বাঙালি শ্রোতাদের স্মৃতির পাতায় জায়গা নিল বিবিসি বাংলা রেডিও

আর শোনা যাবে না বিবিসি বাংলা রেডিও। ছবি বিবিসি বাংলার - ফ্লিকার থেকে। সিসি বাই এনসি -২.০।

আর শোনা যাবে না বিবিসি বাংলা রেডিও। ছবি বিবিসি বাংলার – ফ্লিকার থেকে। একটি ক্রিয়েটিভ কমনস বাই এনসি -২.০ লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত।

নতুন বছরের শুরুতেই লক্ষ-কোটি বাঙালি শ্রোতাদের স্মৃতির পাতায় জায়গা নিল বিবিসি বাংলা রেডিও। আর শোনা যাবে না বিবিসি বাংলা রেডিওতে সম্প্রচারিত কোনো অনুষ্ঠান। গত ৩১ ডিসেম্বর, শনিবার রাতে দীর্ঘ ৮১ বছরের যাত্রার সমাপ্তি ঘটলো। শেষ বছরগুলোতে প্রতিদিন সকালে ও রাতে আধা-ঘণ্টার দুটি করে বাংলা সম্প্রচার হত শর্টওয়েভ ও এফএম ব্যান্ডে। বিবিসি বাংলা বিভাগের শেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর ওয়েবসাইট আপডেট বন্ধ হলে মন খারাপ হয় অসংখ্য বাঙালির।

খরচ কমাতে, এবং সময়ের চাহিদা মেনে, বাংলা রেডিও বন্ধ করে টেলিভিশন এবং ডিজিটাল মাধ্যমে বেশি জোর দিবে বলে বিবিসি জানিয়েছে। সেই পরিকল্পনায় তারা ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষায় রেডিও-তরঙ্গ সম্প্রচার বন্ধ করে দেবে। রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হলেও বিবিসি বাংলা একটি মাল্টিমিডিয়া চ্যানেল হিসেবে চালু রয়েছে।

বাংলা বিশ্বের মোট ভাষাভাষী সংখ্যার দিক থেকে সপ্তম সর্বাধিক কথিত ভাষা। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৬ কোটির বেশী লোক বাংলায় কথা বলে, যার মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৬১ শতাংশ ভাষাভাষী এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে রয়েছে ৩৭ শতাংশ ভাষাভাষী।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অধীনে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় সম্প্রচার শুরু ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবরে। প্রথম প্রথম সপ্তাহে মাত্র ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান হতো। ১৯৬৫ সাল থেকে বিবিসি বাংলা নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন শুরু করে। খুব দ্রুতই বাঙালি শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশ করে মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।

নিচের ইউটিউব ভিডিওতে, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ প্রচারিত বিবিসির বাংলার সংবাদ শুনতে পারবেন – যেখানে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের তাজা খবর ছিল।

সেই সময়ে যু্দ্ধের খবর প্রচারের উপর পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা এবং সাংবাদিকদের উপর নানারকম চাপ ও হুমকির মুখেও বিবিসি বাংলা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে রেডিও না থাকায় বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান শোনার জন্য গ্রামের বাজারে একটি দোকানকে ঘিরে প্রচুর মানুষ জড়ো হতো। এসব সমাবেশের কারণে পাবনার পাকসীতে একটি বাজারের নতুন নামকরণ করা হয় বিবিসি বাজার

বাংলাদেশের বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তেও বিবিসি বাংলার খবর জনপ্রিয় ছিল — বাংলাদেশের স্বৈরাচারাবিরোধী আন্দোলনের সময়ে বস্তুনিষ্ঠ খবরের জন্য মানুষ পুরোপুরি বিবিসি বাংলার উপর নির্ভর করতো।

বন্ধ হওয়ার খবর শুনে শ্রোতারা স্মৃতিকাতর ও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে

কয়েক দশক ধরে বিশ্বে রেডিওর শ্রোতার সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। বিবিসির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের মানুষ সংবাদের চাহিদা মেটানোর জন্য টেলিভিশন ও ডিজিটাল মাধ্যমকে বেছে নিচ্ছেন।

বিবিসি বাংলা রেডিও ঘিরে বাংলাদেশের অনেক মানুষের অনেক স্মৃতি, আবেগ রয়েছে। আইটি পেশায় কাজ করেন আলমগীর কবির। তিনি নিজের ছোটবেলায় বাড়ির উঠানে বসে বিবিসি বাংলা রেডিও শোনার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেনঃ

মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
বিবিসি বাংলা রেডিও ঘিরে অনেক স্মৃতি, অনেক আবেগ রয়েছে। ছোটবেলায় দেখতাম উঠানে রেডিও নিয়ে সবাই বিবিসি শুনতো। কিছুক্ষণ পর পর রেডিও উঁচু করে এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ঠিকঠাক শোনার প্রক্রিয়া। […]
শতভাগ নিরপেক্ষতা ছিল বিবিসির।

বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচারের শেষ দিনের একটি স্কিনশট। বিবিসি বাংলা’র ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেয়া।

বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচারের শেষ দিনের একটি স্কিনশট। বিবিসি বাংলা’র ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেয়া। ফেয়ার ইউজ।

বিবিসি বাংলায় সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেন আকবর হোসেন। শেষ অনুষ্ঠানে রেডিও স্টুডিও’র একটা ছবি ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে পোস্ট করে বন্ধ হওয়ার কথা জানান। সেখানে মোমেন সরকার নামের একজন ফলোয়ার মন্তব্যের ঘরে লিখেন:

কি বলেন বিবিসি বাংলা বন্ধ হয়ে গেল? সেই ছোটকাল থেকেই সেই বিবিসি অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাশির মেঠো সুরের সাথে পরিচিতি ছিলাম।

টিভি সাংবাদিক মাহমুদ হাসান পারভেজ স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন:

আজ থেকে বিবিসি বাংলা রেডিও সম্প্রচার স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেল। যখন কিছুই বুঝতাম না, তখন থেকেই বিবিসি বাংলার সঙ্গে বন্ধন। বাংলাদেশে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে আর কোন গণমাধ্যম গ্রহণযোগ্যভাবে পৌঁছাতে পারেনি এবং ভবিষ্যতে ২য় কেউ পারবেও না। […] খুব বাজেভাবে মিস করবো প্রভাতী, প্রত্যুষা, প্রবাহ, পরিক্রমা অধিবেশন।

শ্রোতা কমে যাওয়ার কারণে বন্ধের কথা বললেও লেখক রেজা ঘটক বলেছেন মান কমে যাওয়ার কথা:

বিবিসি রেডিওর বাংলা শ্রোতা কমে যাওয়ার আসল কারণ বিবিসি অনুসন্ধান করে নাই। আমার পর্যবেক্ষণে বিগত ২০ বছর মার্কিন পলিসির আদলে বাংলাদেশে ভোল পাল্টিয়ে নিজেদের বিশ্বাস যোগ্যতা নষ্ট করেছে বিবিসি। বিবিসি র একসময় যে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন ছিল মুখ্য, সেই জায়গা থেকে বিবিসি সড়ে গেছে। যে কারণে রেডিও শ্রোতারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। […]

সাংবাদিকতায় যে চরমভাবে অনিয়ম ও অপচর্চা চালু হয়েছে, বিবিসি শেষের দিকে সেই সুরে সুর মিলিয়ে শেষে বন্ধ করতেই বাধ্য হলো। শেষ হলো ৮১ বছরের বিবিসি বাংলা রেডিওর সোনালি ইতিহাস!

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .