প্রযুক্তি: মিয়ানমারের বিপ্লবের সমস্যা নাকি সমাধান?

হ্যাউই এর তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটি অত্যাচারী সামরিক জান্তার শাসনে থাকাকালীন মিয়ানমারকে দীর্ঘকাল ধরে একটি সমাজচ্যুত রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হতো। ২০১১ সালে গণতন্ত্রীকরণের জন্যে উন্মুক্ত দেশটিতে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনটি ছিল একটি মোড় ঘোরানোর বিষয়। বেসামরিক সরকারের নেতৃত্বে ২০০৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশের দারিদ্র্য ৪৮ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে আসে। সে সময়ের নেত্রী অং সান সু কি তার মন্ত্রিসভার প্রথম মেয়াদ ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের গণতন্ত্রীকরণের নেতৃত্ব দেন। তবে অং সান সু কির গণতন্ত্রের জন্যে জাতীয় লীগ (এনএলডি) ২০২০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের মাধ্যমে জয়ী হওয়ার ঠিক পরে ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে গণতন্ত্রীকরণের আশাবাদ ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার আগেই রাষ্ট্রপতি ইউ উইন মিন্ট এবং স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু কিসহ এনএলডির বেশিরভাগ নেতাকে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক বাহিনী কারাগারে নিক্ষেপ করে।

কিন্তু গণতন্ত্র ইন্টারনেট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়নি। মিয়ানমার ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে জনসাধারণের জন্যে ইন্টারনেট খুলে দেওয়ার পর থেকেই তার ডিজিটাল স্থানগুলিতে নজরদারি ও সেন্সরের মুখোমুখি হয়। ২০০৭ সালে জাফরান বিপ্লবের পরে ইন্টারনেট বন্ধ, ওয়েবসাইট সেন্সর এবং ফোনে আঁড়িপাতার মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে প্রবেশযোগ্য ইন্টারনেট সীমিত করা হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের আগে এনএলডি নেতৃত্বাধীন সরকার রাখাইন এবং চিন রাজ্যে যে ২০-মাস-ব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ ঘোষণা করে সেটা বিশ্বের দীর্ঘতম ইন্টারনেট বন্ধগুলির মধ্যে একটি।

২০১৭ সালে পরিবহন ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় মিয়ানমারে সামাজিক গণমাধ্যমের ব্যবহার নিরীক্ষণের জন্যে সামাজিক গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ দল গঠন করতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের বিশেষ তহবিল থেকে গোপণে ৬০ লক্ষ ডলার (প্রায় ৫২ কোটি টাকা) খরচ করে। তবে সরকার এই ৬০ লক্ষ ডলারের প্রকল্প সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করেনি এবং এটি জনগণের কাছে একটি রহস্যই রয়ে গেছে।

সামরিক বাহিনীর নজরদারির কৌশলটি সামগ্রিকভাবে পুরো তথ্যের ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগের দিকে ধাবিত হয়েছে। অভ্যুত্থানের পরপরই, সামরিক বাহিনী সারা ইন্টারনেট বন্ধের চর্চা শুরু করে, তারপরে রাতে ইন্টারনেট বন্ধ, এবং তারপর অবকাঠামো ভিত্তিক বন্ধ (শুধু এফটিটিএইচ পরিষেবা পাওয়া যায়)। অতি সম্প্রতি তারা উচ্চ যুদ্ধের তীব্রতার জায়গায় অবস্থান-ভিত্তিক বন্ধ ব্যবহার করে। ২০১৯ সালে রাখাইন ও চিন রাজ্যে ইন্টারনেট বন্ধ এবং ইন্টারনেট বন্ধ করার এক বছরের নিবিড় চর্চার পূর্ব অভিজ্ঞতা সামরিক বাহিনীকে ইন্টারনেট বন্ধ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট জ্ঞান এবং চর্চা সাম্প্রতিক বন্ধগুলিকে আরো সুনির্দিষ্ট ও নির্ভুল করে তুলেছে।

এরপর সামরিক বাহিনী সাংবাদিকদের ওপর বর্বর নৃশংসতা চালিয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে গুঁড়িয়ে দেয়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে সামরিক বাহিনী পাঁচটি প্রধান গণমাধ্যম সংস্থা: বার্মার গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, মিয়ানমার এখন, মিজিমা, খিত থিট গণমাধ্যম এবং ৭ দিনের সংবাদ মিডিয়ার লাইসেন্স প্রত্যাহার করে নেয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সোয়ে নাইংকে চার দিন নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। তিনি শুধু তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নীরব ধর্মঘটের ছবি তুলেছিলেন। এর কিছুদিন পর ২০২২ সালে বার্মা আন্তর্জাতিক সংবাদ (বিএনআই) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পুই তুইডিম এবং কেন্দ্রীয় সংবাদ জার্নালের সম্পাদক সায়ে উইন অং যথাক্রমে কেইন রাজ্যের ইয়াওয়েদি শহরতলী ও এবং চিন রাজ্যের মাতুপে শহরতলীতে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়।

গণতন্ত্রীকরণের নামে অন্যান্য দেশের দেওয়া নজরদারি প্রযুক্তিগুলি সেনাবাহিনীকে স্টেরয়েডগুলির ওপর নজরদারিতে সক্ষম করে তোলে। মিয়ানমারের জন্যে ন্যায়বিচার সামরিক বাহিনীকে নজরদারি সরঞ্জাম এবং পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থাগুলির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সামাজিক গণমাধ্যম নজরদারি এবং যন্ত্রপাতি নিরীক্ষণের জন্যে সামরিক বাহিনী এমএসএবি (সুইডেন), মুক্ত পাঠ্য (কানাডা), কালোথলে/ সেলেব্রাইট (ইউএসএ/ ইসরায়েল) থেকে আনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। পুলিশি যোগাযোগের জন্যে লুমেক্স যন্ত্রপাতি (কানাডা), মিডিয়ান ইলেকট্রনিক্স (যুক্তরাষ্ট্র), হাইতেরা (চীন) এবং আইকম (জাপান) এর প্রযুক্তি আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেটাওয়াক এবং ভিএমওয়্যার থেকে আনা সফ্টওয়্যার বড় বড় ডেটা এবং পুলিশের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা চালু রাখে।

সামরিক বাহিনীর তৈরি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পর্ষদ (এসএসি) ইন্টারনেটের উপর ক্ষমতা প্রয়োগের জন্যে একাধিক আইনি কারসাজি এবং অপব্যবহার আরোপ করেছে। প্রথমত এটি অনলাইন সমাবেশকে অপরাধী করতে ভিপিএন ব্যবহারকে শাস্তিযোগ্য এবং ব্যবহারকারীর ডেটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পূর্বে অনুমোদন না পাওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইনটিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক অনলাইন গণমাধ্যম সংস্থাগুলিকে নিপীড়নের জন্যে সম্প্রচার আইনটিকেও সংশোধন করা হয়। টেলিযোগাযোগ থেকে সরকারি ডেটা অনুরোধের আইনগত বিধিনিষেধ এবং সীমাবদ্ধতা দূর করতে গোপনীয়তা্র আইনটিও সংশোধন করা হয়। সামাজিক গণমাধ্যমে সামরিক বাহিনী এবং এসএসি-এর সমালোচনামূলক কোন বিষয়বস্তু পোস্ট এবং ভাগাভাগি করার কার্যকলাপকে আইনত অপরাধী করার জন্যে মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে ব্যবহৃত কুখ্যাত ইলেকট্রনিক লেনদেন আইনকেও সংশোধন করা হয়।

সামরিক বাহিনী এবং এর সহযোগীরা টেলিযোগাযোগ বাজার একচেটিয়া করার চেষ্টা করছে। ২১ জানুয়ারি, ২০২২ তারিখে রয়টার্স জানিয়েছে এসএসি যৌথভাবে সামরিক-সমর্থিত শ্বে বায়াইন ফিউ কোম্পানি এবং লেবানন ভিত্তিক এম১ গোষ্ঠীর টেলিনর মিয়ানমারের অধিগ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে। মিয়ানমারে চারটি প্রধান টেলিযোগাযোগ অপারেটর রয়েছে: মিয়ানমার ডাক ও টেলিযোগাযোগ (এমপিটি), মাইটেল, টেলিনর এবং ওরেদু। এমপিটি যৌথভাবে সরকারি মালিকানাধীন এবং মাইটেল শুধু সামরিক মালিকানাধীন; এখন তারা টেলিনরকে অধিগ্রহণ করার চেষ্টা করার ফলে দেশের একমাত্র অ-সামরিক/ বেসরকারি অপারেটর হিসেবে ওরেদুই রইলো। টেলিনর কীভাবে এক কোটি ৮০ লক্ষ ব্যবহারকারীর ডেটা স্থানান্তর পরিচালনা করবে সে বিষয়ে স্বচ্ছতার জন্যে অনুরোধ করে ৬৯৪টি সুশীল সমাজ সংস্থার একটি আবেদনে স্বাক্ষরসহ মিয়ানমারের জনগণ নরওয়ের কোম্পানি টেলিনরের বিরুদ্ধে একটি ডেটা সুরক্ষা অভিযোগ দায়ের করেছে। তবে অধিগ্রহণটি সফল হলে টেলিযোগাযোগ খাতের ৭৫ শতাংশ সামরিক এবং এর সহযোগীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। অন্যদিকে মিয়ানমারে “দুর্নীতির শেকড়, অপব্যবহারের সীমারেখা”র জ্ন্যে ন্যায় এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সেনাবাহিনীর বর্ণালী পর্যবেক্ষণ পরিচালনার ক্ষমতা থাকায় এটি ইন্টারনেটসহ ডিজিটাল নিপীড়ন প্রতিরোধ করার জন্যে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টারত জনগণকে অনুসরণকারী অন্যান্য বেতার যোগাযোগের উপরও নজরদারি করার সুযোগ দেয়। টেলিযোগাযোগ খাতের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ এবং বর্ণালী পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার সমন্বয় সেনাবাহিনীর নজরদারি ক্ষমতাকে আকাশচুম্বী করবে।

সামরিক বাহিনী ইন্টারনেটের দাম বাড়িয়ে প্রবেশযোগ্যতার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। ৬ জানুয়ারি, ২০২২ তারিখে এসএসি ইউনিয়ন ট্যাক্স আইন সংশোধন করে ” ইউনিয়ন ট্যাক্স আইন সংশোধন আইন ২০২১” নিয়ে আসে যা প্রতিটি সিম কার্ড চালুর জন্যে ২০,০০০ কিয়াত (৯৩১.৫২টাকা) কর ধার্য করে — আসল সিম কার্ডের দামের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি। আইনটি এছাড়াও ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের (আইএসপি) রাজস্বের উপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করে প্রচুর মূল্যবৃদ্ধি করেছে।

ভয়ানক ডিজিটাল নিপীড়ন সত্ত্বেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে জনসাধারণের সংহতি জোরদার হচ্ছে। গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলো জনসাধারণের অভ্যুত্থান-বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করার জন্যে ইন্টারনেটে এবং সামাজিক গণমাধ্যমের মঞ্চগুলিতে প্রবেশের জন্যে বিকল্প পথ ব্যবহার করছে। জন-উৎস অর্থায়িত কর্মসুচিগুলি এসএসি-এর বিরুদ্ধাচরণকারী সমান্তরাল  সরকার বা জাতীয় ঐক্যের সরকারকে সমর্থন করার একটি জনপ্রিয় উপায় হয়ে উঠেছে। গণসমাবেশ এবং স্কাউটিংয়ের অন্যতম প্রধান মঞ্চ হয়ে উঠেছে টেলিগ্রাম। সামরিক বাহিনীকে এড়াতে এবং মানচিত্র থেকে সরাতে জনতথ্যের কর্মকাণ্ডগুলি প্রকাশ্য টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলিতে সংঘটিত হচ্ছে এবং বেশ কার্যকরভাবে কাজ করছে। ঐসব পাবলিক চ্যানেলের মাধ্যমে হরতাল, পথ সমাবেশ এবং শহরতলী পর্যায়ের বিক্ষোভগুলি সংগঠিত হচ্ছে।

সমাজের ডিজিটাল প্রতিরোধ মিয়ানমারের বিপ্লবের অন্যতম নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে। ডিজিটাল দমন-পীড়নের এই দৃশ্যপটটি সাইবার জগত যে জল, স্থল এবং অন্তরীক্ষ থেকে আলাদা একটি নতুন সার্বভৌম অঞ্চল হয়ে উঠেছে তার অন্যতম একটি প্রকাশকে নির্দেশ করে। তথ্যের স্বাধীনতা, ইন্টারনেট স্বাধীনতা, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং গণমাধ্যম সাক্ষরতাকে আর স্বীকার্য বিবেচনা করা যায় না কারণ এগুলো এখন মানুষের শারীরিক ও ডিজিটাল বেঁচে থাকার উপর প্রভাব ফেলে। তাই সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে মিয়ানমারের চলমান বিপ্লব এখন আর শুধু শারীরিক নয় – বাস্তবতা হলো সঠিক উপায়ে প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগাতে পারার মতো যে কেউ বিপ্লবের খেলা বদলের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।


পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো খবর পেতে অনুগ্রহ করে প্রকল্পটির পাতা দেখুন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .