৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস মেক্সিকোতে হাজার হাজার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মেক্সিকোতে সহিংসতা নিয়মতান্ত্রিক, শুধু ২০২১ সালেই সহিংসতার কারণে ৩০ হাজারেরও বেশি মেক্সিকোবাসী তাদের জীবন হারিয়েছে। অনেক নারী এর শিকার। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে নারীহত্যার ঘটনা ১৩৭ শতাংশ বেড়েছে এবং মেক্সিকোর জাতীয় স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএনএএম) অনুসারে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার প্রতি দশজন বালিকা এবং নারীর মধ্যে সাতজনের বয়স ১৫ বছরের বেশি।
একজন নারী অধিকার কর্মী হিসেবে গ্লোবাল ভয়েসেসকে তার দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে বলার সময় মেক্সিকোতে নারীরা যে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় মেক্সিকোর একজন নারীবাদী সক্রিয় কর্মীর সাক্ষ্যে তা উঠে এসেছে। নিরাপত্তার কারণে, তার নাম তার আনুষ্ঠানিক ছদ্মনাম “হর্মিগিতা” (ছোট পিঁপড়ে) দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। তিনি মেক্সিকো সিটির উপকণ্ঠেই থাকেন।
হর্মিগিতা ২০২০ সাল থেকেই একজন সক্রিয় নারীবাদী। “এর সবই শুরু হয়েছিল মহামারীর সময়,” তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন। “মোরারা ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” যুবতী নারীদের বুঝাতে ব্যবহৃত একটি মেক্সিকীয় অপবাদমূলক শব্দ মোরাস এখানে নারীবাদী আন্দোলনে সক্রিয় তরুণীদের বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
হর্মিগিতার কাছে, “ভালবাসা নারীদের মধ্যে বিপ্লবাত্মক, এটা একটা প্রতিরোধ, এবং এটা নিজেকে একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়ে প্রতিদিন বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়।”
তার প্রথম বিক্ষোভটি ছিল রাজধানীর কেন্দ্রে বেলাস আর্টস প্যালেসের সামনে। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে রাস্তার বিক্রেতারা এতে খুশি ছিল না। “আমাদের শারীরিক এবং মৌখিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল, এবং তাই সংঘর্ষ এড়াতে আমরা আর সেই বিপজ্জনক এলাকায় ফিরে যাই না।”
মেক্সিকোর নারীবাদীরা লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে মেক্সিকীয় সরকারের অযোগ্যতা ও নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা করে বলেছে এসব মামলার প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত অত্যধিক আমলাতন্ত্র সমস্যাটি নিয়ে সরকারের উদ্বেগের অভাবকেই প্রদর্শন করে। মাত্র ৪ শতাংশ নারীহত্যা মামলা বিচারের মুখোমুখি হয় এবং নারীবাদীরা অন্যতম প্রধান সমস্যা দায়মুক্তির এই উচ্চ হারেরই প্রতিবাদ করছে।
হর্মিগিতা ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে ২০,০০০ বিক্ষোভকারীতে পৌঁছাতে পারা মেক্সিকোর মিছিলটির আকার থেকে বোঝা যায় নারীবাদী মিছিলগুলির একটি জটিল পরিকল্পনা ব্যবস্থা রয়েছে।
“পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সমষ্টিগুলি একটি সমাবেশ এবং একটি ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল। সমাবেশগুলির প্রত্যেকটি ১০ থেকে ১৫ টিরও বেশি সমষ্টিকে একত্রিত করেছিল। এছাড়া, আমরা সারা মেক্সিকোর রাজ্যগুলির নারীবাদী গোষ্ঠীগুলিকে একত্রিত করতে সাহায্য করা বিশাল সমর্থন নেটওয়ার্কগুলির উপর নির্ভর করতে পারি।” হর্মিগিতা জনগণ সাধারণত নারীবাদীদের বিভক্ত এবং আন্দোলন নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক বেশি মতবিরোধ রয়েছে বলে মনে করার কথা বললেও তিনি নিশ্চিত করেছেন যে তারা “সবসময় একে অপরের প্রতি খেয়াল রাখে।”
২০২০ সালে নারীবাদী বিক্ষোভকারীরা বামপন্থী আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোর (এএমএলও) এর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত জাতীয় প্রাসাদের দরজায় লাল রঙে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার বিরোধিতা করে বার্তা এঁকেছে। পরের বছর বিক্ষোভকারীরা প্রাসাদের দেয়াল রক্ষার জন্যে তৈরি করা বেড়াটিকে নারীহত্যার শিকার সবার জন্যে একটি স্মৃতিসৌধে পরিণত করে। এবছর সরকার আবারো রাজপ্রাসাদ বেড়া দিয়ে রেখেছে।
দেশের অন্যান্য স্থানেও বিক্ষোভ চলছে। মেক্সিকোর দক্ষিণের রাজ্য গেরেরোতে একজন অভিযুক্ত ধর্ষক ফেলিক্স সালগাদো ম্যাসেডোনিয়া গভর্নর পদপ্রার্থী ছিল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মোরেনা প্রকাশ্যে সালগাদো মেসিডোনিয়াকে সমর্থন করেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারীবাদীরা রাজনৈতিক নেতাটির প্রার্থীতায় সহযোগিতার বিরোধিতা করে গেরেরোর রাজ্য নির্বাচনী আদালতের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে: “বাতিল না করা হলে বিপ্লব হবে,” তারা স্লোগান দেয়। কয়েক মাস পরে এএমএলও যুবতী মেয়েদের অবৈধ পাচার এবং পতিতাবৃত্তি ঘটে চলা সেই রাজ্যটি পরিদর্শন করেন। এই সমস্যাটিকে হালকাভাবে নিয়ে তিনি এটিকে “ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়” অভিহিত করে জোর দিয়ে বলেন “এসব সম্প্রদায়ে অনেক সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ রয়েছে।”
হর্মিগিতা তার আনুষ্ঠানিক নাম না দেওয়ার কারণটি ব্যাখ্যা করেন: “আমি প্রকাশ্যে [কর্তৃত্বের একটি প্রতিভূ]-কে অভিযুক্ত করে আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে আমি চলে যাওয়ার পরে আমি লক্ষ্য করি যে একই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমার মতো অনেক মেয়েই একই নির্যাতনের শিকার। তারপর কর্তৃপক্ষীয় একাডেমিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা আমাকে হুমকি দিতে ও হয়রানি করতে শুরু করে। আমাকে আলাদা করে দোষ দেওয়া হয়, কারণ অচলায়তনের কোন ত্রুটি সম্পর্কে আপনার অভিযোগ প্রত্যেককে আপনার বিরুদ্ধেই দাঁড় করিয়ে দেয়।”
এই অভিজ্ঞতাটি হর্মিগিতাকে তার এলাকায় একজন নারীবাদী হিসেবে সুপরিচিত করে। “এই পরিস্থিতিটি ছিল উটের পিঠ ভেঙ্গে দেওয়া খড়ের টুকরোর মতো। কারণ [এলাকাটির] মেয়েরা নিরাপদ গর্ভপাতের [মেক্সিকোতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গর্ভপাত বৈধ], নির্যাতকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং পরামর্শের জন্যে সাহায্য চাইতে আমাকে বার্তা পাঠাতে শুরু করে। এরপর আমি সেই মেয়েদের নির্যাতকদের, আমার নিজের নির্যাতক এবং তাকে রক্ষাকারী আমার কাছের লোকদের কাছ থেকেও হুমকি পাই।”
কিন্তু হুমকিগুলি আরো খারাপ হতে থাকে। “তারা আমাকে আমার ঠিকানা উল্লেখ করে ‘আমরা তোমাকে ধর্ষণ করবো’, ‘আমরা তোমাকে নিখোঁজ করে দেবো’, ‘আমরা জানি তুমি কোথায় থাকো’ ইত্যাদি বলে মেসেজ পাঠায়, এমনকি ফোনে কল দেয়।” হর্মিগিতা প্রকাশ করেছেন কীভাবে তিনি এবং তার সঙ্গীরা অনুভব করেছেন যে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং পুলিশ তাদের উপর নজরদারি করছে।
হর্মিগিতা ২০২২ সালের জন্যে নারীবাদী দাবির মূল ফোকাস সম্পর্কে আমাদের বলেছেন: “এই ৮মার্চ-এর জন্যে, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সংগঠিত করছি, এবং আমরা মেক্সিকোতে আইনি গর্ভপাতের দাবিতে আলোচনার টেবিল শুরু করার সম্ভাবনাও পরীক্ষা করছি।”
অসুবিধা ও হুমকি সত্ত্বেও তিনি তার সম্প্রদায়ের সক্রিয় কর্মীদের সমর্থন অনুভব করেন। “আমি নারীবাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব অনুভব করি, কারণ আমরা একে অপরকে সাহায্য করি, আমার রুটি-রুজি মেয়েদের ধর্ষণ মামলার অভিযোগ করতে সাহায্য করছে এবং নারীহত্যার মামলার জন্যে আদালতে আসা পরিবারগুলিকে সঙ্গ দিচ্ছে; আর আমি এখন যা করছি তা আমার জন্যে নয়, করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে।”