- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ভারতীয় বিচার বিভাগ

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, ভারত, আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম, নাগরিক মাধ্যম, প্রযুক্তি, বাক স্বাধীনতা, ব্যবসা ও অর্থনীতি, মানবাধিকার, সরকার, সেন্সরশিপ, জিভি এডভোকেসী
Illustration by Moshtari Hilal. Via Unbias The News. Used with permission. [1]

মোশতারী হিলাল চিত্রিত। পক্ষপাতহীন সংবাদে [1]র মাধ্যমে পাওয়া। অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

এই নিবন্ধটি মূলত অঙ্কিতা আনন্দ লিখেছেন এবং পক্ষপাতহীন সংবাদে [1] প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়বস্তু ভাগাভাগি করার একটি অংশ হিসেবে গ্লোবাল ভয়েসেস এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ পুনঃপ্রকাশ করেছে।

ভারতীয় সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদ প্রতিটি নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত [2] করে। কিন্তু সাংবিধানিক এই নিশ্চয়তা সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমের প্রতি হুমকি অব্যাহত রয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারত ১৮০-এর মধ্যে ১৪২ নম্বরে স্থান নিয়েছে [3]। অনেক মহল থেকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্যে হুমকি আসতে পারে: সেগুলি রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়িকদের হতে পারে; এগুলো পুলিশ মামলার আকারে বা কোটি কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানহানির মামলা হিসেবেও আসতে পারে।

সাংবাদিকদের অন্যায়ভাবে মানহানি [4], রাষ্ট্রদ্রোহ [5], ভুয়া সংবাদ [6] প্রকাশ এবং “বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্যে ক্ষতিকর কাজ করার” অভিযোগ আনা হয়ে থাকে৷ প্রায়শই অভিযোগগুলি শেষ পর্যন্ত অপ্রমাণিত হলেও আটক, জিজ্ঞাসাবাদ এবং অভিযানের মতো দিকগুলির পাশাপাশি এমনকি প্রক্রিয়াটিও শাস্তিতে পরিণত হয়।

সংঘাতপূর্ণ এলাকায় এই সমস্যাগুলো বহুগুণ বেড়ে যায়। কাশ্মীরের একজন সাংবাদিক সাফিনা নবী ভাগাভাগি করেছেন: “আগে কিছু নম্রতা ছিল। সবাই জানতো আমরা সাংবাদিক এবং আমাদের নিজেদের কাজ করার কথা। আমাদেরকে সংবেদনশীল জায়গাগুলোতে ঘোরাঘুরি করতে দেওয়া হতো। ২০১৯-এ [রাজ্যটিকে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে [7] দেওয়া বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার] পরে পুরো দৃশ্যপট বদলে যায়।”

এসব দেখে মনে হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার লড়াই শুরু থেকেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু গণমাধ্যম হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে মনে রাখতে হবে যে কয়েক বছর ধরে ভারতে গণমাধ্যম ব্যক্তিদেরও বিজয় হয়েছে। এক্ষেত্রে আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করলেও একাধিক মামলায় এটি বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকারকে সমুন্নত রেখেছে।

ছাপার উপর নিষেধাজ্ঞা সংবাদমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞার সমান

১৯৭২ সালের দিকে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ঘোষণা করেছিল [8]:

এটা অনস্বীকার্য যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে সকল নাগরিকের কথা বলার, প্রকাশ করার এবং তাদের মতামত প্রকাশের অধিকারকে বোঝায়। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মানুষের পড়ার অধিকারকে মূর্ত করে।

প্রসঙ্গ [9]টি ছিল গণমাধ্যম গোষ্ঠী বেনেট কোলম্যান অ্যান্ড কোং নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে সরকারের সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করে। মামলাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতে রাষ্ট্রপতির মৌলিক অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতাসহ জরুরি অবস্থা [10] জারি ছিল। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার জরুরি অবস্থা জারি করার পর সংবাদপত্রের সেন্সরের সম্মুখীন হলে দেশটি একই রকম পরিস্থিতিতে [11] পড়ে।

যুগান্তকারী রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে আইনজীবী-গবেষক প্রবিতা কাশ্যপ মন্তব্য করেন [8]:

একটা তীব্র নিপীড়ন বা নিপীড়ন প্রচেষ্টার সময় – এই রায়টা – সত্য সত্যই সংবাদমাধ্যমের অধিকারকে সমুন্নত রেখে বলেছিল যে এটা আমাদের সমাজের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর উপর বিধিনিষেধগুলি সংবিধানের লঙ্ঘনকারী।

Press Freedom. Illustration via Wikimedia Commons by The-movement-2000. CC BY-SA 4.0. [12]

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা [12]। উইকিমিডিয়া সাধারণের মাধ্যমে পাওয়া আন্দোলন-২০০০ [13] এর অলংকরণ। সিসি বাই-এসএ ৪.০ [14]

সংবাদমাধ্যমের পক্ষে অন্যান্য আদালতের রায় বাতিল করা

কখনো কখনো এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে উচ্চতর বিচার বিভাগ নিম্ন আদালতের রায়গুলিকে উল্টে দিতে বাধ্য হয়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে একটি নগর দেওয়ানি আদালত চল্লিশটিরও বেশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা দলে [15]র একজন সদস্য সম্পর্কে কথিত মানহানিকর বিবৃতি প্রকাশ করা থেকে বিরত করেছিল [16]

কিন্তু কর্ণাটক রাজ্যের উচ্চ আদালত বিপরীত [17] দিকে গিয়ে ভোটারদের তাদের প্রার্থীদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়ার অধিকারকে জোরদার করেছে। দুই বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চটি বলেছে [17]:

বিবাদী পক্ষকে (গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলি) তাদের মতে মানহানিকর নয় এমন কোন সংবাদ প্রকাশ বা সম্প্রচারে বাধা দেওয়া হয় না। বাদী (তেজস্বী সূর্য) এই ধরনের কোনো প্রকাশনা বা কোনো সংবাদের সম্প্রচারে সংক্ষুব্ধ হলে তিনি ভারতের নির্বাচন কমিশনে [18]র কাছে যেতে পারেন।

“চাঞ্চল্যকর” হওয়ায় গণমাধ্যমকে একটি মামলার প্রতিবেদন না করতে করতে বলা নিম্ন আদালতের ২০১৭ সালের একটি আদেশ প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে বোম্বে উচ্চ আদালত ২০১৮ সালে জনস্বার্থের উপর জোর দিয়েছিল [19]

“জনগণের তাদের সরকারকে ভয় পাওয়া উচিত নয়। সরকারেরই তাদের জনগণের ভয়ে থাকা উচিত।”

নীতিমালা . . . দেখায় একজন নাগরিকের সরকার এবং এর কর্মীদের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা বা মন্তব্য করার অধিকার রয়েছে . . .

এই মন্তব্য [20]টি ২০২১ সালের জুনে জারি করা ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের অংশ ছিল যাতে বলা হয়েছিল যে সরকারের সমালোচনা করার জন্যে কোন সাংবাদিককে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান, সুদান, সেনেগাল এবং তুরস্কেও রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এখনো বিদ্যমান [21]। ঔপনিবেশিককালে যুক্তরাজ্য ভারতে এই আইন নিয়ে এলেও স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো তারাও এটি বাদ দিয়েছে [22]

দুটি টেলিভিশন চ্যানেল পুলিশের দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় সর্বোচ্চ আদালত গণমাধ্যমের পক্ষে দাঁড়িয়ে ২০২১ সালের মে মাসে বলেছিল [23]: “এখন আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহের সীমা নির্ধারণ করার সময় এসেছে।” বিচারকরা আরোপিত অভিযোগকে “গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করার” প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছিলেন।

ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি [24]র অধীনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক [25] সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন দেখার সময় এই জাতীয় রায়গুলি মহামারী চলাকালীন সাংবাদিকদের অধিকারকে শক্তিশালী করেছিল। কোভিড-১৯-এর সময় প্রতিষ্ঠানের অপরাধের বিষয়ে প্রতিবেদন করার জন্যে সংবাদমাধ্যমকে আইনি, মৌখিক এবং শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছিল।

একটি প্রকাশনা আরেকটি প্রকাশনাকে আক্রমণ [26] করার সময়েও বিচার বিভাগ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে রক্ষা করেছে। ভারতের একটি নেতৃস্থানীয় গণমাধ্যম গোষ্ঠী দৈনিক জাগরণ “দৈনিক জাগরণের বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনে প্রয়াগরাজে গণদাফন কোভিডের কারণে বেড়ে যায়নি” নিবন্ধ [27]টি প্রকাশ করার জন্যে তথ্য-পরীক্ষাকারী সংস্থা অল্ট নিউজকে আক্রমণ করে [28]। ২০২১ সালের নভেম্বরে আদালত প্রকাশ করেছে [29]:

এই ধরনের ক্ষেত্রে . . . প্রাথমিক পর্যায়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করার এবং উচ্চ আদালতের দ্বারা বিকশিত বাকস্বাধীনতার নিরন্তর প্রসারিত রূপকে শ্বাসরুদ্ধ করার কোন কারণ নেই। বিষয়বস্তু বৃহত্তর জনসাধারণের উদ্বেগের বিষয় হলেবাকস্বাধীনতা আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

উৎস সুরক্ষা

সংবাদমাধ্যমের সুরক্ষা শুধু সাংবাদিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এতে গল্প পেতে সাহায্য করা সেই সূত্রগুলিও অন্তর্ভুক্ত। ২০২১ সালের অক্টোবরে গোয়েন্দা সরঞ্জাম পেগাসাসে [30]র বিষয়ে আদালত বলেছিল:

সাংবাদিকতার উৎসের সুরক্ষা [31] সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অন্যতম মৌলিক শর্ত। এই ধরনের সুরক্ষা ছাড়া উৎসগুলি জনস্বার্থের বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিত করতে সংবাদমাধ্যমকে সহায়তা করা থেকে বিরত রাখতেপারে।

আদালত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সাথে গোপনীয়তার উদ্বেগকেও যুক্ত করেছে।

একটি দায়িত্ব যখন অন্যটিকে বাধা দেয়

এছাড়াও একটি গণমাধ্যম গোষ্ঠী বা প্রকাশনা চালানোর সুবিধা — এবং মূল্য —একটি দেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন তা নির্ধারণ করে৷ শীর্ষ আদালত ১৯৮৫ সালে এটি বিবেচনায় নিয়ে রায় দেয় [32] প্রকাশনাগুলির উপর রাজ্যের কর ধার্য করার অধিকার থাকলেও সেগুলি অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত সীমার মধ্যে থাকতে হবে। আদালত আরো বলে: “সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধগুলির লেখকদের সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করার জন্যে তাদের পদক্ষেপের সমালোচনা করতে হয় … সরকার স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন উপায়ে এই জাতীয় নিবন্ধ প্রকাশকারী সংবাদপত্রগুলিকে দমন করার উপায় খোঁজে।”

এই দৃষ্টান্তগুলি থেকে দেখা যায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার লড়াই যতো কঠিনই হোক না কেন এমনকি সবচেয়ে কঠিন সময়েও কেউ হাল ছেড়ে দিতে পারে না কারণ, ভারতে সাংবাদিক এবং প্রকাশনার জয় রয়েছে।

উপরে উল্লিখিত আদালতের রায়গুলো প্রমাণ করে যে গণতন্ত্রকে সচল রাখতে গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করে তা বিচার বিভাগ স্বীকার করে। ভারতীয় মিডিয়াকে এই দৃষ্টান্তগুলি মনে রাখতে হবে এবং কোন একক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আক্রমণ হলে তখনই একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে। যেমন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা বলেছেন [33]:

আমাদের গুরুত্ব সহকারে একত্রিত হয়ে লড়াই করতে হবে কারণ একজনের উপর আক্রমণ মানে সবার উপর আক্রমণ . . . শক্তি প্রদর্শন এবং হুমকি-ধমকির কাছে নতিস্বীকার করলে সেগুলি কখনোই থামবে না।