আদিবাসী এবং গর্বিত: ‘কালো চিতা: চিরকালের ওয়াকান্দা'র প্রতি একজন মায়াভাষীর প্রতিক্রিয়া

মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্ট/ইউটিউব এর “কালো চিতা: চিরকালের ওয়াকান্ডা” সিনেমার একটি দৃশ্যের পর্দাছবি

সাংস্কৃতিক পরিচয় সম্পদের চেয়েও বেশি কিছু, সমৃদ্ধির জন্য এটিকে তাজা পানি দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। আমি একজন মায়াভাষী আদিবাসী, মেক্সিকোর ক্যাম্পেচে রাজ্যের পুকিনাচেন নামের ছোট একটি সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি ছেলে-মেয়েদের সাথে মায়া ভাষায় জ্ঞান ভাগাভাগি করে বড় হয়েছি এবং বাবা, মা, দাদা-দাদীরা আমাদের জমিতে ভুট্টা বেড়ে উঠতে সাহায্যকারী বৃষ্টির জন্যে আমাদের দেবতাদের ধন্যবাদ জানানোর মতো করে আমাদের মধ্যে যে ঐতিহ্য ও রীতিনীতিগুলি ঢুকিয়ে দিয়েছে। তবে বহির্বিশ্বে গেলে একটি সমাজের সৃষ্টি করা নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হই যা আমাদের শিকড়কে ছোট করে অস্তিত্বহীন করে দেয়।

এই পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট উদাহরণ সেই স্কুলগুলো যেখানে শিক্ষকরা আমাদেরকে স্পেনীয় ভাষায় যোগাযোগ করার জন্যে চাপ দিতো। ফলে আদিবাসী সংস্কৃতি ও পরিচয়ের অবমূল্যায়িত হয়ে আমাদের ভাষার বিলুপ্তি ঘটে। জাতীয় পরিসংখ্যান ও ভূগোল প্রতিষ্ঠান (আইএনইজিআই) অনুসারে ইউকাতান উপদ্বীপে সারাদেশের মধ্যে মায়া ভাষাভাষীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে ২০১০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত এই ভাষায় কথা বলা লোকসংখ্যা ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

সমান সুযোগ পাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় সামাজিক মান পূরণ করতে না পেরে প্রত্যাখ্যানের ভয়ে আমরা আমাদের উৎস লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের স্বপ্ন তাড়া করাটা কঠিন পথ হলেও আমার মধ্যে আমার পরিবারের লালিত মূল্যবোধগুলি আমাকে “আমি যেখানেই যেতে চাই না কেন আমি কে সেটা মনে রাখতে” অনুপ্রাণিত করেছে।

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো এখন জানে যে আমরা অনেক দূর যেতে পারি এবং এর জন্যে সারাবিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমাদের পাওয়া অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ প্রতিনিধিত্বকে ধন্যবাদ। আমার শেষ অভিজ্ঞতা ছিল “কালো চিতা: চিরকালের ওয়াকান্ডা” চলচ্চিত্রে আমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে আমাদের মতো লোকেদের সফলতা।

সর্বশেষ মার্ভেল প্রোডাকশনটি হলো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও এখন পর্যন্ত বিশ্বের কাছে অচেনা কাল্পনিক একটি আফ্রিকীয় দেশ “ওয়াকান্দা”র নেতা ও সুরক্ষক সুপারহিরো কালো চিতার গল্পের সিক্যুয়াল। সারাবিশ্বে অসাধারণ সফল সিনেমাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বক্স অফিসে বিক্রয়ের রেকর্ড স্থাপন করেছে। মেক্সিকোতেও ‘কালো চিতা’ সিনেমা হলগুলোতে ছিল একচেটিয়া

আফ্রিকীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিকভাবে বৈষম্য ও জাতিগত বিভেদের শিকার জনগোষ্ঠীর দৃশ্যমানতার দিকে পরিচালিত করার কারণে সিনেমার পটভুমিটি প্রাসঙ্গিক এবং একটি রাজনৈতিক মাত্রার কারণে একটি বিতর্কের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রথম সিনেমাটির মতোই নতুন “চিরকালের ওয়াকান্দা” বিভিন্ন সংস্কৃতিকে উপস্থাপন ও ক্ষমতায়ন করে – এই ক্ষেত্রে মেসোআমেরিকান সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান, বিশেষ করে মায়া সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে সহ-অভিনেতা নমোরের কমিকসের উৎপত্তিকে সংশোধন করে। মায়া সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য (শিল্প, ইতিহাস, ভাষা এবং মহাজাগতিকতা) সহ “তালোকান” (“আটলান্টিস” এর পরিবর্তে) এর কাল্পনিক জলজ রাজ্যের বিকাশ একটি আশ্চর্যজনক স্থান সৃষ্টি করে। এটি বিশ্বব্যাপী মায়া সংস্কৃতি ও ভাষাকে বেগবান করেছে।

মেক্সিকীয় অভিনেতা তেনোচ হুয়ের্তার অভিনয়ে নামোরের নেতৃত্বে তালোকানের লোকেরা আমার মতো আনুমানিক আট লক্ষ লোকের মাতৃভাষা ইউকাতানের মায়া ভাষায় কথা বলে। এটি মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা জুড়ে কথ্য ৩০টিরও বেশি মায়া ভাষার মধ্যে একটি। “মায়া ভাষা হলো নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব এবং ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রদায়, সহযোগিতামূলক কাজ এবং নম্রতার মতো মূল্যবোধে পরিপূর্ণ একটি ভাষা। মায়া শুধু একটি ভাষা নয়, এটি দেবতাদের ভাষা। এমনকি আমাদের প্রবীণরাও তাই বলে,” বলেছেন মায়া ভাষার শিক্ষক হোসুয়ে ম্যানুয়েল পুত কাহুন।

চলচ্চিত্রটিতে মায়া অভিনেতা হোসুয়ে মায় চি’র দুর্দান্ত কাজ এবং বাকি অভিনেতাদের ভাষা প্রশিক্ষক হিসেবে মায়া ভাষাকে পরিচিত করতে এবং মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার এতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের সংস্কৃতিকে সেই দুর্দান্ত গল্পের একটি অপরিহার্য অংশ করে তুলে — এর সবই এমন একটি অনুপ্রেরণার প্রতিনিধিত্ব করে যা শিশুটির হৃদয়কে এতোটাই স্পন্দিত করে যে শিশুটি তার বন্ধুদের সাথে গাছে চড়া খেলতো, খালি পায়ে ভুট্টার ক্ষেতে দৌড়াতো, একটি কাঠের লাঠি দিয়ে সাইকেলের টায়ার চালাতো এবং ক্লান্ত হলে কাছের জালতুন* থেকে জল পান করতো।

কাঠ কেটে পিঠে বহন করে ঘরে এনে আগুন জ্বালানো সম্ভব করে আমার মায়ের জন্যে মাটি থেকে পাওয়া ভুট্টার গ্রিল জ্বালানোর মাধ্যমে আমার পূর্বপুরুষদের খাওয়ানোর জন্যে আজ আমি আমার বাবাকে ধন্যবাদ জানাই। আমার লোকেরা তাদের ত্বকে কানকাবের রঙ পরে এবং অন্যান্য আদিবাসী, মায়া, ক্যাম্পেচানো এবং মেক্সিকীয়রা তাদের স্বপ্ন পূরণে সফল হতে দেখে আমাদের ভূমি নিয়ে আমাদের গর্ববোধ করে। এটি আমাদের হৃদয়কে সেই স্বপ্নগুলিতে বিশ্বাসের মাধ্যমে স্পন্দিত করে অতীতে যাকে আমরা আমাদের উৎস, ত্বকের রঙ বা ভাষা্র জন্যে সীমাবদ্ধ হতে দেখেছি।

হোসুয়ে মায় চি’র মতো আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো: আমাদের উৎস ও ভাষাকে পুনর্মূল্যায়ন করা এবং প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে স্বীকৃত সুযোগ হিসেবে বোঝা। আমাদের সংস্কৃতিকে হেয় না করে এতে গর্ববোধ করা, এটিকে দৃশ্যমান করা এবং গর্বিতভাবে আমাদের পরিচয়ের প্রতিটি অংশকে উপস্থাপন করা আমাদের কর্তব্য।

ইন কাবায়ে (আমার নাম হলো) জাতা এইদের আলবার্তো পেরিজ ডিজুল। আমরা আমাদের নামগুলির গুরুত্ব জানলেও তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পরিচয় ও উত্তরাধিকার দিয়ে তৈরি আমাদের ইতিহাস। আমি বর্তমানে আমার একটি লক্ষ্য পূরণ করছি। আমি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা হলো প্রতিটি ছেলে-মেয়ে যেন নিজেদের মূল্যবান মনে করে এবং সমস্ত স্বপ্ন যে পূরণ হয় সেটা দেখানোর একটি অনুপ্রেরণা হওয়া।

আমি আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে বলতে খুবই খুশি যে:

Máasewalén, maaya´en yéetel jach náach in náay (আমি আদিবাসী, মায়া এবং একজন মহান স্বপ্নদ্রষ্টা)।

Kux teech, máaxechí? (আর আপনি, আপনি কে?)

jaltún*: sarteneja (পাথরের প্রাকৃতিক গহ্বর যাতে বৃষ্টির জল জমে থাকে), ইউকাতান উপদ্বীপে এটা খুবই সাধারণ।
k´aankab**: প্রাক-স্পেনীয় বাড়ির দেয়ালে লাল মাটি প্রয়োগ করা হয়, যা আদিবাসীদের মাংস ও শরীরের প্রতিনিধিত্ব করে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .