
অনেক দিন ধরেই বৈরুতের আল হামরা শহর কফি প্রেমীদের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছে মক্কা হিসেবে বিবেচিত। আজ, বুলেভা্র এবং এর কফির দোকানগুলি খালি এবং পরিত্যক্ত। ওমর বুতিনের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।
কফি প্রেমীদের মিলনস্থল আরো ভালভাবে বললে সেরা তিনের একটি না হলেও বিশ্বব্যাংকের হিসেবে শীর্ষ দশের মধ্যে থাকা বৈরুতের একটি বিখ্যাত বুলেভার হামরা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এযাবৎ কালে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর সংকট পর্ব অতিক্রম করছে। ২০২০ সালের মর্মান্তিক বৈরুত বিস্ফোরণের কারণে লেবাননের অর্থনৈতিক ধ্বস বহুগুণ বেড়ে গিয়ে হামরার শহুরে বুননকে আরো বিনষ্ট এবং এর লালিত কফি সংস্কৃতিকে হত্যা করেছে।
বৈরুতের বাকি অংশের মতো নিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার হামরা এলাকার একসময়ের জমজমাট কফির দোকানগুলিতে অন্ধকারের মধ্যে ওয়েটারদের উদ্দেশ্যহীন পদচারণা স্বত্ত্বেও অস্বাভাবিকভাবে শান্ত ও ফাঁকা হয়ে গেছে।
২০ বছর বয়সী লেবাননীয় মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে (এলএইউ) আন্তর্জাতিক ব্যবসায় নিয়ে পাঠরত ক্রিস্টিন বলেছেন, “আমি গত সপ্তাহে একটি কফি শপে গেলেও আমি কোন কফি পাইনি। সেখানে অনেক বেশি দাম। আমি সেখানে শুধু বন্ধুদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম।”
২০১৯ সাল থেকে লেবাননের অর্থনীতি মন্দার মধ্যে থাকায় হামরার কফি বার, রোস্টারি এবং ক্যাফেগুলিতে গ্রাহক কমতে থাকা আশ্চর্যজনক কিছু নয়। ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত জাতীয় মুদ্রা পাউন্ড তার মূল্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ হারিয়েছে। সঙ্কটের পরে বহুগুণে দাম বেড়েছে, বেতন ও মজুরি ধ্বসে পড়েছে, লেবাননের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হয়েছে, এবং সারাদেশের ব্যবসাগুলি টিকে থাকার জন্যে সংগ্রাম করছে৷ ডলার প্রতি ১,৫০০ লেবাননী পাউন্ড বিনিময় হারে ৬,৭৫,০০০ লেবাননী পাউন্ড বা ৪৫০ ডলার মাসিক জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ২০২১ সালে তার মূল্যের ৮৪ শতাংশ হারিয়ে বাংলাদেশী ৬,২০০ টাকারও নিচে নেমে এসেছে৷
এর ফলে হামরার কফি সংস্কৃতির ক্ষতি স্পষ্ট। অস্থির বিনিময় হারের মধ্যে কফির দাম দ্রুত স্ফীত হওয়ার কারণে অনেক নগদ অর্থহীন কফি-প্রেমী বৈরুতি এটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। শহরের অনেক বিপর্যস্ত বাসিন্দাদের জন্যে, হামরার কফিহাউসগুলির কোন একটিতে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে শিশা পান ও এক কাপ কফি উপভোগ করার নিত্যনৈমিত্তিক বিনোদনমূলক ভ্রমণগুলি অতীতের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের (এইউবি) ২১ বছরের গণমাধ্যম ও যোগাযোগের ছাত্র মানার বলেছেন, “আমি আর আগের মতো কফি পান করি না।” “এটা অনেক দামী হয়ে গেছে। সংকটের আগে আমি ব্লিস স্ট্রিটে দিনে কয়েক কাপ কফি খেতাম কিন্তু এখন আমি প্রতিদিন এক কাপের মধ্যে আমার খরচ সীমিত রাখি। এটা আমার মানিব্যাগের জন্যে সহজ আর আমি বাড়িতে গিয়ে আমার নিজের কফি তৈরি করে নিতে পারি।”
কফি: ‘একটি অযৌক্তিক খরচ’
বৈরুতের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হামরা স্ট্রিট এবং এর কফি শপগুলি গৃহযুদ্ধ, আক্রমণ, গুপ্তহত্যা এবং সহিংসতাপূর্ণ ক্ষুদ্র দেশটির অশান্ত ইতিহাস থেকে বেঁচে আছে। তবে চলমান অর্থনৈতিক সংকট একটি শক্তিশালী শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
কোন কোন জায়গায় এক শটের একেকটি এসপ্রেসোর গড় দাম এখন ২০ হাজার লেবাননী পাউন্ড, অন্যন্যাগুলিতে এক কাপ তুর্কি কফির দাম এখন ২৫ হাজার লেবাননী পাউন্ড ৷ কিছু জায়গায় একটি ক্যাপাচিনো এবং একটি সাধারণ সাদা কফি ৪০ হাজার লেবাননী পাউন্ড খরচ হয়। এই প্রেক্ষাপটটি এমন একটি দেশের যেখানে জ্বালানি ও ওষুধের দাম ক্রমাগত বাড়ছে এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ – ২০১৯ সালের তুলনায় ৬০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার পরও দৈনিক ন্যূনতম মজুরি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩০ হাজার লেবাননী পাউন্ড ৷
ক্রিস্টিনের মতে:
কফি এমন একটি অযৌক্তিক ব্যয়ে পরিণত হয়েছে যাকে অন্যান্য আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ের সাথে সাবধানে পরিমাপ করতে হয়।
মানুষের কফি খাওয়ার অভ্যাসের পরিণতি গুরুতর হয়েছে।
দৈনন্দিন কফির দামের দ্রুত বৃদ্ধিতে বিস্মিত বৈরুতিদের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে খুব বেশি দূরে তাকাতে হবে না। খাবার থেকে শুরু করে নাপিতের দোকানে ব্যবহৃত রেজারের ব্লেড পর্যন্ত —ভোক্তা চাহিদার বেশিরভাগ পূরণের জন্যে আমদানির উপর নির্ভরশীল এমন একটি দেশে সবকিছুই ডলারের বিপরীতে লেবাননীয় পাউন্ডের বিনিময় হারের দ্বারা প্রভাবিত হবেই।
“আমরা লেবাননে স্থানীয়ভাবে কফি চাষ করি না,” হামরার মেইন স্ট্রিটের রুয়ে মাকদিসির একটি ক্যাফে গুড_টু_গো-এর আলি হারব বলেছেন। “ক্যাফে মালিকরা বারিস্তা নামের বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিকারক একটি কোম্পানির কাছ থেকে কফি কেনে। যার ফলে কখনো কখনো আমাদের জন্যে ডেক্যাফ এর মতো নির্দিষ্ট ধরনের কফি যেমন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কফির দাম নির্দিষ্ট বিনিময় হারে কেনর উপর নির্ভর করে। যখন আমার গ্রাহকরা জানতে চান কেন তাদের কফির দাম বিনিময় হারের ওঠানামার সাথে কমে না, তখন আমি তাদের বলি যে আমরা ইতিমধ্যেই স্ফীত মূল্যে কফি কিনেছি, তাই স্ফীত মূল্যে এটি বিক্রি করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।”
কিন্তু বৈরুতে অনেকেই সাশ্রয়ী মূল্যের কফির চেয়ে দেশি কিছুর ঝুঁকির নিতে পারে না।
“এটা শুধু এক কাপ কফি কেনার সামর্থ্য না থাকার ব্যাপার নয়,” মানার আরো বলেছেন।
এলাকাটির পুরো কফি সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংকটটির প্রভাব শুধু হামরাতে কফি খাওয়ার পরিমাণকেই নয়, আমাদের সময় কাটানো সেসব ক্যাফেগুলির সাথে আমাদের সম্পর্ককেও প্রভাবিত করেছে। এটা কফি খাওয়ার বিষয় নয় – এটা ক্যাফেগুলিতে আমাদের একেক কাপ কফি ভাগাভাগি করে তৈরি সম্পর্কগুলির বিষয়। এগুলির সব কিছুর ওপরই এই সংকটের প্রভাব পড়েছে। ক্যাফেগুলো খালি পড়ে আছে। তারা আগের মতো ব্যস্ত নয়। হামরার কফি সংস্কৃতি মরে যাচ্ছে। এই সংকট একে হত্যা করছে।