ভারতীয় পুলিশের পুরানো টুইট ব্যবহার করে ভুয়া খবর উন্মোচনকারী মুসলমান সাংবাদিক গ্রেপ্তার

কয়েকটি ভারতীয় অনলাইন সংবাদ মঞ্চ/ পোর্টালের লোগো। বৈশ্বিক সীমানার ​​একটি ইউটিউব ভিডিও থেকে নেওয়া পর্দাছবি। ন্যায্য ব্যবহার।

২০১৮ সালে করা একটি টুইটের জন্যে ভারতীয় পুলিশ ২৭ জুন (২০২২) তারিখে ভারতীয় সাংবাদিক এবং ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্টনিউজ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করে। জুবায়েরকে অধুনা-লুপ্ত @বালাজিকিজাইন অ্যাকাউন্ট থেকে টুইটারে হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের মতে টুইটটিতে একটি হোটেলের ছবি দেখানো হয়েছে যার “হানিমুন হোটেল” সাইনবোর্ডটি আবার “হনুমান হোটেল” এ পরিবর্তন করা হয়েছে। হনুমান হলো সাহস, ভক্তি, শক্তি ও প্রজ্ঞার শ্রদ্ধেয় হিন্দু দেবতা এবং দেবতা রাম এর ঐশ্বরিক সহচর।

জুবায়ের চারদিন পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। এসময় কর্তৃপক্ষ চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে তার ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোনসহ তার ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলিতে প্রবেশাধিকার চায়। তাকে ভারতীয় দণ্ডবিধির শত্রুতা প্রচারের ১৫৩ক এবং ধর্মীয় সংবেদনশীলতা উস্কে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষমূলক কাজে জড়িত থাকার ২৯৫ক ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২ জুলাই তারিখে তাকে আনুষ্ঠানিক জামিন নামঞ্জুর করে ১৪ দিনের হেফাজতে পাঠানো হয়

জুনের শুরুতে জুবায়ের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমালোচনা করেন। শর্মা ইসলামের নবি মোহাম্মদ সম্পর্কে করেছিলেন, যার ফলে ভারতের সাথে ১৫টি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। শর্মার মন্তব্যকে “ইসলামভীতি” বলে অভিহিত করে তাকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয়।

সাংবাদিক রানা আইয়ুব জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের জন্যে একটি ধারাবাহিক অনলাইন প্রচারণা থাকার কথা তুলে ধরেছেন:

মোহাম্মদ জুবায়েরকে কারাগারে পাঠানোর অনলাইন প্রচারণার উপাখ্যান
সিনেমার একটি বক্রোক্তি উল্লেখ করে ২০১৮ সালের একটি টুইটের জন্যে অল্টনিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতাকে গ্রেপ্তার করা হলো তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচারণার চূড়ান্ত পরিণতি৷ @সংবাদ_ধোলাই এর চমৎকার প্রতিবেদন

জুবায়ের প্রায়ই ভারতে ক্রমবর্ধমান হিন্দু চরমপন্থা এবং দেশের ২০-কোটি-শক্তিশালী মুসলমান জনসংখ্যার অধিকার খর্ব করার ভিডিওগুলি তুলে ধরতেন।

ভারতে ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির ইসলামভীতিপূর্ণ মন্তব্যের উদাহরণগুলি তুলে ধরার ক্ষেত্রে জুবায়েরের ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক নিন্দা আদায়ের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ভাষ্যের জন্যে কৌতুক অভিনেতাদের কারাবন্দি করায় ভারতের ডানপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের সমালোচনা দমনে ঔপনিবেশিক যুগের আইন ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

সংবাদ মাধ্যমের পাহারাদার সীমান্তবিহীন প্রতিবেদক (আরএসএফ) প্রকাশিত ২০২২ সালের সংবাদ মাধ্যমের বিশ্ব স্বাধীনতা সূচকে ভারতের ১৫০তম অবস্থান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগকে প্রকাশ করে।

ব্যাপক নিন্দা

এদিকে নেতাকর্মী, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা জুবায়েরের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করেছে।

ডিজিটাল গণমাধ্যম সংস্থাগুলির একটি জোট ডিজিআইপিইউবি ভারতের সংবাদ ফাউন্ডেশন নিচের বিবৃতিটি জারি করেছে:

ডিজিআইপিইউবি অল্টনিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের সম্ভাব্য সবচেয়ে জোরালো ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছে।

সাংবাদিক সুরক্ষা কমিটি (সিপিজে) এর এশিয়া কর্মসূচি সমন্বয়ক স্টিভেন বাটলার আরো বলেছেন:

সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়েরের গ্রেপ্তার ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার আরেকটি নিম্ন স্তরকে চিহ্নিত করে, যেখানে সরকার সাম্প্রদায়িক বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সদস্যদের জন্যে একটি প্রতিকূল ও অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেছে। কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে জুবায়েরকে মুক্তি এবং আর কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাকে তার সাংবাদিকতার কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে।

বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (আইএনসি) নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন:

বিজেপির ঘৃণা, ধর্মান্ধতা ও মিথ্যার উন্মোচন করা প্রতিটি ব্যক্তি তাদের জন্যে হুমকিস্বরূপ।

সত্যের একটি কণ্ঠকে গ্রেপ্তার করলে আরো হাজার হাজারের জন্ম হবে।

সত্য সবসময় নির্যাতনের উপর জয়লাভ করে। #ভয়_পেয়োনা

তবে জুবায়ের সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া প্রথম কর্মী নন। ২৫ জুন তারিখে তাকে হেফাজতে নেওয়ার দুই দিন আগে গুজরাটের পুলিশ কর্মকর্তারা সহযোগী সক্রিয় কর্মী তিস্তা সেতালভাদকে ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাইতে তার বাসভবন থেকে নিয়ে যায়। সেতালভাদ এক হাজারেরও বেশি লোক – যাদের অধিকাংশই মুসলমান – হত্যাকারী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে তার সক্রিয়তার জন্যে পরিচিত।

মানবাধিকার সংস্থা ফোরাম এশিয়া তার গ্রেপ্তারের নিন্দা করেছে:

.@ফোরাম_এশিয়া গুজরাটের এটিএস কর্তৃক মানবাধিকার সুরক্ষাকারী @তিস্তাসেতালভাদ গ্রেপ্তারের নিন্দা করেছে৷ এটিই তাকে শিকার করার প্রথম ব্যাপক প্রচেষ্টা নয়। আমরা তিস্তার পাশে আছি এবং অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। #তিস্তাসেতালভাদ_মুক্ত_করো

প্রতিবেদন অনুসারে ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রচারণা গোষ্ঠী ফ্রিডম হাউস এর সাংবাদিক রানা আইয়ুব, পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা এবং আম আদমি পার্টি ও আইএনসি’র মতো বিরোধী রাজনৈতিক দলের টুইটগুলিও অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে৷ লুমেন ডেটাবেস এই নথিটি ভাগভাগি করেছে।

রাজনৈতিক ভাষ্যকার সাগরিকা ঘোষ এনডিটিভিডটকম-এ একটি মতামত লিখেছেন:

রাজনৈতিক কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের জেলে নিয়ে দমন করার জন্যে পুলিশের ক্ষমতা্র ব্যবহার ‘আইন-শৃঙ্খলা’ নিশ্চিত করে না, বরং এটিকে ধ্বংস করে। রাজনীতিবিদদের তিস্তা সেতালভাদের মতো অধিকার কর্মীদের মূল্য উপলব্ধি করতে হবে। এই কর্মীরা আইনানুগ গণতান্ত্রিক উপায়ে ব্যবস্থার কাছে ন্যায়বিচার এবং সহানুভূতির আবেদন করে। এভাবে তারা ভারতের গণতন্ত্রকে দেশ ও বিশ্ববাসীর চোখে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এনে দেয়।

তবে জুবায়েরের গ্রেপ্তারের দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জি৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাকস্বাধীনতার নীতি, উন্মুক্ত জনবিতর্ক এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

হিন্দু পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় এই ঘটনাটিকে “অবাস্তব নাটক” বলে অভিহিত করেছে:

এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সরকার বিদেশে বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুরক্ষাকারী হিসেবে দেখাতে চাইলেও রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ বা দমন-পীড়নের ঘৃণাকে কিছুই মনে করে না। ন্যায়বিচারের এই উপহাসকে চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিৎ কারণ দেখে জঘন্য মামলাটি প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তি দেওয়া।

সাংবাদিক উমাং পোদ্দার পরিস্থিটির বাস্তবতা তুলে ধরেছেন এভাবে:

জুবায়েরের আইনজীবীরা […] যুক্তি দেখায় যে একজন সাংবাদিকের ডিজিটাল যন্ত্রপাতিতে অনেক সংবেদনশীল তথ্য থাকে যা জব্দ করা উচিৎ নয়। তবে ভারতে সাংবাদিকরা অন্যান্য নাগরিকদের তুলনায় উচ্চতর মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা গোপনীয়তা উপভোগ করে না। অথবা তারা তাদের উৎস প্রকাশ থেকে সুরক্ষা পায় না।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পর্ষদ ১৯৭৮ এর ১৫(২) ধারায় কোন সাংবাদিককে তাদের উৎস প্রকাশ করতে বাধ্য করা যাবে না বলা হলেও এই সুরক্ষা শুধু পর্ষদের সামনে চলা কার্যধারার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২ জুলাই, ২০২২ তারিখে দ্য ওয়্যার সংবাদ পোর্টালের একটি অনুসন্ধান অল্টনিউজের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর জন্যে ব্যবহৃত ৭৫৭টি টুইটার অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব উন্মোচন করেছে। মূল এফআইআর উস্কে দেওয়া বেনামী টুইটার হ্যান্ডেলের (@বালাজিকিজাইন) ইমেল আইডি পুনরুদ্ধার করে জানা গেছে এটি হিন্দু যুব বাহিনীর (এইচওয়াইভি) রাজ্য সভাপতি এবং গুজরাট ভিত্তিক ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার (বিজেওয়াইএম) সহ-আহ্বায়ক বিকাশ আহিরের “কন্টাক্ট@বিকাশআহির.আইএন” এর সাথে যুক্ত।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .