বাংলাদেশ সরকার টিভি চ্যানেলগুলিকে জাতিগত উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ না বলার নির্দেশ দিয়েছে

Chakma children in Rangamati, Bangladesh. Image via Flickr by Mohammad Tauheed. CC BY-NC 2.0.

বাংলাদেশের রাঙ্গামাটিতে চাকমা শিশুরা। ফ্লিকারের মাধ্যমে মোহাম্মদ তৌহিদের তোলা ছবি। সিসি বাই-এনসি ২.০

বাংলাদেশে অন্তত ৩৫টি ভিন্ন ভাষায় কথা বলা ৫০টিরও বেশি জাতিগত ও আদিবাসী উপজাতির বাসস্থান। ১৯ জুলাই, ২০২২ তারিখে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ৩৫টি টিভি চ্যানেলকে সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনীর একটি বিধান উল্লেখ করে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার না করার একটি নির্দেশনা জারি করে

সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) জারিকৃত একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে মন্ত্রণালয় নৃতাত্ত্বিক উপজাতিদের উল্লেখ করার সময় আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা প্রচারের জন্যে টেলিভিশন চ্যানেলে টক শো এবং ৯ আগস্ট বিশ্বের আদিবাসীদের আন্তর্জাতিক দিবসের মতো অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন এমন শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এবং অন্যান্য সুশীল সমাজের সদস্যদের মতো সকল সম্ভাব্য বক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই নির্দেশনা জারি করেছে।

নামটিতে কী রয়েছে?

৩০ জুন, ২০১১ তারিখে প্রবর্তিত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। তবে এটি আদিবাসী উপজাতিদের উল্লেখ করেছে “উপ-জাতি”, “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি”, “ক্ষুদ্র- সম্প্রদায়” এবং “ক্ষুদ্র-জাতিসত্তা” হিসেবে।  একটি সাক্ষাৎকারে তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন উল্লেখ করেছিলেন যে সরকার আদিবাসী পরিচয়কে স্বীকৃতি দিতে নারাজ কারণ এটি দেশের স্থানীয় বাঙালিদের জাতিসত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটির মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর এবং ৯৮ শতাংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। কিছু কিছু বাংলাদেশীও সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করে এসব উপজাতিদের অনেকেই স্থানীয় নয়, বরং বসতি স্থাপনকারী দাবি করলেও তারা চায় বাঙালীদের মত তাদেরও সমান স্বাধীনতা ও অধিকার থাকুক।

এমন মতবাদ একচেটিয়া জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রীয় নীতি ও অবস্থান থেকে সংজ্ঞায়িত একটি পরিচয় থেকে উদ্ভূত। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর কিছু কিছু গোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছে

নির্দেশনাটির নিন্দা

১৯ জুলাই তারিখে নির্দেশনা সামাজিক গণমাধ্যমে চাউর হলে এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। অনেক অধিকারকর্মী, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং জাতিগত সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই নির্দেশনাটির প্রতিবাদ করে।

আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা গণমাধ্যমকে বলেন, বিজ্ঞপ্তিটি জাতিগত পরিচয় প্রকাশের স্বাধীনতার চরম লঙ্ঘন যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের নামান্তর।

আন্তর্জাতিও পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) কমিশন বিষ্ময় প্রকাশ করে এই নির্দেশনাটিকে “আদিবাসীদের প্রতি অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক ও অবমাননাকর” অভিহিত করেছে।

সাংবাদিক আ হ ম ফারুক ফেসবুকে লিখেছেন:

বাংলাদেশে আদিবাসী যদি না থাকে, তবে সরকারকে আগে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ইত্যাদি নামক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এমপি মন্ত্রীদের আদিবাসী শব্দ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। তখন এই প্রজ্ঞাপন সার্থক হবে।

প্রকৃতপক্ষে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো নামে আদিবাসী শব্দটি রয়েছে এমন ছয়টি বেসরকারি সংস্থাকে একটি চিঠি পাঠায় তাদের নাম পরিবর্তন করতে বলে।

At the yearly Chakma festival of Kotheen Chibor Daan. Image via Flickr by Mohammad Tauheed. CC BY-NC 2.0.

বার্ষিক চাকমা উৎসব  কঠিন চীবর দান। ফ্লিকারের মাধ্যমে পাওয়া মোহাম্মদ তৌহিদের তোলা ছবি। সিসি বাই-এনসি ২.০

এস বিকাশ চাকমা একটি ফেসবুক ভিডিওতে উল্লেখ করেছেন যে তিনি সরকারের নির্দেশনাটিতে দুঃখ পেয়েছেন:

আমি একজন আদিবাসী এটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনারা জোর করে আমাকে অন্য পরিচয়ে পরিচিত করতে চাইছেন কেন?

লেখক আহমেদ আমান সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী থেকে তুলে ধরেছেন:

“আদিবাসী” শব্দের পরিবর্তে সেখানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং নৃ-গোষ্ঠী শব্দ তিনটি যোগ করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের কোথাও এটা উল্লেখ করা হয়েছে কি যে, এখন থেকে আর “আদিবাসী” শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, করলে সেটা সংবিধান অবমাননা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য করা হবে? বিষয়টি পরিস্কার না করা পর্যন্ত টকশো কিংবা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় “আদিবাসী” শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশ দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম ডয়চে ভেলে বাংলায় লিখেছেন:

আদিবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী – যেটাই বলা হোক না কেন, এ সব গোষ্ঠীকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি অধিকার সুনির্দিষ্টভাবেই দিচ্ছে৷ এঁরা সরকারি বিশ্ববিদ‍্যালয়ে এবং সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পান৷ এই সুবিধা তাঁদের উন্নতির পথে সহায়তা করছে৷ তবে তা পর্যাপ্ত নয়৷

রাঙ্গামাটি থেকে সমুদয় চাকমা ফেসবুকে লিখেছেন:

আমরা শুরু থেকেই আমাদের “আদিবাসী” পরিচয়ের জন্যে লড়াই করে আসছি। তারা আমাদের “উপজাতি” বলে ডাকে যাতে আমাদের অপমান ছাড়া আর কিছুই নেই।[..]

আমরা বাংলাদেশের একটি আদিবাসী সম্প্রদায়। আমাদের ভাষা আছে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে এবং আমাদের ঐতিহ্য আছে।

৯ আগস্ট “আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস”। আমি বাংলাদেশের মারমা। আমি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .