জান্তা সরকার বিরোধী বাহিনীকে তথ্য ও সাহায্য দেওয়ার অভিযোগ তুলে আটক করতে থাকায় মিয়ানমার ভিত্তিক সাংবাদিকরা কাজ চালানোর ক্ষেত্রে চরম ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে কমপক্ষে ১৪৩ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে জান্তা সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমার কৌশল ও নীতি পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান অনুসারে অন্তত ৮২ জনকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেওয়া হলেও ৫৮ জন এখনো সামরিক হেফাজতে রয়েছে।
এর আগে সাংবাদিকদের কারা অভিজ্ঞতা এবং বিদেশী সংবাদদাতা ও যারা দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে তাদেরসহ স্বাধীন গণমাধ্যমের কষ্টের কথা গ্লোবাল ভয়েসেস জানিয়েছে।
মিয়ানমারের মাটিতে কী ঘটছে সে সম্পর্কে বিশ্বকে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সরবরাহ করার জন্যে ঝুঁকি নিয়েও সাংবাদিকরা সম্মূখসারি থেকে প্রতিবেদন করে যাচ্ছে। মিয়ানমারে কাজের জন্যে বেনামী সাংবাদিকরা এমনকি বৈশ্বিক পুরস্কার জিতেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভর্তুকি দেওয়া একটি সংবাদ ওয়েবসাইট মুক্ত এশিয়া রেডিও (আরএফএ) এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে ফটো সাংবাদিক তা মওয়ে (ছদ্মনাম) মিয়ানমারের ঘটনাবলী কভার করার সময় সাংবাদিকদের জন্যে আবশ্যিক অতিরিক্ত সতর্কতা ভাগাভাগি করেছেন:
আমরা সরেজমিন সংবাদ কার্যক্রম কভার করতে গিয়ে ছবি তোলা বা লোকজনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার মতো কিছু শুরু করার আগে আমাদের প্রথমে ঘটনাস্থল থেকে পালানোর এবং গ্রেপ্তার এড়ানোর একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমি ইয়াঙ্গুনে হঠাৎ জড়ো হওয়া জনবিক্ষোভের ফটো তোলা শেষ করার সাথে সাথে কোন রাস্তায় পালাতে হবে তা সাবধানে পরিকল্পনা করেছি। এটা খুব চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছে। কভারেজ থেকে ফেরার পথে আমি অকুস্থলের কাছাকাছি রাস্তা থেকে ট্যাক্সি ধরি না। ট্যাক্সি নেওয়ার আগে আমার পরিচয়ের চিহ্ন লুকাতে আমি কয়েকটি ব্লক হেঁটে যাই।
আরএফএ এছাড়াও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়া এবং জান্তা সৈন্য ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যাওয়ার বিভিন্ন বিপদ নির্দেশ করা শান অঞ্চলের শ্বে ফি মিয়া সংবাদ সংস্থার একজন সম্পাদকের সাক্ষাৎকার নেয়:
আমরা জানি কেউ একবার গ্রেপ্তার হলে তার মুক্তি পাওয়া খুবই কঠিন। খারাপ দিকটি হলো, গ্রেপ্তারের পর নির্যাতন বা এমনকি হত্যা করাও হতে পারে।
এই এলাকাটিতে যে শুধু সেনাবাহিনী রয়েছে তা নয়। অনেক জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীও রয়েছে। আর তাই আমরা যে কোনো সময় গ্রেপ্তার ও আটক হতে পারি এবং জীবননাশের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি।
অভ্যুত্থানের পর জান্তা এক ডজনেরও বেশি স্বাধীন গণমাধ্যম গোষ্ঠীর লাইসেন্স প্রত্যাহার করার ফলে অনেক সাংবাদিক ভিন্ন ধরনের কাজ খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। স্থানীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কভারেজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে নাগরিক সাংবাদিকদের (সিজে) কাজের উপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরশীল হচ্ছে। স্বাধীন সংবাদ গোষ্ঠী মিজিমা জনসাধারণের কাছে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে নাগরিক সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করেছে:
মিয়ানমারের স্বাধীন গণমাধ্যম সরেজমিন “উৎস” হিসেবে বিভিন্ন ধরনের গল্প এবং ইনপুট প্রদান করে সঙ্কট-বিধ্বস্ত মিয়ানমারে কী ঘটছে তার একটি চিত্র আঁকতে সাহায্যকারী নাগরিক সাংবাদিকদের কাজকে সম্মান করে।
আমরা নাগরিক সাংবাদিকদের সাথে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। যারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বলাটা অত্যুক্তি হবে না যে অনেক নাগরিক সাংবাদিককে গল্প খূঁজতে গিয়ে মৃত্যু, আঘাত বা কারাবাসের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
মিজিমা সাগাইং অঞ্চলের সাংবাদিক থু খা (ছদ্মনাম) এর সাথে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া সমস্যার বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছে। থু খা গত বছর সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের শেষ হয়ে যাওয়া সম্ভাবনাগুলি তুলে ধরেন।
বিগত বেসামরিক সরকারের সময় থেকে সাংবাদিক পরিচয়পত্র ছাড়া সাংবাদিক হওয়া কঠিন ছিল। সাংবাদিক হিসেবে অপরিচিত কোন জায়গায় গেলে [সূত্রগুলি বিশ্বাস না করায়] আমাকে তদন্ত ও প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হতো।
জান্তা বিরোধী আন্দোলনের সময়ে নিযুক্ত সাংবাদিকদের চেয়ে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকরা তাদের চাকরি হারাচ্ছে বেশি।
মিজিমা ২০২১ সালে ছয় মাসের জন্যে আটক থাকা বাগো অঞ্চলের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক তেত পেইং (ছদ্মনাম) এর গল্পও তুলে ধরেছে। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে তিনি খুব কমই সুযোগ পেয়েছেন:
কর্মক্ষেত্রে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া সাংবাদিক তেত পেইং ফ্রিল্যান্স প্রতিবেদক হিসেবে যথেষ্ট উপার্জন করতে না পারার সমস্যার মুখে পড়েছেন। স্টাফ রিপোর্টার না হওয়ায় তার অবস্থান নিরাপত্তাহীন। আর বর্তমান পরিস্থিতির কারণে তাকে গোপনে দেশে কাজ করতে হচ্ছে।
এমনকি যারা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয় তারা তাদের ভিসা বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে ধরা পড়লে নির্বাসনের হুমকির সম্মুখীন হয়। আল জাজিরা ইংরেজিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাচিন সংবাদ গোষ্ঠীর সম্পাদক এই তথ্য জানিয়েছেন।
অভ্যুত্থানটির প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং শিল্পীদের সাহায্য করার জন্যে মিয়ানমারে বেনামী যৌথ ভিজ্যুয়াল বিদ্রোহের মতো কিছু উদ্যোগ চালু করা হয়। এটি সম্প্রতি ৩ মে বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা দিবসে সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে:
#বিশ্ব_সংবাদমাধ্যমের_স্বাধীনতা_দিবসে আমরা ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখের অভ্যুত্থানের পর থেকে সামরিক শাসকদের তাড়া, গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং হত্যার শিকার বর্মি সাংবাদিকদের প্রতি সম্মান জানাই।
অনেক সাংবাদিক আত্মগোপনে অথবা কোনো আইনি বা আর্থিক সাহায্য ছাড়াই বিদেশে পালিয়ে গেছে। দেশে এখন শুধু সামরিকপন্থী প্রকাশনাই প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছে। দেশ একটি বৃহদাকার সংঘর্ষে নিমজ্জিত এবং জনগণের আগের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্যের প্রয়োজন থাকায় আমাদের সাংবাদিকদের দলকে নিরাপদে থাকতে এবং #মিয়ানমারে_কী_ঘটছে রিপোর্ট করা অব্যহত রাখতে সাহায্য করার জন্যে আমরা নিবেদিত।
জান্তা-বিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকারও সামরিক বাহিনীর মিথ্যাচার ফাঁস করতে সাংবাদিকদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিয়েছে:
সামরিক বাহিনীর তীব্র চাপ ও নিপীড়ন সত্ত্বেও পেশাদার ও নাগরিক সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংগঠনগুলো নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ রক্ষায় অনড় অবস্থানে রয়েছে। এই ধরনের সাহসী কাজের কারণেই এসএসি [জান্তা সরকার] গণমাধ্যম যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। সত্য বেরিয়ে আসবেই এবং মিয়ানমারের গণমাধ্যম সম্প্রদায়ের সাহসী নর-নারীরা সামরিক অপপ্রচার ও মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে।