- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

সমুদ্রে উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কেন শ্রীলঙ্কার আটক কেন্দ্রে যাবে?

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, শ্রীলন্কা, দেশান্তর ও অভিবাসন, নাগরিক মাধ্যম, মানবাধিকার, শরণার্থী, দ্যা ব্রিজ (সেতুবন্ধন)
A boat carrying Rohingya migrants. Screenshot via YouTube channel Rohingya Vision. Fair use. [1]

রোহিঙ্গা অভিবাসী বহনকারী একটি নৌকা। ইউটিউব চ্যানেল রোহিঙ্গা ভিশন [1] এর পর্দাছবি। ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার।

রুকি ফার্নান্দো [2]র এই নিবন্ধটি মূলত একটি পুরস্কার বিজয়ী নাগরিক গণমাধ্যম ওয়েবসাইট গ্রাউন্ডভিউজে প্রকাশিত হয়। গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি করে নেওয়ার চুক্তির অংশ হিসেবে এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ এখানে প্রকাশিত হয়েছে।

১৭ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে উত্তর শ্রীলঙ্কার জেলেরা সমুদ্রে দুর্দশাগ্রস্ত একটি নৌকা সম্পর্কে নৌবাহিনীকে সতর্ক করলে ১৮ ডিসেম্বর তারিখে নৌবাহিনী নৌকা থেকে ১০৪ জনের একটি দলকে উদ্ধার করে [3]। নৌবাহিনী তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করলেও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এক বিবৃতিতে তাদের রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোহিঙ্গা মুসলমানেরা রাষ্ট্রহীন এবং অনেকেই মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়েছে এবং পালনো অব্যাহত রেখেছে। অতিরিক্ত ভিড় ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির ছেড়েও চলে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদ্ধারের জন্যে নিকটবর্তী রাষ্ট্রগুলির কাছে ডিসেম্বরে জাতিসংঘসহ পূর্ব আবেদন সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে মৃত্যু [4]র আশঙ্কাজনক প্রতিবেদন ছিল।

উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পর (জাফনা জেলার) মাল্লাকাম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হলে “সন্দেহজনক” হিসেবে তাদের জাফনা কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। কোন আইনি বিধানের তাদের (শিশু সহ) আটক বা কোন অপরাধে সন্দেহ করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়, বিশেষ করে যেহেতু তারা অবৈধভাবে অবতরণ করেনি বা এমনকি অবৈধভাবে শ্রীলঙ্কায় প্রবেশের চেষ্টাও করেনি, দুর্দশাগ্রস্ত একটি নৌকা থেকে নৌবাহিনীর সদস্যরা তাদের উদ্ধার করেছে মাত্র। নৌবাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন যে “এটা কোন অপরাধমূলক কাজ নয়।”

ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে [5] তাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে সহায়তা প্রদান করা শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। জাফনা কারাগারে থাকাকালীন মান্নার আর্থসামাজিক উন্নয়ন সংস্থা [6] (এমএসইডিও) তাদের জামাকাপড়, অন্তর্বাস, হিজাব, স্যানিটারি প্যাড, ডায়াপার, বিছানার চাদর, তোয়ালে, সাবান, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, চপ্পল, খেলনা এবং ভ্রমণের ব্যাগের মতো তাৎক্ষণিক মৌলিক চাহিদা পূরণ করেছিল।

দলটিতে এক থেকে ৭০ বছর বয়সের ২৯ জন পুরুষ, ২৬ জন মহিলা এবং ৪৯ জন শিশু রয়েছে।

অভিবাসী আটক কেন্দ্র

তাদের ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে কলম্বোতে এনে মিরিহানা এবং ওয়েলিসারা অভিবাসী আটক কেন্দ্রে অন্তরীণ রাখা হয়েছে।

