শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে লেখার দাম দিতে হচ্ছে সাংবাদিকদের

Sri Lankan journalists call for media freedom and accountability for killings and abductions of journalists at Galle Face Green protest site

শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকরা গালে ফেস গ্রিন প্রতিবাদস্থলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের হত্যা ও অপহরণের জন্যে জবাবদিহিতার আহ্বান জানিয়েছে৷ লেখকের দেওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

৩ মে ছিল বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা দিবস। শ্রীলঙ্কাতে দিনটি যখন শুরু হয় তখন দেশটি বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনা, খারাপ নীতির এবং ক্রমবর্ধমান ঋণ পরিশোধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে যুদ্ধরত। এটি ইতোমধ্যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

অন্তত একজন প্রকাশক — উপালি সংবাদপত্র লিমিটেড —নিউজপ্রিন্টের ঘাটতির কারণে ইংরেজি সংবাদপত্র দি আইল্যান্ডার এবং সিংহলী দিভাইনা’র শনিবারের মুদ্রণ সংস্করণ স্থগিত করতে বাধ্য হয়৷ অন্যদের মামলা করতে হয়। লিবার্টি পাবলিশার্সের প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা বলেছেন যে নিউজপ্রিন্টের দাম ইতিমধ্যে দ্বিগুণ ২০২১ সালের প্রতি মেট্রিক টন ৬০০-৭০০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রতি মেট্রিক টন প্রতি ১,২০০ মার্কিন ডলার (প্রায় ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকা) হয়েছে। লিবার্টি এখন পর্যন্ত — ইংরেজি ভাষার মর্নিং ডেইলি, সিংহলী ভাষার অরুণা এবং তামিল ভাষার থামিলিয়ান — সংস্করণ তিনটির প্রচার সংখ্যা না কমিয়ে বরং ব্যয় সাশ্রয় করার কথা ভাবছে।

ক্রমবর্ধমান ব্যয় ছাড়াও অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং এটি নিয়ে ক্রমবর্ধমান জনবিক্ষোভ কভার করা সাংবাদিকদের সহিংসতার সম্ভাবনার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হয়। ৬ মে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের বাইরে বিক্ষোভে টিয়ার গ্যাস ছোড়ায় সাংবাদিকদের উপর প্রভাব পড়ে। তিন দিন পরে ৯ মে তারিখে শ্রীলঙ্কার পডুজানা পেরামুনা পার্টির সমর্থকরা গল ফেস গ্রিনে  শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালানোর সময় প্রথমে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে।

Protesters stand in front of posters of killed and abducted journalists put up in front of the Presidential Secretariat.

রাষ্ট্রপতি সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভকারীরা প্রতিবাদ জানানোর জন্যে নিহত, নির্যাতিত ও অপহৃত সাংবাদিকদের পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লেখকের দেওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

একই দিনে সাংবাদিকরাপ্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন টেম্পল ট্রির বাইরে উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে যায়। ৩১ মার্চ মিরিহানায় রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনের বাইরে একটি বিক্ষোভ কভার করার সময় সাংবাদিকদের কমপক্ষে নয়জন আহত এবং দণ্ডবিধির ১২০ ধারায় ছয়জনকে আটক করা হয়। ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও থানায় একজনের  চিকিৎসা সহায়তা প্রত্যাখ্যান করা হয় বলে জানা গেছে।

নেতা-কর্মীরা একটি বাসে আগুন দেওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সেদিন মিরিহানায় উপস্থিত ডেইলি মিররের ফটোগ্রাফার বরুণা বানিয়ারাচ্চিকে শ্রীলঙ্কার বিশেষ টাস্ক ফোর্সের পুলিশ লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে বলে তিনি জানিয়েছেন। পরের দিন ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তারা তার সাথে দেখা করে তাকে বিক্ষোভকারীদের সনাক্ত করতে তাদের সাহায্য করার জন্যে তার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড হস্তান্তর করতে বলেছিল। ইতোমধ্যে তার অফিসে তার সরঞ্জাম জমা দিয়ে ফেলায় বানিয়ারাচ্চি তাদেরকে তার কর্মস্থলে একটি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করার পরামর্শ দেন। আরেক সাংবাদিক সিংহলী ভাষার সংবাদ সাইট মিডিয়াএলকে-এর প্রতিষ্ঠাতা থারিন্দু জয়বর্ধন বলেছেন যে তিনি রাজাপক্ষের বাড়ির বাইরে অবস্থানরত রাষ্ট্রপতির গণমাধ্যম বিভাগের কর্মীদের কাছ থেকে প্রতিবেদন বন্ধ করার মৌখিক হুমকি পেয়েছিলেন। পরে জয়বর্ধন মিরিহানা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন।  চ্যানেলের কভারেজের কারণে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে এমন দায়ী করার প্রয়াসে পুলিশ প্রধান ১ এপ্রিল তারিখে নিউজফার্স্ট নামের অন্তত একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন

 Days after a protester was shot dead by police in Rambukwella, a memorial dedicated to him features missing journalist Prageeth Eknaligoda, and killed journalists Lasantha Wickrematunge and Dharmeratnam Sivaram

১৯ এপ্রিল তারিখে রামবুকওয়েলায় পুলিশের গুলিতে একজন বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার কয়েকদিন পরে, তাকে উৎসর্গ করা একটি স্মৃতিসৌধে নিখোঁজ সাংবাদিক প্রগীথ একনালিগোদা এবং নিহত সাংবাদিক লাসান্থা বিক্রমাতুঙ্গে ও ধর্মরত্নম শিবরাম প্রদর্শিত। লেখকের দেওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্যে প্রায়ই সংস্থানের অভাব থাকে বলে শ্রীলঙ্কার অনেক সাংবাদিক কাজের সময় নিরাপত্তা অনুশীলন শিখে থাকে। এসবের পরিবর্তে জ্যেষ্ঠ্য সাংবাদিকরা কিছু পরামর্শ দেন। সংবাদ ওয়েবসাইট কলম্বো গেজেটের প্রতিষ্ঠাতা, ইশ্বরন রুতনামের মতে, অস্থির পরিস্থিতিতে যাওয়া সাংবাদিকদের জন্যে গ্যাস মাস্ক এবং হেলমেটের মতো সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।

সামাজিক গণমাধ্যম অবরোধ স্বাভাবিকীকরণ

নিরাপত্তার হুমকি ছাড়াও শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকদেরকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বা সরেজমিন প্রতিবেদন করতে না পারার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে।

৩ এপ্রিল তারিখ মধ্যরাতের ঠিক পরে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন মোবাইল পরিষেবা সরবরাহকারীদেরকে অর্থনৈতিক সঙ্কটের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত বৃহৎ বিক্ষোভের আগে – ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টিকটক, টেলিগ্রাম এবং ইনস্টাগ্রামসহ সামাজিক গণমাধ্যমের কয়েকটি মঞ্চ অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়। সপ্তাহান্ত জুড়ে সান্ধ্য আইন এবং জরুরি অবস্থা জারির পর  এই অবরোধটি ১৫ ঘন্টা স্থায়ী ছিল।

A protester holds up a poster condemning Sri Lanka's corrupt political culture. The poster features not just members of the ruling party but also members of the opposition.

একজন বিক্ষোভকারী শ্রীলঙ্কার দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিন্দা করে একটি পোস্টার ধরে আছে। পোস্টারে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ছাড়াও বিরোধী দলের সদস্যদেরও দেখানো হয়েছে। লেখকের দেওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সামাজিক গণমাধ্যম শ্রীলঙ্কায় তথ্য ও খবর প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। নাগরিকরা অর্থনৈতিক সঙ্কটের বিষয়ে তাদের মতামত ভাগাভাগি করতে সামাজিক গণমাধ্যমে #অর্থনৈতিক_সঙ্কট_এলকে এবং #রাজাপক্ষরা_বাড়ি_যাও হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেছে।  বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার সময় তারা অনুদানের উদ্যোগের এবং সুরক্ষা অনুশীলনের বিশদ ভাগাভাগি করেছে। সাংবাদিকরাও তাদের গল্প ভাগাভাগি করতে এবং গল্পের ধারণা সনাক্ত করতে সামাজিক গণমাধ্যমর উপর নির্ভর করে। রুতনাম বলেছেন অবরোধ তার ওয়েবসাইট কলম্বো গেজেটের পরিদর্শনকে প্রভাবিতকরেছে। কলম্বো গেজেটের মতো সংবাদ ওয়েবসাইটগুলি তাদের সাইটে ট্র্যাফিকের জন্যে মূলত সামাজিক গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করে এবং অবরোধের সময় দর্শকদের কম পরিদর্শনসহ তাদের আয় প্রভাবিত হয়, তিনি ব্যাখ্যা করেন।

