- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

ভারতের কেন্দ্রীয় গণমাধ্যম স্বীকৃতি নির্দেশিকা ২০২২ কড়চা

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, ভারত, অ্যাডভোকেসী, আইন, নাগরিক মাধ্যম, মানবাধিকার, জিভি এডভোকেসী, Unfreedom Monitor
Indian Newspapers for sale at a vendors shop in New Delhi. Image via wikipedia by Shajankumar. CC BY-SA 3.0. [1]

নয়াদিল্লিতে একটি দোকানে বিক্রির জন্যে রাখা ভারতীয় সংবাদপত্র। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে শজনকুমার [1] এর তোলা ছবি। সিসি বাই-এসএ ৩.০ [2]

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বহু প্রতীক্ষিত কেন্দ্রীয় গণমাধ্যম স্বীকৃতি নির্দেশিকা প্রকাশ করে। নির্দেশনাগুলি [3] সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম কর্মীদের স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা, স্বীকৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়া এবং স্বীকৃতি স্থগিত করার ভিত্তি নির্ধারণ করে। এছাড়াও তারা প্রক্রিয়াটি সহজতর করার জন্যে পরিচালনা পর্ষদ, কেন্দ্রীয় গণমাধ্যম স্বীকৃতি কমিটির দায়িত্ব ও ক্ষমতা তালিকাভুক্ত করে। দাপ্তরিক স্বীকৃতি গণমাধ্যমকর্মীদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে না গিয়ে সরকারি দপ্তরে প্রবেশাধিকার পেতে এবং বিশেষ সভায় যোগদানের সুযোগ [4] দেয়ার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করার এবং সরকারি সিদ্ধান্তগুলি বোঝার একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। স্বীকৃত সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও নির্দিষ্ট স্কিমের অধীনে সরকারি ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্য [4] হয়।

পূর্ববর্তী নির্দেশনাগুলি প্রকৃতিগতভাবে আরো সাধারণ ছিল এবং অপব্যবহার করা হলে স্বীকৃতি প্রত্যাহার করার কথা উল্লেখ ছিল। নতুন নির্দেশনাটিতে [5] একজন সাংবাদিকের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করার ১০টি নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে।

প্রতিক্রিয়া কী?

নির্দেশনাগুলি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সম্প্রদায়, সক্রিয় কর্মী এবং সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। স্বীকৃতি স্থগিত করার জন্যে একটি নতুন শর্ত যোগ করা রাষ্ট্র কর্তৃক সংবাদ মাধ্যম সেন্সরের ভীতি সঞ্চার করেছে। ধারাটি অনুসারে “তারা ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা অথবা নৈতিকতার প্রতি ক্ষতিকর, বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধের প্ররোচনার কাজ করলে” একজন সাংবাদিকের স্বীকৃতি প্রত্যাহার [3] করা যেতে পারে। অন্যান্য ধারাগুলির মধ্যে, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আনা হলে তাদের স্বীকৃতিও স্থগিত করা যেতে পারে।

নির্দেশনাগুলির বিরোধিতাকারীরা উল্লেখ করেছেন এই ধরনের অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ধারাগুলি সাংবাদিকদের রাষ্ট্রের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে তাদের কাজের পদ্ধতিকে বিপন্ন করতে পারে। বিশেষত যেহেতু মূল অংশীজনদের সাথে পরামর্শ করে করা হয়নি বলে ভারতের সম্পাদকদের গিল্ড কেন্দ্রকে এই নিয়মগুলি প্রত্যাহার করতে বলেছে। “গুরুতর আমলযোগ্য অপরাধের অভিযোগ” এবং “মানহানি” এর মতো বিস্তৃত কারণে স্থগিতাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা বলেছে [6], “এটি স্পষ্ট যে এই অস্পষ্ট, স্বেচ্ছাচারী, এবং নিবর্তনমূলক ধারাগুলি যেকোন সরকার বিষয়ক সমালোচনামূলক এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদনকে সীমাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যুক্ত করা হয়েছে।” বাক-স্বাধীনতা রোধ করার ক্ষেত্রে অপব্যবহৃত হতে পারে বলে তারা স্বীকৃতির জন্যে পুলিশি প্রতিপাদন পাওয়ার শর্তাবলী নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গিল্ডের তালিকাভুক্ত উদ্বেগগুলির পাশাপাশি এটাও মনে রাখা অপরিহার্য যে সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ [7] কিছু কিছু ফৌজদারি আইন লঙ্ঘনের জন্যে সাংবাদিকদের প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন [8] বা এফআইআর দিয়ে চড় কষা [9]টাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানহানি হলো সমালোচক এবং সাংবাদিকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে ব্যবহৃত আরেকটি হাতিয়ার। ভারতে গণমাধ্যম সংস্থাগুলি একে অপরের বিরুদ্ধেও মানহানির মামলা দায়ের [10] করে থাকে। এই নির্দেশনাগুলি অব্যহত থাকলে মানহানি হলো স্বীকৃতি প্রত্যাহারের আরেকটি মানদণ্ড যা গণমাধ্যমর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করার বিদ্যমান ইচ্ছাকে আরো শক্তিশালী করতে পারে।

অন্যান্য প্রভাবশালী সাংবাদিক গোষ্ঠীগুলির পাশাপাশি ভারতীয় প্রেস ক্লাব [11] (পিসিআই) সরকারকে চাপ দেওয়ার জন্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে পিসিআই নির্দেশনাগুলির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে সরকারকে একটি চিঠি [12]পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে ক্লাবটি একটি স্বাক্ষর অভিযানও শুরু করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে পিসিআই, ভারতের সম্পাদক গিল্ড [13]  এবং ভারতীয় নারী গণমাধ্যম কোর  (আইডব্লিউপিসি [14]) নীতিতিমালাগুলির বিরুদ্ধে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে এবং মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠিটির একটি অনুলিপি প্রেরণ করে। এই নথিতে বলা হয়েছে [15]: “সরকার এই পদক্ষেপের পিছনে যুক্তি এবং জরুরি অবস্থা স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয়ভাবে সরকার এবং গণমাধ্যমর মধ্যে সংকট তৈরি করেছে।”

কিছু কিছু সাংবাদিক এবং আইনজীবী সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর এই ধরনের নির্দেশনাগুলির গুরুতর পরিণতির উপর আলোকপাত করে অভিমত রচনা করেছে। লেখক এবং সাংবাদিক সীমা চিস্তি উল্লেখ করেছেন [16]: “নতুন ‘নির্দেশনাগুলি’ সাংবাদিকদের ‘স্বীকৃতি’ বিষয়ক নয় বরং কার্যালয়গুলিতে নির্বাচিতরা কীভাবে গণতন্ত্র ব্যবহার করে সে সম্পর্কে। এই সরকার প্রশ্ন, প্রবেশাধিকার এবং স্বচ্ছতার ভূমিকাকে কীভাবে দেখছে তার একটি পরিমাপ।” তিনি আরো উল্লেখ করেছেন এই নীতিমালা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস করার আরো একটি উপায়। অন্য একটি লেখায় [17] নাগরিক স্বাধীনতার জন্যে গণ ইউনিয়নের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক ডক্টর ভি সুরেশ লিখেছেন: “বিশেষ করে কাশ্মীর উপত্যকার মতো অশান্ত এলাকায় সরকারি সংস্করণকে সমালোচনা করা বা প্রশ্ন তোলা বা বিতর্কিত করা সাংবাদিকতামূলক অংশের সামান্য আভাসেই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি সহজেই ব্যাপক ক্ষমতাগুলি ব্যবহার করতে পারে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রধান রাজনৈতিক কার্টুনশিল্পী ইপি উন্নি একটি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন এঁকেছেন [18], যেখানে একটি ছোট ছেলেকে নির্দেশনাগুলির অংশ হিসেবে ড্রেস কোড যোগ না করার জন্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে “ধন্যবাদ” জানাতে দেখা যাচ্ছে।

২২ মে তারিখ পর্যন্ত গণমাধ্যম গোষ্ঠীগুলির উত্থাপিত উদ্বেগের বিষয়ে বা নিয়ম প্রত্যাহার করার ইচ্ছার ইঙ্গিত সম্পর্কে প্রকাশ্যভাবে কোন সরকারি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বিভিন্ন সাংবাদিক সংস্থা, সুশীল সমাজ গোষ্ঠী এবং সাংবাদিকরা উল্লেখ করেছেন দেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়ার প্রেক্ষাপটে [19] এসব নিয়ম আসার ফলে সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে [6] হুমকি, গ্রেপ্তার, আইনি চাপ এবং হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তার ওপর তারা অস্পষ্ট শব্দযুক্ত আইন ব্যবহার করে গণমাধ্যমর উপর চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতার মহাসাগরে আরেকটি ফোঁটার অপব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে  উদ্বিগ্ন [16]। নির্বাহী উদ্যোগে তথ্য প্রযুক্তি (অন্তর্বর্তী নির্দেশনা এবং ডিজিটাল গণমাধ্যমের নৈতিকতার কোড) আইন ২০২১, ডিজিটাল গণমাধ্যমে একটি শীতল প্রভাব তৈরি করার জন্যে সমালোচিত [20]। কাশ্মীরের নতুন গণমাধ্যম নীতির আওতায় তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগ (ডিআইপিআর) “সহিংসতার উস্কানি, ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা জনসাধারণের শালীনতা এবং আচরণের স্বীকৃত নিয়ম লঙ্ঘনের মতো বৃহত্তর স্বার্থে [21] সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ বন্ধ করতে পারে।” গত বছর, ওয়্যার জানিয়েছে [22] জম্মু ও কাশ্মীরের কুপওয়ারার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিবেদন করার আগে সাংবাদিকদের প্রশাসনের “নিবন্ধন” এবং “অনুমোদন” নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক একটি আদেশ দিয়েছিলেন।

আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের পরেই প্রায়শই গণমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুন্নকারী এমন আইন ব্যবহার করে নির্বাহী বিভাগের মতো একটি স্তম্ভ থেকে এমন ধাক্কা প্রবল প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। একটি স্তম্ভ দুর্বল হয়ে গেলে পুরো ঘরটি কেঁপে যেতে পারে।