আমি এবং কিছু ধর্মীয় নেতা ২৬শে ডিসেম্বর মিরিহানা অভিবাসী আটক কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় কর্তব্যরত স্টাফ এবং পুলিশ সদস্যরা আমাদের তাদের দর্শনের অনুমতি না থাকার এবং শুধু অভিবাসন কর্মকর্তাদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার কথা বিনয়ের সাথে জানায়। কিন্তু তারা দায়িত্বরত অভিবাসন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের সাথে শুধু ফোনেই কথা বলেন। দর্শকদের সাথে দেখা উৎসাহিত করা না হলেও পরের দিন তিনি আশেপাশে থাকা অবস্থায় আমাদের আসতে বলেন। আমরা সেটা করার পর তিনি আমাদের খাদ্য সামগ্রী এবং খেলনা বিতরণ করার অনুমতি দেন। সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে আমরা একটি বন্ধ কাঁটাতারের বেষ্টনী ঘেরা একটি দরজায় কয়েকজন শরণার্থীর সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ করেছি। শুধু একজন ব্যক্তি প্রাথমিক ইংরেজি বলতে পারায় ভাষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। দলটি বাংলাদেশের একটি শরণার্থী শিবির ছেড়ে ৩ ডিসেম্বর নৌকায় উঠে এবং উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা আমাদেরকে সমুদ্রে থাকার কথা বলে। শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন ইউএনএইচসিআর থেকে তাদের সবাই শরণার্থী সনদ পেলেও সমুদ্রযাত্রার সময় তাদের অনেকে সেটা হারিয়ে ফেলে।

আমরা ২৭ ডিসেম্বর তারিখে ওয়েলিসারা পরিদর্শন করার সময় ইউএনএইচসিআর ব্যক্তিগত সাক্ষা্তকাকার নিচ্ছিল। সেই সময় আইসিআরসি কর্মীরাও সেখানে ছিল। সেখানে ২০ জন নারী উদ্বাস্তুর সঙ্গে মাত্র দুজন পুরোহিতের কথা বলার অনুমতি ছিল। নতুন আগতদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে পশ্চিম শ্রীলঙ্কার পানাদুরা থেকে আসা দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী হতাশ হন। এটাই সাধারণ নিয়ম নাকি ইউএনএইচসিআর এর নিবিড় সাক্ষাৎকারের সময় আমাদের সেখানে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়নি।

তবে নিরাপত্তা কর্মীরা আমাদেরকে অভ্যর্থনা এলাকায় একই বন্দী কেন্দ্রে পাকিস্তানি শরণার্থীদের (যাদের সাথে আমি আগে দেখা করেছি) নির্দ্বিধায় কথা বলার জন্যে জায়গা দেয়। আমরা ওয়েলিসারায় ২০০৬ সাল থেকে শ্রীলঙ্কায় চারজনের একটি পরিবারসহ পাকিস্তানের কিছু শরণার্থী থাকার কথা শুনেছি।

উভয় আটক কেন্দ্রের সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মকর্তারা মানবিক সহায়তাকে স্বাগত জানান। হাসপাতালের একজন রোগীর অনন্য চাহিদার জন্যে সহায়তা চাইতে একজন কর্মকর্তা আমাকে পরে ফোন করলেও তারা কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না এবং দর্শকদের নিরুৎসাহিত করছিল। তবে তারা আমাদের ন্যূনতম কিছু কথাবার্তা বলার অনুমতি দিয়েছিল। এটা আশ্চর্যজনক, কারণ শ্রীলঙ্কার কারাগারে এমনকি সন্দেহভাজন অপরাধীরাও সপ্তাহে ছয় দিন দর্শনার্থীদের দেখা পায়।

অনুপ্রেরণা ও চ্যালেঞ্জ

বিশেষ করে অন্যান্য এশীয় রাষ্ট্রগুলিতে অনেক দিন বা সপ্তাহ ধরে [7]  হস্তক্ষেপের অনিচ্ছার তুলনায় এখানে নৌবাহিনীর দুর্দশাগ্রস্তদের উদ্ধার ও অবতরণ করানোর সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও দর্শনার্থীদের প্রবেশ সীমিত করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আটকে রাখায় শ্রীলঙ্কার অর্জিত প্রশংসা উদ্বেগ ও নিন্দার পরিচিত অভিব্যক্তিতে পরিণত হতে বাধ্য।

এমএসইডিও এবং অন্যান্যদের তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা প্রদানের

