২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে সুদানের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা লক্ষ্য করেছে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ কমিটিগুলির কিছু পোস্ট তাদের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রতিরোধ কমিটিগুলি দেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং ফেসবুকের মতো সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি তাদের সাংগঠনিক কাজের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। কিছু ব্যবহারকারী অনুমান করেছে পোস্টগুলি সুদান সরকারের পোষা রাশিয়া বা কানাডীয় লবিং প্রতিষ্ঠান ডিকেন্স এন্ড ম্যাডিসনের সাইবার-আক্রমণের কারণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই হামলার সূত্রপাত সম্ভবত উত্তরের প্রতিবেশী দেশ মিশর থেকে যার সুদানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গভীর আগ্রহ রয়েছে।
প্রতিরোধ কমিটিগুলি স্থানীয় ভিত্তিক [3] সংগঠন যা ২০১৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভগুলিকে সংঘবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই কমিটিগুলিকে সুদানের তৃণমূল প্রতিরোধের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত ওমর আল বশিরের শাসনামলের স্বৈরাচারী আমলে জন্ম নেওয়া কমিটিগুলি একটি অগণতান্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে উঠলেও এখনো অভ্যন্তরীণভাবে কোন শ্রেণিবদ্ধ কাঠামো ছাড়াই গণতান্ত্রিকভাবে কর্মকর্তা নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক থাকতে পেরেছে। স্পষ্ট লক্ষ্য থাকা এবং সেগুলি অর্জনের বিষয়ে কট্টর হওয়া স্বত্ত্বেও প্রতিরোধ কমিটিগুলি সামরিক বাহিনীর প্রত্যাশা মতো রাজনৈতিক চর্চা করে না এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয় বলে তাদের পরাজিত করা কঠিন।
সুদানের গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলি ফেসবুক এবং টুইটারে দেশীয় মুসলিম ব্রাদারহুড ও ক্ষমতাচ্যুত সরকার এবং বিদেশী রাশিয়া [4] ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে [5]র নেটওয়ার্কের মতো উভয় ধরনের গোষ্ঠীর সমন্বিত প্রমাণহীন আচরণ [6] (সিআইবি) আক্রমণের মুখোমুখি হয়। সিআইবি হলো যখন একদল অনলাইন পাতা অথবা লোক তারা কে এবং কী করছে সে সম্পর্কে অন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্যে একসাথে কাজ করে। প্রাথমিকভাবে এই আক্রমণগুলির লক্ষ্য বিভ্রান্তি ছড়ানোর মাধ্যমে জনমতকে প্রভাবিত করা হলেও শেষ আক্রমণটির লক্ষ্য ছিল ব্যবহারকারীর ফেসবুক টাইমলাইনে তথ্য লুকানোর জন্যে ফিডের অ্যালগরিদম পরিবর্তন করা।
ফেসবুকের বাইরে থেকে হস্তক্ষেপের প্রকৃতি নির্দিষ্ট করা কঠিন হলেও কিছু কিছু ধরন খুব সহজেই লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুদানী ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিডে দশ লক্ষ থেকে দেড় কোটি অনুসরণকারী সম্বলিত প্রভাবশালীদের সাথে সম্পর্কহীন অথবা ইতোমধ্যে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নতুন পৃষ্ঠাগুলি আবির্ভূত হতে শুরু করে। সাধারণত এই পৃষ্ঠাগুলি ধর্মীয় বা মানসিক অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যা তাদের ব্যস্ততার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
এই পৃষ্ঠাগুলির পিছনে থাকা ব্যবহারকারীরা তারপরে পৃষ্ঠাগুলিকে একত্রিত করতে দেওয়া ফেসবুকের নতুন বৈশিষ্ট্যের সুবিধা গ্রহণ করে। দুই বা ততোধিক পৃষ্ঠা একত্রিত হয়ে যাওয়ার পর অনুসারী এবং অনুরাগীরা একটি নতুন পৃষ্ঠায় স্থানান্তরিত হয়ে নিজেদেরকে এমন একটি পৃষ্ঠা অনুসরণ করতে দেখে আসলে তারা যার গ্রাহক হয়নি।
এভাবে পৃষ্ঠাগুলিকে একত্রিত করার পরে পৃষ্ঠাগুলির পিছনে থাকা লোকেরা অনুসরণ করার জন্যে মুষ্টিমেয় অনুসারীদের বেছে নিয়ে অন্যদের কাছে দৃশ্যমানতা প্রভাবিত করার জন্যে তাদের পোস্টগুলিতে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। যেমন সম্প্রতি ফ্রান্সিস হাউগেন জানিয়েছেন [7], ফেসবুক প্রতিক্রিয়া দণ্ডে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া বিভিন্নভাবে পরিমিত হয় এবং একজন ব্যক্তির পোস্টে নিয়মিতভাবে ডাউনভোট বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমে এই বড় বড় অ্যাকাউন্টগুলি মূলত নিশ্চিত করে যেন কেউ তাদের না দেখে। কার্যত ক্রিয়াগুলি একটি ছায়া নিষেধাজ্ঞা তৈরি করে — প্রতিরোধ কমিটিকে অবহিত না করেই তাদের পোস্টগুলি চুপ করিয়ে দেয়।
প্রাথমিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে সুদানী প্রতিরোধ কমিটির ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলিকে এভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ছায়া নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকা সত্ত্বেও সুদানী ব্যবহারকারীরা প্রতিরোধ কমিটিগুলির বিষয়বস্তু অনুসন্ধান ও ভাগাভাগি করার চেষ্টা না করা পর্যন্ত এদের অনেকগুলি অনেক দিন ধরেই নিউজ ফিড থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
নীচের সারণিটিতে এই আচরণের সাথে জড়িত কিছু পৃষ্ঠার উদাহরণ রয়েছে:
পৃষ্ঠাটি নীচের ছবিতে তার অনুসারীদের গ্রুপটিতে যোগদানের একটি আহ্বান প্রদর্শন করেছে৷
গ্রুপটির মালিক [8]কে (মোহাম্মদ রমজান, প্রোফাইল [9] আইডি ১০০০০৫০৯০০৭২৭৩৩) ফোন করে দেখা হয়েছে, তার অ্যাকাউন্টটি আসল এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে সক্রিয়। মোহাম্মদের প্রোফাইলে বলা হয়েছে তিনি মিশরের একটি শহর অ্যাসিউট থেকে এসেছেন। তার কিছু পোস্ট মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় মোহাম্মদ আবুত্রাইকা এবং মো সালাহ সম্পর্কে এবং এদের বেশিরভাগই মিশরীয় আরবিতে। নীচের ছবিটিতে যেমন দেখানো হয়েছে উপরের টেবিলের পৃষ্ঠা নম্বর (৫) এর তিনজন এডমিন (পরিচালনাকারী) রয়েছে এবং তারা মিশরেই অবস্থান করে।
এই বিশ্লেষণটিতে দেখা যায় যে এটি ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে শুরু হওয়া একটি পরিকল্পিত আক্রমণ৷ অ্যাকাউন্টগুলি থেকে জানা যায় মিশরে অবস্থিত হলেও একটি ভিপিএন ব্যবহার করে এগুলো অন্য কোন স্থান থেকে পোস্ট করা হয়ে থাকতে পারে৷ কিন্তু সুদানী প্রতিরোধ কমিটি মিশর ও সুদানের মধ্যবর্তী সড়কটির উপর দিয়ে যাতায়াতকারী সংস্থানগুলি থেকে স্থানীয়দের বরাদ্দের দাবিতে মহাদেশীয় সড়কের পাশে অবস্থান ধর্মঘটে [10]র ডাক দিয়েছিল বলে তাদের প্রতি মিশরীয় সরকারের বিরোধিতা রয়েছে। এছাড়াও মিশর সুদানে সামরিক অভ্যূত্থানকে সমর্থন করে [11] যাকে প্রতিরোধ কমিটি ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
একইভাবে, সুদানের ডিজিটাল স্পেসে হস্তক্ষেপ করা মিশরীয় সরকারের জন্যে নজিরবিহীন নয়। ২০১৯ সালের জুনে একটি মিশরীয় কোম্পানির প্রচারণায় [12] বেসামরিক সরকারের দাবি করার সময় র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) একশোরও বেশি সুদানী নাগরিককে হত্যার মাধ্যমে খার্তুমে গণহত্যা চালানোর পরে সামরিক শাসনের প্রশংসা করা হয়। সামরিক-পন্থী বিষয়বস্তু লিখে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং টেলিগ্রামকে লক্ষ্যবস্তু করে একজন মিশরীয় প্রাক্তন সামরিক অফিসারের মালিকানাধীন একটি কোম্পানির নেতৃত্বে প্রচারণাটি চালানো হয়েছিল।
প্রকাশের আগেই এই পৃষ্ঠাগুলি মুছে ফেলা হয়েছিল। তবে ফেসবুক নাকি এই পৃষ্ঠাগুলির মালিকরা নিজেরাই এটি মুছেছে তা স্পষ্ট নয়৷ নীচের পর্দাছবিটি ফেসবুকে “সংরক্ষিত পোস্ট” ফাইল থেকে মুছে ফেলা বিষয়বস্তু দেখাচ্ছে।
মেটা সম্প্রতি সিআইবি এর উপর অভিযান বাড়িয়েছে এবং এটি তার একটি উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু প্রতিরোধ কমিটিকে আরো সুরক্ষা দিতে মেটা সক্রিয় কর্মীদের দাবি পৃষ্ঠাগুলি ভেরিফাই করে দিলেই কেবল সুদানী বিপ্লবের এই স্তম্ভগুলি ভবিষ্যতের অনুরূপ আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সাহায্য করবে।