- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

চিলির শেষ ইয়াগানভাষীর উত্তরাধিকার বেঁচে আছে

বিষয়বস্তু: ল্যাটিন আমেরিকা, চিলি, আদিবাসী, নাগরিক মাধ্যম, ভাষা, লিঙ্গ ও নারী, রাইজিং ভয়েসেস

ক্রিস্টিনা ক্যাল্ডেরনের ছবি। তার নাতনী ক্রিস্টিনা জারাগার অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে ৯৩ বছর বয়সে মৃত আবুয়েলা ক্রিস্টিনা ক্যাল্ডেরন ছিলেন চিলির দক্ষিণতম প্রান্তে নাভারিনো দ্বীপের পুয়ের্তো উইলিয়ামসের বাহিয়া মেজিলোনেসের আদিবাসী ইয়াগান সম্প্রদায়ের প্রিয় একজন৷ (ইয়াগান সম্প্রদায়ের কাছে “ইয়াগানকুটা” এবং বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে “ইয়ামানা” নামে পরিচিত) ইয়াগান ভাষায় কথাবলা শেষ পরিচিত বক্তা হিসেবে তিনি বিশ্বে ইয়াগান পূর্বপুরুষদের সর্বশেষ জীবন্ত সংযোগগুলির মধ্যে একটির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তাকে আদর করে আবুয়েলা ক্রিস্টিনা (দাদী ক্রিস্টিনা) বলা হতো।

একটি ভাষা সাংস্কৃতিক অংশীজনদের চোখের মাধ্যমে মানব অভিজ্ঞতার গভীরতা বোঝার একটি পথের প্রতিনিধিত্ব করে। এর ক্ষতির অর্থ হলো একটি ভাষা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হওয়ার সংযোগটি ভেঙ্গে গেছে। ভাষাতে ধারণকৃত জ্ঞান নথিভুক্ত না হলে তা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্যে সম্প্রদায়টি পাবে না। ক্যালডেরন তার মৃত্যুর আগে বই এবং অন্যান্য সংস্থানগুলির মাধ্যমে তার ভাষার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন।

ক্যালডেরনের বাবা-মা শারীরিক পরীক্ষা এবং বেঁচে থাকার কৌশল শেখার মাধ্যমে ছেলে ও মেয়েরা তাদের সম্প্রদায়ের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য হিসেবে জীবনের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার একটি প্রাচীন আধ্যাত্মিক অনুশীলন সিয়াক্সাউস নামে পরিচিত ইয়াগান ঐতিহ্যবাহী বয়সন্ধিকালের দীক্ষার আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সর্বশেষ প্রজন্মের অংশ। ক্যালডেরন সারাজীবন ধরে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের ইয়াগান অঞ্চলের চলমান উপনিবেশায়নের পাশাপাশি মিশনের মাধ্যমে তার লোকেদের সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ, ঐতিহ্যবাহী ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুতি এবং যাযাবর জীবনধারার বিরুদ্ধে বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট প্রচণ্ড বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছেন।

ক্রিস্টিনা ক্যাল্ডেরন। প্রকাশ্য ডোমেইনে [1]র ছবি

ইয়াগানরা তাদের ভাষায় ওনাসাকা নামে পরিচিত দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে দক্ষিণাঞ্চল টিয়েররা দেল ফুয়েগো (আগুনের জমি) এলাকার আদিবাসী। ১০,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইয়াগান জনগণ এই অঞ্চলটি ব্যপ্ত করে আছে। তাদের ভাষা এই মাটি, সমুদ্র এবং এর সমস্ত প্রজাতির সাথে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে।

তার নাতনি ক্রিস্টিনা জারাগার ল্যাংস্কেপ ম্যাগাজিনের প্রবন্ধ [2] অনুসারে শুধু ইয়াগান ভাষায় কথা বলে বড় হয়ে ওঠা ক্যালডেরন ৯ বছর বয়সে এসে কাছাকাছি কথিত কিছু স্প্যানিশ, ইংরেজি এবং অন্যান্য আদিবাসী ভাষা শিখতে শুরু করেন। তিনি চিলি এবং আর্জেন্টিনার সীমান্ত দিয়ে এই অঞ্চলটিকে দুটি ভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রে বিভক্ত করার আগে টিয়েরা দেল ফুয়েগোতে নৌকায় করে অনেক জায়গায় ভ্রমণের মাধ্যমে প্রকৃতির কাছাকাছি বেড়ে ওঠার সময় আধা-যাযাবর জীবনযাপন করেতেন। অল্প বয়সে অনাথ ক্যালডেরন তার আত্মীয়-স্বজন ও ধর্মমাতার মাধ্যমে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক ইয়াগানের মতো ক্যালডেরনের বাবা-মাও মারা গিয়েছিল।

তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের কৌশলগুলির মধ্যে রয়েছে গ্রীষ্মকালে ভেড়ার পশম কাটা এবং বছরের অন্য সময়ে গুয়ানাকো এবং ভোঁদরের মতো স্থানীয় প্রাণী শিকার করা। ক্যালডেরন শিকার করা এবং ঐতিহ্যবাহী ইয়াগান অঞ্চলে নৌকায় অবাধে ভ্রমণ করার মতো অনেক স্বাধীনতা উপভোগ করলেও অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে তার পরিবার তাকে ১৫ বছর বয়সে একজন অনেক বেশি বয়স্ক পুরুষকে বিয়ে করতে উৎসাহিত করে। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে দারিদ্র্য, বাস্তুচ্যুতি এবং অনেক সামাজিক পরিবর্তন সহ্য করেন। তিনি ঝুড়ি বুননে দক্ষতা লাভ করেন এবং এর জন্যে স্বীকৃতি লাভ করেন। তার জীবনের শেষ দিকে, বিশেষ করে ইয়াগানে কথা বলা তার প্রিয় বোন উরসুলা ক্যালডেরনের মৃত্যুর পর তিনি তার ভাষার শেষ সাবলীল বক্তা হিসেবে ব্যাপকভাবে সম্মানিত হন।