অস্থির পরিস্থিতিতে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলিতে সরকারি অবরোধ অন্তত ২০১৮ সালে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপসহ বেশ কয়েকটি মঞ্চের উপর ক্যান্ডি জেলা জুড়ে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে চালানো দাঙ্গার সময় করা অবরোধের সময় থেকে চলছে।

ফলে বেশিরভাগ সাংবাদিক ভিপিএনের মতো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে উঠেছে – যাকে সমর্থন করেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের ছেলে ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী নমাল রাজাপক্ষে৷ তিনি ভিপিএনের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে সামাজিক গণমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা “সম্পূর্ণ অকেজো” বলে বর্ণনা করেছেন

সাংবাদিকদের সামাজিক গণমাধ্যম পোস্টগিলিও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালিত শ্রীলঙ্কা রূপবাহিনী কর্পোরেশনের অন্তত একজন সাংবাদিককে তার নিজের প্রোফাইলে রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করা বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম পোস্টের জন্যে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা

University students protest near the Presidential Secretariat on April 9.

রাষ্ট্রপতি সচিবালয়ের কাছে ৯ এপ্রিল তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভ। লেখকের দেওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

মোটামুটি ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ থেকে শ্রীলঙ্কায় জ্বালানি মজুদ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এটি সাংবাদিকদের কাজ পরিচালনা করা কঠিন, বিশেষ করে প্রায়ই তাদের মোবাইল ফোনের বিঘ্নিত করে তোলে। (মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারীরা তাদের ওয়েবসাইটের একটি বিজ্ঞপ্তির বাণীতে নিশ্চিত করে যে ব্যাকআপ বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার সময় সংযোগ বিঘ্নিত হতে পারে।)

তবুও শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকরা প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে। এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বিক্ষোভকারীরাও তাদের নিজস্ব গল্প বলছে। সামাজিক গণমাধ্যমর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন প্রচেষ্টার নথিভুক্তি অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে বিক্ষোভ অব্যহত রাখায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। এর ফলে ৬ মে তারিখে মিথ্যা তথ্য বা জনসাধারণের বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতার উস্কানি দেওয়া তথ্য ভাগাভাগি করাকে ফৌজদারি অপরাধীকরণ করে রাষ্ট্রপতির পাস করা জরুরি প্রবিধান (পাতলা পর্দা দিয়ে রাষ্ট্রপতির সমালোচনাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা) সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মীম, প্রতিবাদ চিত্র, আলোচনা এবং সংকটের গুরুত্বপূর্ণ কভারেজের বিস্ফোরণ ঘটেছে।

'Look around Nandasena, history repeats!' (Nandasena is President Gotabaya Rajapaksa's middle name)

‘তাকিয়ে দেখো নন্দসেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে!’ (নন্দসেন রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষের মধ্য নাম)। লেখকের দেওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা পড়ুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) বা শ্রীলঙ্কা গণফ্রন্টের নেতৃত্বাধীন হামলার প্রতিশোধ হিসেবে বিক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা এসএলপিপি’র মন্ত্রীদের গাড়ি ও বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া বিক্ষোভের কারণে ৯ মে তারিখে মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। চার দিন পরে সান্ধ্য আইনের মধ্য দিয়ে ভীষণ অজনপ্রিয় রনিল বিক্রমাসিংহে শপথ নেওয়ায় সেই বিক্ষোভ অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .