- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডে মানুষের পাশে মানুষ, এটাই বাংলাদেশ

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ, অ্যাক্টিভিজম, দুর্যোগ, নাগরিক মাধ্যম, পরিবেশ, ব্যবসা ও অর্থনীতি, মানবতামূলক কার্যক্রম, মানবাধিকার
শিল্পী তুফান চাকমা’র চোখে সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। [1]

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডকে অনেকেই বৈরুতের বিস্ফোরণের তুলনা করছেন। শিল্পী তুফান চাকমা [2]’র চোখে সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী উৎপাদনমুখী দেশ [3] হয়ে উঠছে ক্রমশঃ, এবং সাথে সাথে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও বাড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা ও অগ্নি প্রতিরোধের পদক্ষেপগুলো পর্যাপ্ত নয় এবং এরা ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না।

গত ৪ জুন শনিবার রাতে [4], বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি কনটেইনার ডিপোতে আগুন [5] লাগে। ফায়ার সার্ভিসকে ডাকা হয়েছিল দ্রুতই এবং যখন তারা স্থানীয়দের সাথে কন্টেইনারের আগুন নিভাচ্ছিল, একটি বিশাল বিস্ফোরণে [6] সবাই ছিটকে যায়। ফলে অনেক লোক মারা যায় এবং আহত হয়। এর পরপরই, রাসায়নিক কনটেইনারে একের পর এক বিকট বিস্ফোরণে স্থানটির চারপাশের বিশাল অংশ কেঁপে ওঠে, এবং বৃষ্টির মত আগুনের গোলা ঝরে পরে।

বিস্ফোরণের ব্যপকতা এতটাই ছিল যে আগুণ নিভাতে অগ্নিনির্বাপক কর্মী এবং আহতদের সেবা করতে স্বাস্থ্য সুবিধাগুলি লড়াই করে যাচ্ছিল। তবে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ আহতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে এটাই ছিল একটি ইতিবাচক দিক।

টুইটার ব্যবহারকারী নুরফা আক্তার লাকি জানিয়েছেনঃ

এই ছবিগুলো কোনো সিনেমার শুটিংয়ের নয়। শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পরের চিত্র এগুলো। এ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬ ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৪২ জন নিহত ও ৪০০ জনের বেশী আহত হয়েছেন।

এই কন্টেইনার ডিপোতে রপ্তানির জন্য প্রধানত তৈরি পোশাক বোঝাই কয়েক হাজার শিপিং কনটেইনার ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৪০০টি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে যে [10], হাইড্রোজেন পারক্সাইড [11] কেমিক্যাল বহনকারী কয়েক ডজন কন্টেইনার এই আগুণ ও বিস্ফোরণের মূল কারণ ছিল। দমকলকর্মীরা যারা প্রথমে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল, তাদের ডিপোর কর্মীরা অবহিত করেনি যে কিছু কন্টেইনারে রাসায়নিক পদার্থ উপস্থিত ছিল। বিস্ফোরণের শক্তি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে কন্টেইনারের ধ্বংসাবশেষ কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পরেছে। ৯ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী সহ এখনও পর্যন্ত অন্তত ৪৪ জন নিহত হয়েছে [12] এবং কয়েক শতাধিক লোক গুরুতরভাবে আহত হয়েছে – যাদের মধ্যে প্রায় ৫০ জনের অধিক উদ্ধারকর্মী।

মিঠুন সরকার তন্ময় টুইটারে অগ্নিকান্ডের কিছু ছবি দিয়েছেনঃ

চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলায় কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ড, বিস্ফোরণ!

চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিএম ইংল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো [15] ২৬ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। নেদারল্যান্ড-বাংলাদেশের যৌথ মালিকানায় [16]২০১১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

সাধারণ মানুষ আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে

ডিপোটিতে বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এতো ছিল [17] যে আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। অগ্নি নির্বাপণে প্রথমে ছুটে যাওয়া দমকলকর্মী, নিরাপত্তা কর্মী এবং কম্পাউন্ডের লরি চালকরা এই বিস্ফোরণের কবলে পরেন। একজন ২০ বছর বয়সী কর্মী যিনি অগ্নিনির্বাপক প্রচেষ্টা ফেসবুকে লাইভ-স্ট্রিমিং করছিলেন তিনিও বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন [18], তার ফোনের ক্যামেরায় বিস্ফোরণের পর সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। পরের কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেখান থেকে শত শত দগ্ধ ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু আশেপাশে কোনো ভালো হাসপাতাল বা ক্লিনিক ছিল না যা বিপুল সংখ্যক হতাহতকে চিকিৎসা দিতে পারে। অনেক আহতকেই ৪০ কিলোমিটার দূরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। আহতদের সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা। ৪০০ জনেরও বেশি আহতকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সিএমসিএইচ) ভর্তি করা হয়েছিল এবং তাদের চিকিৎসার জন্য বিপুল পরিমাণে রক্ত ও ওষুধের অভাব থাকায় একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি [19] তৈরি হয়েছিল।

এমন বিপদে পিছিয়ে থাকেননি এলাকার সাধারণ মানুষেরা। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তারাও। তাদের কেউ রক্ত দিতে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। কেউ আবার রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। কেউ আবার আগুনে ভস্ম হওয়া মৃতদেহগুলো বের করে এসেছেন। এদের একটি গাউছিয়া কমিটি [20]। এই সংগঠনের কয়েকশ স্বেচ্ছাসেবক শনিবার থেকেই অগ্নিদগ্ধদের হাসপাতালে পৌছে দেয়া এবং নিহতদের লাশ উদ্ধার ও সনাক্ত করার কাজে যুক্ত হয়েছে। আগুন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের অনেকেই ডিএনএ [21] পরীক্ষা করে শনাক্ত করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিও আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনঃ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের মৃতদেহ উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং জরুরি ওষুধ, চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং নিখোঁজ ও আহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করছে।

অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ও হতাহতদের রক্তের প্রয়োজনের কথা জানতে পেরে সে রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের উদ্দেশে ছুটে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কয়েকশ শিক্ষার্থী। নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের সংকট ছিল বলে, তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে বাস ছেড়ে প্রতিটা বাস স্টপেজে প্রাণ পণে এই নেগেটিভ রক্তদাতা নেগেটিভ রক্তদাতা বলে চিৎকার করে করে ডেকে ডোনারদের বাসে তুলেছেন ।

দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের এই এগিয়ে আসাটাকে চিত্রকর্মের মাধ্যমে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তরুণ শিল্পী তুফান চাকমা [25]

দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের এই এগিয়ে আসাটাকে চিত্রকর্মের মাধ্যমে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তরুণ শিল্পী তুফান চাকমা [25]। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

দুর্ঘটনাস্থলের অদূরেই স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন বিদ্যানন্দের [26] মা ও শিশু হাসপাতাল। বিস্ফোরণের পরপরই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা অগ্নিদগ্ধদের সেবা দিতে ছুটে গেছেন। দূর্ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে জরুরি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবক, চিকিৎসক ও নার্সরা। চিকিৎসকদের পরামর্শে ডায়েট চার্ট মেনে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করছেন তারা। তাছাড়া আহতদের সুস্থ হওয়ার পর পূর্নবাসনের পরিকল্পনা করছে বলে বিদ্যানন্দ তাদের ফেসবুক পেইজে [27] জানিয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেটের ওয়ান ডে দলের অধিনায়ক তামিম ইকবাল [28]। তিনি বিপদের সময়ে এগিয়ে আসা সাধারণ মানুষদের স্যালুট জানিয়ে লিখেছেন:

অভাবনীয় পরিস্থিতিতে জাতি হিসেবে আমরা এক আবারো প্রমাণিত হলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তীব্রতা এবং বিস্তৃতি আমরা আঁচ করতে পারিনি কিন্তু পাশে থাকতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। মানুষ মানুষের জন্য। শত বিভেদ ভুলে আমরা সকলের পাশে আছি, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছি, লড়াই করছি। ধন্যবাদ এই নায়কদের। মানবতার আবারো জয় হলো।
তাদের সবাইকে আমার স্যালুট।

আহতদের চিকিৎসায় সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসার প্রশংসা করে আরিফুর রহমান রিপন [29] লিখেছেন:

রিক্সা, সিএনজি, অন্যান্য গাড়ি ড্রাইভারা ভাড়া নিচ্ছে না। ওষুধের ফার্মেসি রক্তদানে অপেক্ষারত হাজারো রক্তদাতা শারীরিক শ্রম দিচ্ছে শত শত স্বেচ্ছাসেবক খাবার, পানি সরবরাহ করছে যে যেভাবে পারছে দল-মত-নির্বিশেষে এগিয়ে এসেছে রাজনৈতিক নেতারা।
আহ, মানবতা। চট্টগ্রাম আসলেই প্রশংসার দাবিদার।

বিপদের সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বাংলাদেশির জন্মগত চরিত্র বলে অভিহিত করেছেন গণমাধ্যম কর্মী তুষার আবদুল্লাহ [30]। আর বাংলাদেশটা সাধারণ মানুষেরই উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন [31]:

[…] কতিপয় চরিত্র হারানো, দেশ বিমুখ বাংলাদেশের পরিচয় হতে পারে না। বাংলাদেশের পরিচয় ঐ তরুণ সিএনজি চালক, যার গলায় ঝুলানো প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল—‘হাসপাতালে যেতে বা রোগীর সেবায় পরিবহন সংকটে পড়লে ফোন করুন নিচের নম্বরে..’। এই আম জনতারই বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। [32]

বাংলাদেশের বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। ২০১৯ সালে বনানির এফআর টাওয়ারেও বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লেগেছিল বলে ধারনা করা হয়। উদ্ধার কাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল। ছবি তুলেছেন যুবায়ের১৯৮৫। উইকিপিডিয়ার সিসি বাই-এসএ ৪.০ লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত।


বাংলাদেশে বারবার আগুনের বিভীষিকা কেন?
বাংলাদেশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ২০১০ সালে পুরনো ঢাকার নিমতলীতে [33]রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে আগুন লেগে ১২৪ জন; ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন [34] নামের একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লেগে ১১৭ জন পোশাককর্মী; ২০১৯ সালে বনানির এফআর টাওয়ারে [35]আগুন লেগে ২৬ জন মারা গিয়েছিলো। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তালিকায় আরো আছে টাম্পাকো ফয়েলস [36], হাশেম ফুডস [37], এমভি অভিযান-১০ [38] ইত্যাদি।

মুহাম্মদ কাইয়ুম এক পোস্টে [39]বিভিন্ন সময়ে ঘটা অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেছেন:

২০০৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ২,৩০৮ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন!
ভবন ধস, সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবি ও অন্যান্য অপমৃত্যুর ঘটনা যোগ হলে বাংলাদেশ আসলেই মৃত্যু উপত্যকা।

এদিকে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ধরন ও তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিস বলছে [40], বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্টসার্কিট হয়ে আগুনের ঘটনা ঘটছে। আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও এখন আগুন লাগার প্রধান কারণ এ রকম নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার।

তবে সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে [41] যে তৈরি পোশাকের কন্টেইনারের মাঝে রাসায়নিক হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এর কন্টেইনারের উপস্থিতি। হাইড্রোজেন পারক্সাইড নিজে দাহ্য নয়, তবে উচ্চ তাপমাত্রায় এটি অন্য দ্রব্য জ্বালাতে সহায়তা করে। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আট ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে থানায় মামলা [42] হয়েছে।