শেষ ভাষা ব্যবহারকারী হিসেবে ক্যালডেরনের প্রভাব স্থানীয়ভাবে টিয়েরা দেল ফুয়েগো এবং বিশ্বব্যাপী অনুভূত হয়েছিল। ২০০৯ সালে চিলির সরকার তাকে জীবন্ত মহামূল্য মানব সম্পদ [3] হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তিনি ঘন ঘন মিডিয়াতে উপস্থিত হতেন এবং তার আশেপাশের জনগণের সাথে তার ভাষা ভাগাভাগি করার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ইয়াগানের মারাত্মকভাবে বিপন্নতা সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলতেন এবং ইয়াগানে অসংখ্য উপকরণ তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার রেখে যাওয়া সাহিত্য ও শিল্পের অনেক কাজই এখন এবং ভবিষ্যতে ইয়াগান পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টার জন্যে প্রাথমিক উৎসের উপাদান হয়ে উঠবে।

ক্রিস্টিনা জারাগা এবং উরসুলা ক্যালডেরনের “হাই কুর মামাশু চিস” (আমি আপনাকে একটি গল্প বলতে চাই) বইটির প্রচ্ছদ।

অলিভার ভোগেল, ইয়োরাম মেরোজ, আনা কোলে এবং অন্যান্য গবেষক ও শিল্পীদের সহযোগিতায় ক্রিস্টিনা ক্যালডেরন ও তার নাতনি ক্রিস্টিনা জারাগা তৈরি করা সচিত্র বই [4] “ইয়াগানকুটা: ইয়াগানের একটি ছোট অভিধান” পড়ার মাধ্যমে ইয়াগান ভাষার গভীরতা ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা ও শেখা যায়।

আন্তঃমহাদেশীয় অভিধান ধারাবাহিকের মাধ্যমে অনলাইনে ভাষাবিদ আনা মারিয়া গুয়েরা এইসম্যান সংকলিত ৭১৫টি ইয়াগান শব্দের একটি তালিকা [5]ও রয়েছে। মূলত চিলি এবং জার্মানি ভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা পিক্স সংস্করণ [6] প্রকাশিত “হাই কুর মামাশু চিস” (আমি আপনাকে একটি গল্প বলতে চাই) শিরোনামে জাররাগার কাছে ক্রিস্টিনা ক্যালডেরন ও তার বোন উরসুলা ক্যালডেরন বর্ণিত ইয়াগান লোককাহিনীর একটি বই অ্যামাজনে [7] পাওয়া যায়। এছাড়াও ক্রিস্টিনা জাররাগা “মেমোরিয়াস দে মি আবুয়েলা ইয়াগান” (আমার ইয়াগান দাদির স্মৃতি) শিরোনামের বইয়ে তার দাদীর স্পেনীয় ভাষায় জীবনী [8] লিখেছেন।

ক্যালডেরনের চলে যাওয়া একটি বিশাল ক্ষতির প্রতিনিধিত্ব করে। ইয়াগানকুটার শেষ কথক এবং ঐতিহ্যবাহী ইয়াগান জীবনযাপণের শেষ সাক্ষীদের একজন হিসেবে সংস্কৃতিকে এমনভাবে প্রকাশ করার সাবলীলতা ও জ্ঞান আজ আর কারো মধ্যে নেই।

তবুও তার নাতনি ক্রিস্টিনা জাররাগা ​​সম্প্রতি চিলির ম্যাগাজিন পৌস্তা [9]কে একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে ক্যালডেরন নিজেকে শেষ ইয়াগান ব্যক্তি হিসেবে দেখতে চান না। “আমিই একমাত্র বা শেষও নই। চারিদিকে তাকালে ইয়াগানে পরিপূর্ণ দেখতে পাবেন,” তার সম্প্রদায়ে ইয়াগান উত্তরসূরীদের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন। তিনি শেষ ইয়াগানভাষী হলেও শেষ ইয়াগান নন।

ক্রিস্টিনা ক্যাল্ডেরনের “আমার ইয়াগান দাদির স্মৃতি” বইয়ের উদ্বোধন (সিসি বাই-এনসি-এসএ ২.০ [10])

ভাষা শিক্ষার্থীদের সাথে জুম মিটিং করে জাররাগা এখন তৃণমূল থেকে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি ইয়াগান ভাষা ভাগাভাগি করার চেষ্টা করছে। চিলির নাভারিনো দ্বীপের বাহিয়া মেজিলোনেসে বসবাসকারী তার অন্যান্য আত্মীয়রা বিভিন্ন রূপে তাদের সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখে [11] এবং তারা চিলির আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সক্রিয়।

নতুন ভাষাভাষী ও ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের শেখার জন্যে প্রচুর উপাদান থাকার জন্যে ক্যালডেরনের উত্তরাধিকারকে ধন্যবাদ। এগুলোর মাধ্যমেই তার দাদীর উত্তরাধিকার বেঁচে থাকবে।