চলমান অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু বিপর্যয়, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য ক্ষতির কারণে ২০২২ সালটি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের জন্যে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। গত বছর আমরা স্বৈরাচারী চর্চার কারণে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেছি এবং বিশেষ করে ভারতে, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার কারণেএই প্রবণতা ২০২২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
জলবায়ু সংকট
২০২২ সালে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ লা নিনা (ছোট্ট খোকা) জলবায়ু প্রভাবের কারণে ভারী বর্ষার বৃষ্টিতে প্রলয়ঙ্করী বন্যার শিকার হয়েছিল। মে এবং জুন মাসে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা এলাকা বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জুনের মাঝামাঝি বন্যাটি মেঘালয় এবং আসামের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলিতে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে নদী ও জলধারাগুলি উপচে পড়ে নীচের দিক প্লাবিত হয়। দুর্ঘটনা এড়াতে প্লাবিত এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এবং বেশিরভাগ মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ৪০ লক্ষ মানুষ যোগাযোগ বা বিদ্যুৎ এবং খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানীয় জল ছাড়াই আটকা পড়ে।
বর্ষা মৌসুমের কারণে পাকিস্তানে জুলাই মাসে বন্যা শুরু হয় এবং আগস্টে এর আরো অবনতি হয়। এই গ্রীষ্মের তীব্র তাপের কারণে ৭ হাজারেরও বেশি হিমবাহের বরফ গলে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ বন্যা হয়েছিল। বন্যার পানিতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ তলিয়ে গিয়ে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাকিস্তান জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। ১৭০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং ১২ হাজারেরও বেশি আহত হয়। পাকিস্তান সরকার দেশে ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলারেরও (প্রায় ৩ লক্ষ ১৭ হাজার কোটি টাকা) বেশি ক্ষতি হয়েছে – এটি অনুমান করেছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বরফ আকারে মেরু অঞ্চলের পরে জলের বৃহত্তম ভাণ্ডার হিমালয়ের জলচক্রকে বিঘ্নিত করেছে। জল নীচের দিকে প্রবাহিত হওয়ার ফলে এই পর্বতমালার বরফের আস্তরণগুলি বিপজ্জনক হারে গলে এবং হিমবাহগুলি ভেঙে গিয়ে ভূমিধ্বস ও বন্যা হচ্ছে। হিমবাহের হ্রদ ফেটে সৃষ্ট বন্যা (জিএলওএফ) শুধু ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশের মানুষের বসতিগুলির জন্যেই নয় অবকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্যেও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
জলবায়ু-সম্পর্কিত আরো খবরের জন্যে আমাদের সবুজ কণ্ঠের কভারেজ দেখুন।
সংকটে শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার জনগণ ২০২২ সালকে ভুলে যেতে চাইবে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে বছরের শুরুতে শ্রীলঙ্কা ব্যাপক অর্থনৈতিক ও জ্বালানী সংকটের সম্মুখীন হয় এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তোলে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বেড়ে যায়। সরকার জরুরি অবস্থা ও সান্ধ্য আইন ঘোষণা করে এবং সাময়িকভাবে সামাজিক গণমাধ্যম নিষিদ্ধ করে বিক্ষোভ দমন করার চেষ্টা করে। সেই একই মাসে দেশটি ৫ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৫ লক্ষ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা) বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হয়।
