আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বেরুলো ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই

ইয়াংঙান ম্রো যেন অন্ধকারে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর জন্যে এক আলোকবর্তিতা। এঁকেছেন তুফান চাকমা। অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত।

ইয়াংঙান ম্রো যেন অন্ধকারে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর জন্যে এক আলোকবর্তিকা। এঁকেছেন তুফান চাকমা। অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত।

পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। চলতি বছর দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের এক জাতিগোষ্ঠী ম্রো’দের জন্য এলো বিশেষ আনন্দের সংবাদ। এবছর তাদের নিজেদের ভাষায় লেখা প্রথম ব্যাকরণ বই প্রকাশিত হলো।

ম্রো (মুরং) জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন জেলায় বসবাস করেন। ১৯৯১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ২২ হাজার ১৭৮ জন। তাদের ভাষা সাইনো-তিব্বতী ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

১৯৮২ সালের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর ক্রামাদি মেনলে ম্রো ভাষার বর্ণমালা প্রবর্তন করেন। এটি বাম থেকে ডানে লেখার একটি সহজ বর্ণমালা। এরপর এ ভাষার উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ম্রো ভাষার জন্যে ইউনিকোড ব্লক রয়েছে কিন্তু এখনো এই ভাষা ইন্টারনেট মাধ্যমে লেখা যায় না।

ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই ততোং

ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই ‘ততোং’. ছবি ইয়াংঙান ম্রো ও আদিবাসী বার্তার সৌজন্যে। ফেয়ার ইউজ।

ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বইয়ের নাম ‘ততোং’। বইটি লিখেছেন ম্রো ভাষার লেখক ইয়াংঙান ম্রো। বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারের অনুকরণে ম্রো ভাষার ‘ততোং’ লেখা হয়েছে। ম্রো ভাষায় আগে থেকে কিছু বইপত্র থাকলেও এই ভাষার ব্যাকরণ কখনও লেখা ছিল না।

সেই জায়গা থেকে ইয়াংঙান ম্রো ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২ বান্দরবান শহরের উজানি পাড়ায় এক অনাড়ম্বর পরিবেশে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বইটির লেখক আরো জানান:

এ বইয়ের মাধ্যমে ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন শুদ্ধভাবে তাদের ভাষায় লিখতে ও পড়তে পারবে। বিশেষ করে ম্রো শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বোঝার জন্য বইটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

উল্লেখ্য, ইয়াংঙান ম্রো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচ্যভাষা বিভাগে থেকে স্নাতকোত্তর করার পর ম্রো জনগোষ্ঠীর সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। লেখক হিসেবে ম্রো সমাজ ও রূপকথার গল্প নিয়ে ইয়াংঙানের মোট ২৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে; এর মধ্যে ম্রো ভাষায় ১৮টি এবং বাংলা ভাষায় ১০টি।

বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ম্রো ভাষার শিক্ষক ঙানসিং ম্রো। তিনি আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন:

ম্রো বর্ণমালা আবিষ্কারের পর তাদের হাতে লিখে লিখে বর্ণমালা পড়ানো হতো। এখন নিজেদের ভাষায় বই আকারে ছাপা হলো। এর ফলে এখন থেকে বইটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ম্রো ভাষা আরও শুদ্ধভাবে লিখতে ও পড়তে পারবে।

বাংলাদেশে বইয়ের সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে পরিচিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলছে এখন। প্রতিদিনই নতুন নতুন বই প্রকাশ হচ্ছে। তরুণ লেখক সুহান রিজওয়ান ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বইয়ের প্রকাশকে সাধুবাদ জানিয়ে লিখেছেন:

বইমেলার সমস্ত বইয়ের মাঝেও যে বইটা অমূল্য।

তরুণ শিল্পী তুফান চাকমা বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের নানা বিষয় ভিজুয়াল আর্টের মাধ্যমে তুলে ধরে থাকেন। ইয়াংঙানের উদ্যোগকে পাহাড়ি জনপদের অন্ধকারে আলো ফেলবে বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশের ভাষা চিত্র
বাংলাদেশ মূলত: বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ। এখানে ৯৮ শতাংশ মানুষই বাংলায় কথা বলেন। বাংলাদেশের নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানী ও আদিবাসী নেতাদের দেওয়া তথ্যানুসারে বাংলাদেশে মোট ৪৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে ৪টি ভাষাগোষ্ঠীর প্রায় ৩০টি ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে ১২-১৮টি ভাষা বিভিন্ন মাত্রায় বিপন্ন। আদিবাসী গবেষক সালেক খোকন এক লেখায় কুড়ুখ ও নাগরি ভাষা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন। তাছাড়া কোচ ও রাজবংশীদের ভাষা বিলুপ্তি দ্বারপ্রান্তে বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে ইউনেস্কোর গুরুতর বিপন্ন ভাষার তালিকায় ম্রো সম্প্রদায়ের ভাষা রয়েছে।

বাংলাদেশের ভাষা চিত্র। ছবি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে প্রাপ্ত। সিসি বাই ৩.০

বিপন্নতার ঝুঁকিতে থাকা ভাষাগুলোর সুরক্ষায় ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিক্ষা নীতির প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধ্যায়ে ‘আদিবাসী শিশু’ শিরোনামের ১৮নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে।’ ২০নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে; ‘আদিবাসী অধ্যুষিত (পাহাড় কিংবা সমতল) যেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।’ ২০১৭ সাল থেকে সরকার এই নীতি অনুযায়ী বেশ কটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাইমারি স্কুলের বই প্রণয়ন ও বিতরণ করে আসছে। তবে, পাঁচ বছর পরে এই উদ্যোগ হুমকির মুখে কারণ এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে আদিবাসী ভাষার শিক্ষকের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা যায়নি।

যেকোনো জনগোষ্ঠী ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে টিকে থাকে। এ জন্য ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি। আর ভাষাচর্চার জন্য দরকার ব্যাকরণ। সেই প্রেক্ষাপটে ইয়াংঙান ম্রোর ‘ততোং’ ম্রো জনগোষ্ঠীর ভাষা উন্নয়নের নতুন ইতিহাসের সূচনা করবে। ম্রোরা আশা করছে তাদের ভাষার প্রচলন রক্ষার্থে এটি কার্যকর উদ্যোগ হবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .