কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শক্তিশালী প্রতিবাদী গান

উগান্ডা এবং নাইজেরিয়ার শিল্পীরা ঠিক যেমন করে তাদের সঙ্গীত ব্যবহার করে সরকারি ও সামরিক নিপীড়নকে চ্যালেঞ্জ করে সারা মহাদেশের শিল্পীরাও তাই করেছেন। এটি এই দুইপর্বের ধারাবাহিক গল্পের দ্বিতীয় পর্ব যেখানে আমরা সারা মহাদেশের সক্রিয়তা এবং ভিন্নমতকে উৎসাহিত করা সঙ্গীতশিল্পীদের তুলে ধরি। প্রথম পর্বের জন্যে এখানে এখানে দেখুন।  এই নিবন্ধে আমরা কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিবাদী সঙ্গীত এবং জনগণের মুক্তিতে এটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি।

কেনিয়া

ঔপনিবেশিক দিন থেকে কেনিয়ার সঙ্গীত দৃশ্যপটে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে – অনেক স্থানীয় গায়ক প্রতিবাদী গানের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছে। একটি আইকনিক উদাহরণ হলেন কিকুয়ু সঙ্গীতশিল্পী প্রয়াত জোসেফ কামারু যার এক হাজারটিরও বেশি গানের ক্যাটালগ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। মধ্য কেনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী গিটার, কীবোর্ড এবং মাঝে মাঝে অ্যাকর্ডিয়নের সাথে মিশ্রিত কিকুয়ু ঐতিহ্যবাহী সুরের একটি অনন্য মিশ্রণ তৈরি করেছেন। তিনি প্রায়শই দেশের স্বাধীনতা এবং নগরায়নের প্রতিফলন করে সামাজিক সমস্যা সম্পর্কিত গান গেয়ে থাকেন।

তবে স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছর পর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচনের পর কেনিয়া তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কেএনইউ এবং বিরোধী কেপিইউ এর মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত ছিল। বিশেষ করে একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ টম এমবোয়াকে দিনের আলোতে গুলি করে হত্যা করার পরে এটা সম্প্রদায়গুলিকে বিভক্ত করে দেয়।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রশংসা করার উদ্দেশ্যে জোসেফ কামারু একটি গান – “আরোমাকা”  (“তিনি হয়তো ভীত”) – রচনা করেন। কিন্তু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডেটির বিষয়ে অনুভূত পক্ষপাতিত্বের কারণে এটি বৃহত্তর জনগণের মধ্যে আবেদন করেনি।

পিগাপিচা (আলোকচিত্রগ্রাহক) এর জে এম কারিউকি স্মরণে,  সিসি বাই-এনসি-এনডি ২.০ এর আওতায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত

১৯৭৫ সালে এবার কেনিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের আরেকজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ জেএম কারিউকি নামে পরিচিত জোসিয়াহ মওয়াঙ্গি কারিউকি আরেকটি উত্তপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের কয়েক মাস পরে নিহত হন। প্রয়াত জেএম  কারিউকি, প্রাথমিকভাবে সরকারপন্থী হলেও “কেনিয়া ক্রমেই দশজন কোটিপতি, আর কোটি ভিক্ষুকের দেশ হয়ে উঠছে” কথাটি চাউর করার মাধ্যমে সরকারের ক্রমবর্ধমান উপজাতিবাদ এবং দুর্নীতির অন্যতম প্রধান সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। প্রকাশ্য সমালোচনার কারণে তাকে প্রচারণা থেকে নিষিদ্ধ করা হলে তিনি ঘরে ঘরে দেখা করার আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ১৯৭৫ সালে কারিউকির মৃত্যুর পরে কামারু এই জাতীয় বীরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত বন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে “জে.এম কারিউকি” শিরোনামের একটি গান গেয়েছিলেন।

মুক্তির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ৭৫ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হওয়া এই বিশেষ গানটি তার সর্বাধিক বিক্রিত হিটগুলির মধ্যে অন্যতম। তিনি দ্রুত সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলে ১৯৭৫ সালের জুনে গানটি জাতীয় রেডিও ভয়েস অফ কেনিয়াতে (বর্তমানে কেনিয়া সম্প্রচার কর্পোরেশন) নিষিদ্ধ করা হয়।

কামারু সেখানেই থেমে থাকেননি। কেনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জোমো কেনিয়াত্তার মৃত্যুর পর তিনি নবাগত Pরাষ্ট্রপতি ড্যানিয়েল আরাপ মোইয়ের আশ্রয় নিলে তিনি তাকে জাপান সফরে আমন্ত্রণ জানান। এসময় তিনি “সাফারি ইয়া জাপান” রচনা করেন। তবে তার সেই ক্ষমতার  কাছ থেকে ছিটকে পড়তে বেশি সময় লাগেনি এবং তিনি আবারো সমালোচনা শুরু করেন। তিনি মোই সরকারকে সাধারণ জনগণ এবং বিশেষ করে কিকুয়ুদের মধ্যকার অসন্তোষ ও স্বপ্নভঙ্গ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যে অস্পষ্ট ভাষা এবং কিকুয়ু শব্দসমৃদ্ধ আরেকটি গান রচনা করেন। গানটির শিরোনাম ছিল “নি মাইথো টুনিটে” (আমরা কেবল আমাদের দৃষ্টি পরিবর্তন করেছি)। এটিও জাতীয় স্টেশন থেকে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়।

কামারুর বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে লেগে থাকাটা সেখানেই শেষ হয়নি। ১৯৮৮ সালে দেশটিতে আরেকটি নির্বাচন শুরুর সময় তিনি আরেকটি গান রচনা করেন। প্রথমত তিনি তার “মাহোয়া মা বুরুরি” (দেশের জন্যে প্রার্থনা) গানটির একটি কিকুয়ু সংস্করণ দিয়ে রাষ্ট্রের, বিশেষ করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড্যানিয়েল মোইয়ের, দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মোই গানটিতে “গুইকিও ইরিমা তা ড্যানিয়েল” যার অর্থ “ড্যানিয়েলের মতো গর্তে/গুহায় নিক্ষেপ করা হয়েছে” এর উল্লেখ থাকায় প্রাথমিকভাবে গানটিকে তার প্রতি একটি পরোক্ষ আক্রমণ বলে মনে করেছিলেন।

কামারুর ব্যাখ্যা অনুসারে “ড্যানিয়েল” নামটি বাইবেল থেকে নেওয়া, রাজাকে কুর্ণিশ করতে অস্বীকার করায় তাঁকে সিংহদের একটি গুহায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আপসের অংশ হিসেবে মোই গানটিকে জাতীয় ভাষা সোয়াহিলিতে অনুবাদ করার অনুরোধ করেন। এই গানটি কামারু প্রকাশ করলেও সেটা কিকুয়ু সংস্করণের মতো অতোটা সম্প্রচারিত হয়নি, যা কামারুর হতাশার কারণ।

সাম্প্রতিক রাজনীতিবিদদের সাথে জোসেফ কামারুর গানের সম্পর্কের ওঠা-নামার মানে হলো রাজনীতিবিদদের অনেকে গানকে পরিচালিত বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করলেও এর সৃজনশীলতা, সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা এবং সমস্ত অশুভের মিলিত স্বর সমসাময়িক জনসাধারণকে প্রভাবিত করেই থাকে। কেনিয়ার বর্তমান অবস্থার সাথে একই বিষয়গুলি এখনো বাস্তব।

দক্ষিণ আফ্রিকা

শ্বেতাঙ্গ-সংখ্যালঘু বোয়ার্সরা কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসনের সময় আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণতম রাষ্ট্রটি বর্ণবাদী সময়কাল সহ্য করেছিল। এটি ছিল ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত। এই সময়কালে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর অবিচার করা হয়েছিল। তাদের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে আজীবন আটকে রাখা হয়েছিল।

টম বিটজের মিরিয়াম মাকেবা ২০১১.জেপিজি, সিসি বাই ২.০ এর আওতায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত

কণ্ঠহীনদের একটি কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কিছু সঙ্গীতশিল্পী তাদের শিল্পকে ব্যবহার করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন মিরিয়াম মাকেবা। জোসা এবং ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন দেশীয় গানের জন্যে বিখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পী বর্ণবাদী শাসন বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হেনড্রিক ভারওয়ার্ডের কথা উল্লেখ করে “সাবধান, ভারওয়ার্ড! (এনদোদেমনি আমা) “সাবধান, ভারওয়ার্ড! গানটি গেয়েছিলেন। বর্ণবাদ বিরোধী অবস্থানের কারণে গানটি জাতীয় রেডিওতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

১৯৬০ সালে মাকেবাকে নির্বাসনে যেতে হয় এবং কিছু সময়ের জন্যে তার দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে আসা নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বৈশ্বিক আইকন হয়ে ওঠেন এবং সারা বিশ্বে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার প্রতিবাদী গান গাইতে এবং লিখতে থাকেন।

মাকেবার বিচার ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে ব্রেন্ডা ফ্যাসি তার ক্যারিয়ারের সুসময়ে বিতর্কিত হন। তিনি তৎকালীন “সবচেয়ে বিখ্যাত বন্দী” নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে “কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি” গানটি গেয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে ফ্যাসি এবং চিক্কো থওয়ালা গানটি লিখেছিলেন। সময়টি ছিল বর্ণবাদী সরকারের অন্তিম মুহূর্ত, যখন ম্যান্ডেলা মুক্তি পেতে চলেছেন। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার শহরগুলিতে যৌনতা এবং সামাজিক অসুস্থতা নিয়ে বিতর্কিত আলোচনার অজুহাতে সরকার ফ্যাসির গানগুলিকে নিষিদ্ধ করেছিল।

ভিনাইলমিস্টারের তৃতীয় বিশ্বের শিশু জনি ক্লেগ এবং সাভুকা, সিসি বাই-এনসি ২.০ এর আওতায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত

জনি ক্লেগ এবং সাভুকা ব্যান্ডের গাওয়া আরেকটি দক্ষিণ আফ্রিকার গান “অসিম্বোনাঙ্গা” দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। জুলু ভাষায় গানটির অর্থ “জাগরণ” এবং ১৯৮৭ সালে ক্লেগের “তৃতীয় বিশ্বের শিশু” অ্যালবামে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে স্থানীয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে ন্যায়বিচার চাওয়া বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক বিবেচিত ম্যান্ডেলা এবং স্টিভ বিকো উভয়কে আবাহন করা হয়। স্কটিশ-জিম্বাবুয়ে এবং ইহুদি জন্মসূত্রের ক্লেগ প্রথম বহু-জাতিগত ব্যান্ডদল জুলুকা এবং পরে সাভুকা তৈরি করেছিলেন। তার বাবা-মা দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে চলে যাওয়ার আগে তিনি জিম্বাবুয়ের (তখন রোডেশিয়া) বিভিন্ন অঞ্চলে বড় হয়েছিলেন। একারণে তিনি জো’বার্গ এবং অন্যান্য বড় শহরগুলির সংখ্যালঘুদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখেন। তার শেখা জুলুদের স্থানীয় ভাষা তার গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলির একটি হয়ে উঠে।

এসব গান ও সঙ্গীতশিল্পীর বেশিরভাগই যা বোঝায় তা হলো প্রতিবাদের সাধারণ মুদ্রা, সামাজিক অসুস্থতা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলা। এই গানগুলি সাময়িকভাবে অসম্প্রচারিত থাকা সত্ত্বেও সঙ্গীতের ঘটনাবলী থেকে বিভিন্ন দেশের শ্রোতাদের শোনার এবং শেখার সুযোগ দিয়ে তা আমাদের বায়ুতরঙ্গকে প্লাবিত করে দিনের আলোর মুখ দেখতে পেরেছে।

এটাসহ সারাবিশ্বের অন্যান্য নিষিদ্ধ গানগুলিকে তুলে ধরা গ্লোবাল ভয়েসের স্পটিফাই প্লেলিস্টটি এখানে দেখুন। নিষিদ্ধ সঙ্গীত সম্পর্কে আরো তথ্যের জন্যে আমাদের বিশেষ কভারেজ ভুল সুর বাজানো দেখুন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .