ড্রোন যুদ্ধ: আন্তর্জাতিক মানবিক আইন কি প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিতে পারবে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্দা ফাঁসকারী ড্রোন বিশ্লেষকদের গল্প বলা জাতীয় পাখি চলচ্চিত্রের ট্রেইলারের জন্যে ইউটিউব চ্যানেলের পর্দাছবি।

ড্রোনের মাধ্যমে আধুনিক যুদ্ধে বিপ্লব ঘটেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন কি বেসামরিক মৃত্যু ঘটানো দ্রুত বিকশিত প্রযুক্তিটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্যে যথেষ্ঠভাবে প্রস্তুত?

১৮৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে সামরিক উদ্দেশ্যে ড্রোন অথবা মনুষ্যবিহীন উড়ন্ত যন্ত্রটির ব্যবহার শুরু হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য ছিল নজরদারি। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন সরকার আফগানিস্তানে আঘাত করার ক্ষমতা সম্পন্ন ড্রোন ব্যবহার শুরু করলে পরিস্থিতিটি আমূল বদলে যায়। ড্রোন হামলাগুলি “পরিচ্ছন্ন যুদ্ধ” এর একটি রূপ উপস্থাপন করে বলে ওয়াশিংটন যে যুক্তিটি উপস্থাপন করেছে তা হলো এরা সরেজমিন মার্কিন সেনাদের যুদ্ধে নিযুক্ত করে না। ওবামা প্রশাসন কথিতভাবে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে এনে  সত্যিকারভাবেই এদেরকে শল্যবিদের আঘাত হিসেবে বর্ণনা করেছে।

আন্তর্জাতিক আইন

আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষভাবে ড্রোন ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা কোনো বিধান নেই। প্রধান আইনি রেফারেন্স হিসাবে এর পরিবর্তে যা ব্যবহার করা হয় তা হলো জেনেভা কনভেনশন যা যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের জন্যে নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে। কনভেনশনের মূল উপাদানগুলির মধ্যে একটি হল সশস্ত্র সংঘাতের সংজ্ঞা এবং সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হলেও  অবশ্যই সরাসরি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা। জেনেভা কনভেনশন আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ভিত্তি তৈরি করেছে যা বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার চেষ্টা করে এবং সেটা অ-যোদ্ধাদের উপর সামরিক ড্রোন হামলার প্রেক্ষাপটে একটি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

বার্লিনে বিঘ্নিত নেটওয়ার্ক গবেষণাগার আয়োজিত ড্রোন সম্পর্কিত একটি সম্মেলনের সময় গ্লোবাল ভয়েসেস সামরিক ড্রোন হামলার শিকার বেসামরিক ব্যক্তিদের বিভিন্ন মামলার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী এবং তদন্তকারী খলিল দেওয়ানের সাথে কথা বলেছে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন:

সমস্যাটি আইনের অভাবের নয় বরং সশস্ত্র ড্রোনের মাধ্যমে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলির ভেতরে এবং বাইরে শক্তি প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী আগে থেকে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনের বিস্তৃত ব্যাখ্যার।

প্রকৃতপক্ষে ড্রোন হামলাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্যে সাধারণ অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত যুদ্ধের আইনে আনুষ্ঠানিকভাবে দুটি দেশকে যুদ্ধাবস্থায় থাকতে হয়। তবুও এটা ইয়েমেনের মতো জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে প্রযোজ্য নয়। সোমালিয়ায় সংঘটিত চারটি ভিন্ন ঘটনায় ড্রোন হামলায় নিহত ১৪ জনের মৃত্যুর তদন্তকারী দেওয়ান জানিয়েছেন যে ইউএস আফ্রিকমের সাথে কথা বলা হলে তারা বেসামরিক হতাহতের কথা অস্বীকার করেছে। উপসংহারে তিনি বলেন, এমন ঔদ্ধত্য এবং দায়মুক্তির নীতি-হামলা পরবর্তী তদন্তকে বাধা প্রদান করে।

বলার মতো একটা ঘটনা হলো ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যথাযথ প্রক্রিয়ার অধিকার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে ইয়েমেনে একটি মার্কিন ড্রোনের আঘাতে মার্কিন নাগরিক আনোয়ার আল-আওলাকির মৃত্যু।

কিন্তু দেওয়ানের যুক্তি অনুসারে আরেকটি বড় সমস্যা রয়েছে যা অনেক মানবাধিকার সংগঠন এড়িয়ে যেতে চায়:

সন্দেহভাজন যোদ্ধাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ন্যায্য বিচারের পরিবর্তে তাদের হত্যা করা কতটা আইনী ও নৈতিক? (বিশেষ করে) যেসব দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় নেই?

তিনি উল্লেখ করেন, পশ্চিমা দেশগুলিতে “সন্ত্রাসী” হিসাবে চিহ্নিত লোকেদের বিচারবহির্ভূত হত্যা একটি গ্রহণযোগ্য চর্চা বিষয়ে একটি সাধারণ চুক্তি রয়েছে বলে মনে হয়।

হত্যার মেঘ: দায়িত্ব এড়ানোর জন্যে ধোঁয়ার একটি নিখুঁত আচ্ছাদন

দায়িত্ব আরোপ করার ক্ষেত্রে আরেকটি মূল চ্যালেঞ্জ হলো যেখানে বিভিন্ন দেশ এবং কোম্পানির সক্রিয় অবদান রাখা ড্রোন পরিচালনাকারী অত্যন্ত শক্তিশালী ডেটা সিস্টেম।

ড্রোনের সাথে অপরিচিত নয় এমন লোকেরা মানববিহীন উড়ন্ত যন্ত্রটিকে সেন্সরযুক্ত একটি নিছক বাহন ভেবে এটি এড়িয়ে যেতে পারে যে বিশেষজ্ঞদের এখন “হত্যার মেঘ” বলে ডাকা ড্রোনকে স্বায়ত্তশাসিত এবং হামলাকারী বানানো ডেটার বিশাল ও অত্যন্ত জটিল এবং সমৃদ্ধ নেটওয়ার্ক এটিকে একটি প্রাণঘাতী অস্ত্রে রূপান্তরিত করতে পারে। হত্যার মেঘ ক্ররত্রিম উপগ্রহ এবং অন্যান্য নজরদারি যন্ত্রপাতি থেকে আসা বিপুল পরিমাণ যে ডেটা শোষণ করে তা মানুষ অনুবাদ ও বিশ্লেষণ করে ড্রোনটিতে ফেরত দেওয়ার পরে তাকে নিযুক্ত করা হয়। পর্দাফাঁসকারী মার্কিন সামরিক বাহিনীর দুই প্রাক্তন সদস্য এবং ড্রোন বিশেষজ্ঞ লিসা লিং এবং সায়ান ওয়েস্টমোরল্যান্ড “পরিবর্তনের জন্যে পর্দা ফাঁস” বইতে এমনই ব্যাখ্যা করেছেন (এটি এখানে মুক্তভাবে ডাউনলোড করা যেতে পারে)।

[আমাদের অবশ্যই] নিবিড় বুদ্ধিমত্তা, নজরদারি এবং অনুসন্ধানী জরিপ উৎপাদনের পিছনে বিস্তৃত ব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক পক্ষপাতগুলিকে অস্পষ্ট করে এই মঞ্চগুলিকে তাদের লক্ষ্যগুলির দিকে পরিচালনাকারী সংকীর্ণ কাঠামোবদ্ধকরণটি এড়িয়ে যেতে হবে। ধারণাটি আগে দেখা যায়নি এবং এর ঔপনিবেশিক সুযোগ বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন বর্ণের সম্প্রদায়গুলির জন্যে অবিরাম যুদ্ধ নিয়ে আসছে।

ঠিক মার্কিন-মিত্র দেশগুলির মতো বিভিন্ন কোম্পানির সাহায্যে সফ্টওয়্যার বা ছবি বা বিষয়বস্তু  টুকরো সরবরাহ করার মাধ্যমে সহজে দায়িত্ব এড়ানোর জায়গাগুলিতে হত্যার মেঘের ক্ষমতা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ড্রোন হামলার মাধ্যমে বেসামরিক নাগরিকদেরসহ যোদ্ধাদের হত্যা করার পর কে দায়ী এবং কোন এখতিয়ারে?

দেওয়ান যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, প্রত্যেকেই দ্রুত কোনো সরাসরি দায়িত্ব অস্বীকার করে থাকে:

আমি ফরাসি সামরিক বাহিনীর সাথে কথা বলার পর তারা আমাকে প্রথম যা বলে তা হলো: “আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্বকীয় হামলা পরিচালনা করি না।” তবুও তারা ডেটা, বিশ্লেষণ এবং নজরদারির তথ্যে অবদান রাখে যা মার্কিন হত্যার মেঘকে পরিচালনা করতে দেয়।

নতুন এক খেলোয়াড়: তুরস্ক

ড্রোন যদি আধুনিক যুদ্ধে বিপ্লব ঘটিয়ে থাকে তবে সম্ভবত তুরস্ক ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেলার নিয়মগুলিকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ২০০৪ সালে তুরস্ক বাইরেক্তার (পরিচালক) নামে তার নিজস্ব ব্র্যান্ডের মিলিটারি ড্রোন উৎপাদন শুরু করে। তারা ২০২০সালে দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্যে আর্মেনিয়ার সাথে আজারবাইজানের যুদ্ধের সময় প্রথম আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-বিগ্রহে আবির্ভূত হয় এবং সম্প্রতি আঙ্কারা ইউক্রেনের কাছে কিছু পরিমাণ বিক্রির কথা স্বীকার করেছে। এগুলো রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এতটাই সফল যে ইউক্রেনে এদের কৃতিত্ব নিয়ে একটি গান রচিত হয়েছে

দেওয়ানের মতে, তুর্কি ড্রোনগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কাজ করে:

মার্কিন নেতৃত্বাধীন হত্যার মেঘের মতো সক্ষমতা তুরস্কের নেই। তুরস্ক নিজস্ব ড্রোন তৈরির ঘোষণা করলে জার্মানির বিশেষজ্ঞরা এর তীব্র বিরোধিতা ও সমালোচনা করে। তবুও এগুলি আজারবাইজান এবং ইউক্রেনে কার্যক্রম চালিয়েছে এবং যতদূর আমরা বলতে পারি কোন বা ন্যূনতম বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু ছাড়াই, শুধু যুদ্ধের লক্ষ্যে।

ইউক্রেনের যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, বড়সড় সেনাবাহিনী রয়েছে এমন দেশগুলোর জন্যে ড্রোন ব্যবহার এবং প্রযুক্তি কৌশলগত আগ্রহের বিষয় বলে প্রমাণিত হচ্ছে।

সমস্যাটি নিয়ে আরো দীর্ঘ বিশ্লেষণের জন্যে এখানে খলিল দেওয়ানের একটি ভিডিও উপস্থাপনা রয়েছে (৪০তম মিনিট থেকে)।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .