আইনের সশস্ত্রীকরণ: ডিজিটাল অধিকার দমনে জিম্বাবুয়ের নতুন সীমান্ত

একটি বিবর্ণ সংবাদপত্রের পটভূমিতে ফাটলযুক্ত স্ক্রিন সহ একটি স্মার্টফোন।

ছবির আমেয়া নাগরাজন এঁর সৌজন্যে।

জিম্বাবুয়েবাসী বিশেষ করে মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং সাম্প্রতিককালে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে লক্ষ্য করে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অধিকার দমনমূলক পরিবেশে বাস করে। আইনটি এই ধরনের দমন-পীড়নের একটি প্রধান হাতিয়ার এবং অজনপ্রিয় নীতি ও রাজনীতির বিরুদ্ধে বৈধ ভিন্নমতকে দুর্বল করার জন্যে আইনটি পাস করা হয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি এমারসন ম্নাঙ্গাগওয়া ডেটা সুরক্ষা আইন (অধ্যায় ১১:২২) আইনে স্বাক্ষর করেছেন। সমালোচকরা যুক্তি দেখিয়েছে যে নাগরিকদের ডিজিটাল অধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমত দমন করার জন্যে নাগরিকদের অনলাইন স্থানে আইনত অনুপ্রবেশ করার জন্যে এই আইনটি সরকারের একটি চালাকি।

দুর্ভাগ্যবশত এই আইন ইন্টারনেট বন্ধ করা নিষিদ্ধ করে না এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অন্যান্য স্বাধীনতা বন্ধ করতে অতীতে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিরোধীদলীয় পরিবর্তনের জন্যে নাগরিক জোট (সিসিসি) এর নেতা নেলসন চামিসা রাজধানী হারারেতে তার প্রথম নির্বাচনী সমাবেশে হাজার হাজার সমর্থককে আকৃষ্টকারী সমাবেশটির লাইভ স্ট্রিমিং করার সময় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ইন্টারনেট পরিষেবাগুলির বিঘ্নের কথা ইন্টারনেট পর্যবেক্ষক নেটব্লকস জানিয়েছে। এই কভারেজ বন্ধ একটি নতুন বিরোধী দলের অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্ভাব্য ভোটারদের জ্ঞান সীমিত করার মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে উপকৃত করবে। সিসিসি ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল জানু-পিএফ (জিম্বাবুয়ে আফ্রিকীয় জাতীয় ইউনিয়ন- দেশপ্রেমিক ফ্রন্ট) এর বিরোধিতা করছে।

এইভাবে ২০২২ সাল নির্বাচনী চ্যালেঞ্জের প্রতি সরকারি প্রতিক্রিয়া এবং সক্রীয় কর্মী, বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ ও স্বাধীন গণমাধ্যম দমন করতে ইন্টারনেট বন্ধ ও আইনের ব্যবহার করা হবে কিনা তা নিরীক্ষণের যথেষ্ট সুযোগ দেবে।

একটি আইনি খড়গ

মুগাবের ৩০ বছরের শাসনের অবসান জিম্বাবুয়ের জন্যে একটি নতুন যুগের সূচনা করার কথা থাকলেও দেশটি জনপ্রিয়তাপন্থী এবং সামরিক সমর্থিত একনায়ক শাসনে্র দিকে পশ্চাদপসরণ করেছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে মুগাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার উত্তরসূরি এমারসন ম্নাঙ্গাগওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্যে চাপ দিলেও সেটা তো ঘটেনি বরং ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ক্রমাগত অধিকার লঙ্ঘনের উদ্ধৃতি দিয়ে ম্নাঙ্গাগওয়া প্রশাসনের বিরুদ্ধে এক দশকের পুরনো নিষেধাজ্ঞাটি সম্প্রসারিত করেছে।

“রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং অন্যান্য সরকার সমালোচকদের ভীতি প্রদর্শন গণতান্ত্রিক ও নাগরিক স্থানকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। ডেটা সুরক্ষা আইন এবং বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সংশোধনী খসড়া আইন এবং দেশপ্রেমিক আইনের মতো চলমান আইনী প্রক্রিয়ার কারণে সেই সীমাবদ্ধ স্থানটি আরো সঙ্কোচনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলোর বিকাশ নিয়ে ইইউ উদ্বিগ্ন,” একটি বিবৃতিতে ইইউ বলেছে।

ডেটা সুরক্ষা আইন: দাসত্ব নাকি সুরক্ষা?

ডেটা সুরক্ষা আইন জিম্বাবুয়েতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দমন করার জন্যে ব্যবহৃত আইনগুলোর একটি হলেও এই স্বাধীনতাগুলি জিম্বাবুয়ের সংবিধানের ৬১ ধারায় নিশ্চিত করা হয়েছে। সমালোচকরা মনে করে ডেটা সুরক্ষা আইনটিতে জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষা এবং সাধারণ ব্যক্তির অধিকার প্রয়োগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। এটি আইনের তিনটি বিধান: ফৌজদারি আইন (সংহিতা ও সংস্কার আইন) (অধ্যায় ৯:২৩), ফৌজদারি কার্যবিধি এবং প্রমাণ আইন (অধ্যায় ৯:০৭) এবং যোগাযোগ আইন (অধ্যায় ১১:২০) সংশোধন করে।

আইনটির ১৬৪(গ) ধারা অনলাইনে “মিথ্যা” হিসেবে সরকারিভাবে শ্রেণীবদ্ধ তথ্যের বিস্তারকে অপরাধী করে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করে।

ফেব্রুয়ারির শুরুতে মানবাধিকার আইনজীবী মিশেক মারাভা একটি ইমেল ও টেলিফোন সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন যে এই আইনটি তার উল্লিখিত মিথ্যার যোগ্য বর্ণনা বা সংজ্ঞা দেয় না, সেখানে ব্যাখ্যার বিস্তৃত জায়গা রয়েছে এবং এর অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে।

“অন্য কথায় এই বিধানটি ফৌজদারি মানহানিরই ভিন্ন নামকরণ। জিম্বাবুয়ে ফৌজদারি মানহানিকে বেআইনি ঘোষণা করলেও জাতিকে অবাক করে দিয়ে এই বিশেষ বিধান এটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে,” মারাভা বলেছেন।

তিনি উল্লেখ করেন যে ডেটা সুরক্ষা আইন হিসেবে এই আইনটির কোন কাজ না থাকলেও এটি বরং রাষ্ট্রকে রক্ষার একটি হাতিয়ার – একটি সাইবার-অপরাধের হাতিয়ার – হয়ে উঠেছে।

মারাভা মনে করেন রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার স্বার্থের মাধ্যমে ডেটা সুরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে আইনের খসড়া তৈরির মূল উদ্দেশ্যটি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন আইনটি সহজেই সহিংসতার উসকানি বা ক্ষতিকর মিথ্যা হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারবিরোধী অনুভূতি প্রকাশের বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার হতে পারে।

আইনটির ১২ ধারা একজন নাগরিকের জেনেটিক, বায়োমেট্রিক এবং স্বাস্থ্য ডেটা প্রক্রিয়াকরণে লিখিতভাবে সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে। তবে “জাতীয় নিরাপত্তা আইনের সাথে সঙ্গতি বিধান বা… যথার্থ জনস্বার্থের কারণে প্রক্রিয়াকরণের প্রয়োজনীয়তার” ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।

একই মাসে অন্য একটি সাক্ষাৎকারে মানবাধিকার আইনজীবী কেলভিন কাবায়া গ্লোবাল ভয়েসেসকে ইমেলের মাধ্যমে বলেছেন এই বিধানটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না।

“অনুচ্ছেদটির বিধানটি এমন বিস্তৃতভাবে সাজানো হয়েছে যে এটি অপব্যবহৃত হতে সক্ষম। বৃহত্তর স্বার্থের মতো বাক্যাংশগুলির সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই। অস্পষ্ট এবং গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে বলে এই বিধানটি সাংবিধানিক লড়াইকে ব্যর্থ করতে পারে।”

আইনটি একটি ডেটা সুরক্ষা কর্তৃপক্ষকেও পর্দাফাঁসকারী ব্যবস্থা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণের নিয়ম প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়। কাবায়ার হিসেবে এই বিধানটি বৈধ সাংবাদিকতার কাজ এবং দুর্নীতির পর্দাফাঁসকারীদের আটকাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ২০২০ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিক হোপওয়েল চিন'ওনো কোভিড-১৯ তহবিল ব্যবহারের দুর্নীতি প্রকাশ করায় প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওবাদিয়া ময়োকে বরখাস্ত করা হয়। চিনওনোকে পরবর্তীতে সহিংসতা প্ররোচনার অভিযোগে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে গ্রেপ্তার করা হয়

যেভাবে অনুপ্রবেশকারী এনজিওদের আটকানো যায়

আরেকটি বিতর্কিত আইন হলো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (পিভিও) আইনের সংশোধন (অধ্যায় ১৭:০৫)। গত মাসে বিতর্কিত গণশুনানির মধ্য যাওয়া বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন তোলা জনগণের অভিযোগে কলঙ্কিত, খসড়া আইনটি নিয়ে এখন সংসদে আলোচনা করা হচ্ছে। সরকারের ন্যায্যতার মূল বর্ণনাটি হলো অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং এনজিওদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ রোধ করার জন্যে পদক্ষেপের প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি চুক্তি বহির্ভূত আন্তঃসরকারি সংস্থা – আর্থিক অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)। এটি জিম্বাবুয়েতে অসংখ্য মৌলিক অধিকারের চর্চাকে বাধা প্রদান করবে বলে অন্তত চারজন জাতিসংঘের (ইউএন) বিশেষ দূত প্রস্তাবিত পিভিও সংশোধনী বিল অনুমোদনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি ম্নাঙ্গাগোয়াকে সতর্ক করেছে।

অন্যান্য কঠোর বিধানগুলির মধ্যে সংশোধনীটি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে ট্রাস্টি হিসেবে একটি মনোনীত পিভিও’র বিষয়গুলি পরিচালনার জন্যে তার নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ করার জন্যে উচ্চ আদালতে আবেদন করার ক্ষমতা দেয়৷

কাবায়া উল্লেখ করেছেন বর্তমান অবস্থায় পিভিও খসড়া আইনটি নাগরিক স্থান বন্ধ করার হুমকি দেয় এবং এফএটিএফ সুপারিশের প্রয়োজনীয়তা পূরণ না করে বৈধ নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলির (সিএসও) কাজের ক্ষেত্রে একটি অস্তিত্বের হুমকি সৃষ্টি করেছে।

“উদাহরণস্বরূপ খসড়া আইনটিতে ঝুঁকিপূর্ণ এনপিও [অলাভজনক সংস্থা] নির্ধারণে সিএসওদের জড়িত থাকার কোনো বিধান নেই। এই প্রক্রিয়ায় সিএসও’র সম্পৃক্ততা এফএটিএফের মৌলিক সুপারিশগুলির মধ্যে একটি। খসড়া আইনটি মোটা দাগে সকল সিএসওকে উচ্চ ঝুঁকি বিবেচনা করে বলে মনে হচ্ছে। স্পষ্টতই এটা এফএটিএফ সুপারিশগুলির উদ্দেশ্য নয়,” কাবায়া বলেছেন।

এই আইনের সফল প্রবর্তন বছরের পর বছর ধরে সিএসওদেরকে জিম্বাবুয়েতে শাসন পরবর্তনের একটি পশ্চিমা এজেন্ডা উপস্থাপনের জন্যে অভিযুক্তকারী ক্ষমতাসীন দল জানু-পিএফ এর জন্যে একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ট্রাম্প কার্ড হতে পারে।

কাবায়া ব্যাখ্যা করেছেন এই সংশোধনগুলি ডিজিটাল অধিকারের সাথে জড়িত সিএসওদের কাজের সুবিধাভোগী জিম্বাবুয়ের নাগরিকদের প্রভাবিত করতে পারে এবং কিছু কিছু ডিজিটাল অধিকার সিএসও আসলে বন্ধ হয়ে যাবে বলে ডিজিটাল অধিকারে তথ্যের ব্যবধান আরো বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই দমন-পীড়ন সরকারি বিধানগুলিকে কার্যকর করে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল অধিকারের টুঁটি চেপে ধরে জিম্বাবুয়েতে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদকে সক্রিয় করে চলেছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .