাকা সংস্কৃতিটিও বিদ্বেষপূর্ণ। ভোটারদের একটি উচ্চতর নীতিভিত্তিক যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করার পরিবর্তে অনেক রাজনীতিবিদ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখাতে [20] নোংরা কৌশল অবলম্বন করে। এই সমস্যাগুলি ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমস্যার শুরু মাত্র।

একজন প্রতিনিধির নির্বাচনে দাঁড়ানোর ন্যূনতম বয়স হলো ২৫। বয়স্ক আইনপ্রণেতারা সংসদের একটি বড় অংশ দখল করে থাকায় সেটা  তরুণদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ একাগ্রতা ও প্রচেষ্টার দাবি রাখে এবং প্রণোদনাগুলি এই মাপের প্রতিশ্রুতিকে যথেষ্ট পরিমাণ অনুপ্রাণিত করে না। ২০১৯ সালে ৪৭ শতাংশ, সর্বমোট ৫৪৩ জনের মধ্যে ২৫৩ জন, সংসদ সদস্যের বয়স ছিল ৫৫ বছরের বেশি [21], যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। উপরন্তু, ১৩ শতাংশ (এমপি) ৪০ বছরের কম বয়সী, এবং মাত্র ২.২ শতাংশের বয়স ছিল ৩০ বছরের কম। ১৯৫৭ সালের তুলনায় এখন এক-তৃতীয়াংশেরও কম ২৫-৪০ বছর বয়সী সাংসদ [22] রয়েছে, যা ভোটার এবং প্রতিনিধিদের মধ্যে বয়সের ব্যবধানের পরিবর্তন তুলে ধরে।

ভারতকে তার সর্বোত্তম কর্মক্ষমতা দেওয়ার ক্ষুধা নিয়ে ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তরুণ রাজনীতিবিদদের নিয়ে। তবে এর পরের দশকে এর বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভারত বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং ধর্মীয় বিদ্বেষের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে উন্নতি করতে পারেনি এবং একভাবে তার ডিএনএর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যকে নষ্ট করছে।

দিগন্তে আশাবাদ?

প্রাথমিকভাবে ২০১০ এর দশকের গোড়ার দিকে ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে নয়াদিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আম আদমি পার্টি (এএপি) নামে পরিচিত একটি নতুন সফল দল, অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “সাধারণ মানুষের দল।” এএপি কোন একটি একক মতাদর্শ অনুসরণ করে না, “[দলটির] কোন ‘মতবাদ’ নেই; আর যদি থেকেও থাকে সেই মতবাদটি হলো ‘নাগরিক-বাদ।’” [23] বরং এটি ব্যক্তি নাগরিকের প্রয়োজনের ভালো দিকটি খোঁজে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা পক্ষপাত ছাড়াই নাগরিকের সমস্যার সমাধান করে।

এএপি ২০১৩ সাল থেকে দেশের রাজধানী নয়াদিল্লি শাসন করছে। এটি তার প্রথমবার বড় কোন সাধারণ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিরোধিতা ছাড়াই পূর্ববর্তী ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসকে পরাজিত করে। দলটি ২০১৩ সালে তার প্রথম নির্বাচনী বিজয়ের পর থেকে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি এটি প্রধানমন্ত্রীর নিজ রাজ্য বিজেপির একটি ঘাঁটি গুজরাটে ১৩ শতাংশ ভোট জিতেছে।

গুজরাটের এই ভোটগুলি এএপির একটি জাতীয় দল হিসেবে সীমানা পূরণের স্বীকৃতি দেয় এবং ধারণা করা হয় যে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে এএপি ব্যাপক প্রচার পাবে [24]। এটি ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের কয়েকটি উৎসাহজনক লক্ষণের একটি হলেও গুজরাটে জয়ী হতে আগ্রহী এএপি তার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি থেকে সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের তোষণ শুরু করছে [25]। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো দলটি ২০১৯ সালে দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়ে নীরব ছিল [26]। এটি দলটির ঘোষিত প্রগতিশীল নীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে বেশ কয়েকটি রাজ্যে জয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় কৌশলকে প্রকাশ করে।

তবে ভারতের রাজনৈতিক শক্তিঘর বিজেপি এবং কংগ্রেসের দেশ জুড়ে এতো বেশি সংস্থান এবং জোট ছড়িয়ে রয়েছে যে এএপি হয়তো নরেন্দ্র মোদি [27]রাহুল গান্ধী [28]র মতো গৃহস্থালী নামগুলিকে স্থানচ্যুত করতে পারবে না। তবুও এটি বিজেপি এবং কংগ্রেসকে তাদের প্রতিনিধিত্বের আধুনিকীকরণ এবং তরুণ প্রজন্মের সাথে আরো ভালভাবে জড়িত হতে তাদের ধারণাগুলি সংস্কারের দিকে পরিচালিত করার মতো চাপ সৃষ্টি করে করতে পারে।

বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বিশৃঙ্খল [29]। সংখ্যালঘুদের প্রতি কুসংস্কারের অনৈতিক কৌশল থেকে শুরু করে রাজনীতিতে তরুণদের আগ্রহ এবং সম্পৃক্ততার অভাব পর্যন্ত বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। সম্ভবত তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো যুব সম্প্রদায়ের সাথে তাদের প্রতিনিধিদের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা। দেশের ৩৫ কোটি তরুণ-তরুণীর প্রায় ৪৮ শতাংশ কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত নয় [5]। তার ওপর ৭৫ শতাংশ রাজনৈতিকভাবে আগ্রহী তরুণ-তরুণী সাধারণ রাজনৈতিক প্রচারণা বা কর্মসূচিতে অংশ নেয় না। এতেই বোঝা যায় তরুণরা রাজনৈতিক দৃশ্য থেকে কতোটা বিচ্ছিন্ন।

সংযোগ বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে সরকারের তরুণদের রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে বেশ কিছু উদ্যোগ ও পরিবর্তন গ্রহণ করা এবং যুব পরিষদ, সংসদ বা কমিটির মাধ্যমে  আনুষ্ঠানিক যুব প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো [30] উচিত। তবে এই সংস্কারগুলি প্রায়শঃই আদর্শিক ফলাফল আশা করে যার জন্যে টাকা দরকার। রাজস্ব ঘাটতির উদ্বেগের কারণে ইতোমধ্যে বাজেটই সঙ্কুচিত হচ্ছে [31] বলে এটা অগ্রাধিকার নাও পেতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত সরকারি কর্মকর্তারা, বিশেষ করে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর পরিবর্তে পুরনো অচলায়তন [32] ত্যাগ করতে নারাজ বলে অর্থপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়িত হওয়াটা অনেকটাই অসম্ভব।