আরাগালায়া (সিংহলি ভাষায় “সংগ্রাম”) নামের শান্তিপূর্ণ গণঅভ্যুত্থানটি ৯ মে তারিখে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগকে তরান্বিত করে৷ এক মাস পরে বিক্ষোভকারীরা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য করে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে এখন দেশটির রাষ্ট্রপতি।
তবে নেতৃত্বের পরিবর্তনে দেশের ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি থেমে যায়নি বা খাদ্য ঘাটতি প্রশমিত হয়নি। কিছু কিছু গবেষণা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে পরিস্থিতি এমন থাকলে আরো লক্ষ লক্ষ শ্রীলঙ্কাবাসী দারিদ্র্যে নিপতিত হবে। দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩ সালের প্রথম দিকে চার বছরের জন্যে ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের (প্রায় ৩০ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা) দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তির প্যাকেজ তৈরি করবে বলে আশা করে।
শ্রীলঙ্কার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো খবরের জন্যে আমাদের বিশেষ কভারেজ “সংকটে শ্রীলঙ্কা” দেখুন।
পরাধীনতা পর্যবেক্ষক
গ্লোবাল ভয়েসেসের প্রকল্প পরাধীনতা পর্যবেক্ষক তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন এগিয়ে নিতে বিশ্বব্যাপী সরকারগুলির ডিজিটাল যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার অধ্যয়ন এবং প্রতিবেদন করে। দক্ষিণ এশিয়ার গবেষকরা এই প্রকল্পে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে অবদান রেখেছে।
২০২২ সালের আগস্টে প্রকাশিত এই নিবন্ধটি ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশে বিভিন্ন মঞ্চ এবং সরকারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাকে উল্লেখ করে। সমালোচনা দমন করতে ভারত সরকার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কন্টেন্ট নামিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে টুইটার বিষয়বস্তু অপসারণের আদেশের প্রতিবাদ করে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতাকে ক্ষুন্ন করে বলে সাংবাদিক সংগঠন, সুশীল সমাজ গোষ্ঠী এবং সাংবাদিকরা ২০২২ সালের ভারতীয় কেন্দ্রীয় মিডিয়া স্বীকৃতি নির্দেশিকার সমালোচনা করেছে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে ভারতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভিন্নমত নজরদারী এবং দমন করতে প্রায়শই কীভাবে প্রযুক্তিগত ও অনলাইন সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা হয়।
ডেটা শাসন, বক্তব্য, প্রবেশাধিকার এবং তথ্যের ক্ষেত্রে ভারত কীভাবে ডিজিটাল অধিকার এবং স্বাধীনতাকে হ্রাস করে সে সম্পর্কে আরো জানতে সম্পূর্ণ পরাধীনতা পর্যবেক্ষকের ভারত সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি পড়ুন। পরাধীনতা পর্যবেক্ষকের প্রকাশ্য ডেটাসেটও উন্মুক্ত করা হয়েছে পর্যবেক্ষণের জন্যে।
নিয়ন্ত্রণের মহামারী
২০২২ সালে গ্লোবাল ভয়েসেস তার বিষয়বস্তু অংশীদার এনগেজমিডিয়ার “নিয়ন্ত্রণের মহামারী” ধারাবাহিক থেকে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির কর্তৃত্ববাদী ব্যবহার, বিশেষ করে ডিজিটাল নজরদারি এবং ডেটা সুরক্ষার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধকারী বিভিন্ন নিবন্ধ পুনঃপ্রকাশ করেছে।
মহামারী চলার সময় ভারতের দ্রুত ডিজিটাল প্রযুক্তি অভিযোজন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে এবং সরকার মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক মুখ সনাক্তকরণ ব্যবস্থার মতো প্রযুক্তির ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেয়।
শ্রীলঙ্কায় সরকারের কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিক্রিয়া নষ্ট করে দেয় রাষ্ট্র পরিচালিত অপপ্রচার এবং ভিন্নমতের দমন। মহামারী চলাকালীন ভিন্নমত দমনের জন্যে বাংলাদেশ নিপীড়নমূলক আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ ব্যবহার করে।
নেপালে বড় আকারের ডেটা সংগ্রহ, দুর্ঘটনাবশত জনসাধারণের ডেটা প্রকাশ এবং নজরদারি কার্যক্রম নাগরিকদের মধ্যে ডেটার গোপনীয়তা ও সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করে।
নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দির (সিএমও)
নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দির (সিএমও) ২০১৯ সাল থেকে চলে আসা গ্লোবাল ভয়েসেসের -এর একটি প্রকল্প। এর লক্ষ্য হলো ঘটনা, প্রবণতা এবং অন্যান্য প্রপঞ্চের আশেপাশে গুমাধ্যমে আবির্ভূত মূল ভাব এবং বর্ণনামূলক কাঠামোগুলি সনাক্ত ও অনুসরণ করা। সিএমও পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষকরা আমরা যে বিশ্বে বাস করি এবং আমরা যে গল্পগুলি বলি তা বোঝার জন্যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে গণমাধ্যমের উপাদানগুলির অর্থ উদ্ধার করে৷
২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুসন্ধানী গল্প বিশ্লেষণ করার জন্যে বিভিন্ন দেশের সিএমও গবেষকরা গ্লোবাল ভয়েসেস নিউজরুমের সাথে কাজ করে। প্রকল্পটি “আন্ডারটোনস” নামে একটি নিউজলেটারের ধারাবাহিকও প্রকাশ করেছে।
উদাহরণস্বরূপ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি নিউজলেটার একদিকে বাংলাদেশের স্থানীয় নির্বাচনের সময় উদ্ভূত বিভিন্ন থিম ও আখ্যান পরীক্ষা করে, অপরদিকে মে মাসের নিউজলেটার রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিষয়ে বাংলাদেশের নিরপেক্ষতার পিছনের আখ্যানগুলি তুলে ধরে।
সেপ্টেম্বরের একটি নিউজলেটার পাকিস্তানের সামাজিক গণমাধ্যমে সেনাবিরোধী হ্যাশট্যাগগুলির দৃশ্যমানতা অর্জনের বিরল ঘটনাকে কভার করে এবং ডিসেম্বর মাসের নিউজলেটারটি ২০২২ সালে পাকিস্তানের মূলধারা এবং সামাজিক গণমাধ্যমের সবচেয়ে আলোচিত আখ্যানগুলির সংক্ষিপ্তসার করে।
২০২২ সালে ভারতে অতি-ডান হিন্দু গোষ্ঠীর উস্কানীতে মুসলমানবিরোধী মনোভাব বেড়ে উঠে। জানুয়ারি মাসে পুলিশ সুপরিচিত আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, কর্মী এবং সমাজকর্মী, বিশেষ করে মুসলমান নারীদের লক্ষ্য করে এবং তাদের নিলামে তোলার জন্যে ব্যবহৃত বুল্লি বাঈ অ্যাপের সাথে জড়িত চারজন পুরুষকে গ্রেপ্তার করে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকে রাজ্য কর্তৃপক্ষ হিজাব পরা ছাত্রীদের ক্লাসে যোগদান নিষিদ্ধ করার পরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে যাকে আন্দোলনকারীরা মুসলমান সংখ্যালঘুকে প্রান্তিক করার প্রচেষ্টা দাবি করে।
এই সিএমও নিবন্ধটি ভারতে ক্রমবর্ধমান মুসলিম বিরোধী সহিংসতায় মূলধারা এবং সামাজিক মিডিয়ার ভূমিকা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে এবং এই নিউজলেটারটি জ্বালাময়ী হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচার ছড়িয়ে দিতে ডানপন্থী চরমপন্থীরা কীভাবে ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার করেছে তা বিশ্লেষণ করেছে। অন্য একটি নিউজলেটার ভারতের উগ্র ডানপন্থীদের ইসলামভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার আখ্যান তুলে ধরেছে।
২০২২ সালের জুনে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্যে তার মুখপাত্র এবং দিল্লির মিডিয়া প্রধানকে বরখাস্ত করে এবং বিজেপি সমর্থকদের তাদের দলের প্রতি বিশ্বাস হারানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরের একটি নিউজলেটার ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা কেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে শ্রদ্ধা করে তার পিছনের আখ্যান অনুসন্ধান করে।
সিএমও এর সকল নিবন্ধ ও পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
এই হাইলাইটগুলি ২০২২ সালে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের কভারেজের একটি বাছাই। আপনি এখানে সম্পূর্ণ কভারেজ পাবেন।