প্রচেষ্টা দুর্দশাগ্রস্ত একটি সম্প্রদায়ের প্রতি সংহতির কাজ। শ্রীলঙ্কার দুই শিশু তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলনা শরণার্থী শিশুদের জন্যে দান করেছে। সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক এবং চলমান অভিজ্ঞতা হলো ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কায় থাকা কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে আমার দেখা, যারা খবরটি দেখে অনেক চেষ্টা করে মিরিহানা আটক কেন্দ্র খুঁজে বের করে কিছু জিনিস-পত্র নিয়ে নতুন আগত শরণার্থীদের পরিদর্শন করে। পরের দিন আসতে বলা হলে তারা সেদিনও দেখা করে। আমাদের ওয়েলিসারায় রোহিঙ্গা নারী ও তরুণীদের দেখতে যাওয়ার কথা শুনে তারা সেখানে যাওয়ারও ইচ্ছে প্রকাশ করে।

শ্রীলঙ্কায় রোহিঙ্গা শরণার্থী, ধর্মীয় নেতা এবং অন্যান্যদের পরিদর্শনকে অবশ্যই উৎসাহিত করতে হবে, কারণ এসব শরণার্থীদের নৈতিক সমর্থন দান, আরো মানবিক সহায়তা তৈরি এবং শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতাকে উন্নীত করবে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে আমি আশা করি শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্র নৌবাহিনীর শুরু করা ভাল কাজটি অব্যাহত রাখবে এবং উদার নাগরিকদের সহায়তায়, সন্দেহভাজন অপরাধীদের মতো আটকে রাখার পরিবর্তে অনেক বেশি ভোগান্তিতে পড়া এই লোকেদের উপযুক্ত বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে। বাসস্থান ছাড়া আটক কেন্দ্র থেকে তাদের মুক্তি অর্থবহ হবে না কারণ রাস্তা ছাড়া তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাদের অবশ্যই পর্যাপ্ত খাবার, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা দিতে হবে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রকে অবশ্যই রোহিঙ্গা এবং সকল শরণার্থী শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা কাঠামোতে তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের উৎপাদনশীল জীবিকা নির্বাহের সুযোগ প্রদান করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই আগ্রহীদের শ্রীলঙ্কায় স্থায়ী পুনর্বাসনের বিকল্প এবং নাগরিকত্ব প্রদান করতে হবে। আমরা প্রায় পাঁচ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় থাকা এখনো রাষ্ট্রহীন আরো কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীকে শ্রীলঙ্কায় স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা সম্মতিসূচক উত্তরের সাথে তাদের প্রতি শ্রীলঙ্কাবাসীদের ভালো ব্যবহারের মন্তব্য যোগ করে।

সরকার ২০০৫ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে ইউএনএইচসিআরকে শরণার্থীদের পক্ষে তাদের ম্যান্ডেট কার্যকর করতে রাজি হয়। সরকার এবং ইউএনএইচসিআরের মধ্যে ২০০৬ সালে স্বাক্ষরিত একটি শর্তাবলীতে শ্রীলঙ্কায় বিদেশী নাগরিকদের শরণার্থী অবস্থার জন্যে ইউএনএইচসিআর এর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় এবং শরণার্থী সনদ প্রদানের পদ্ধতিগুলি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে৷ অপরাধ করেছে বলে সন্দেহ না করা পর্যন্ত সনদপ্রাপ্ত আশ্রিত বা শরণার্থীদের সাধারণত গ্রেপ্তার এবং আটক করা হয় না৷

বেশিরভাগ আশ্রয়প্রার্থী বিমানবন্দরের অভিবাসন কাউন্টার দিয়ে শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করে। এর আগেও সমুদ্রে নৌবাহিনীর উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শ্রীলঙ্কায় আনার ঘটনা ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে ইউএনএইচসিআর তাদের দাবিগুলি প্রক্রিয়াকরণ করার পরে অনেকেই স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্যে অন্যান্য দেশে চলে যায়। সর্বশেষ গোষ্ঠীটি আসার আগে ২০১৭ সালে কলম্বোর শহরতলিতে সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার স্থানান্তরিত ৩১ জনসহ শ্রীলঙ্কায় অন্তত ৩৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিল।

শ্রীলঙ্কার শরণার্থীদের সম্পর্কে আরো তথ্যের জন্যে এখানে [8] এবং এখানে [9] দেখুন।