সাংবাদিক কৃষ্ণ মণি বড়ালের এই নিবন্ধটি প্রথমে নেপালি টাইমসে নেপাল টাইমসে প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তু ভাগাভাগি করে নেওয়ার একটি চুক্তির অংশ হিসেবে এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনরায় প্রকাশ করা হয়েছে।
মৌসুমী বন্যা সাধারণত নেপালে মৃত্যু এবং ধ্বংস বয়ে নিয়ে এলেও সেটা হিমালয় থেকে বহমান নদীগুলিতে ভেসে আসা প্রাণীর মৃতদেহ ভক্ষণকারী পশ্চিম নেপালের পোখারা উপত্যকার শকুনদের জন্যে আসলে খারাপ কোন সংবাদ নয়।
শুরু থেকেই জোরেসোরে মৌসুমী বৃষ্টিপাতে মধ্য নেপাল জুড়ে বন্যা দেখা দেয় এবং ভূমিধ্বস শুরু হলে মহাসড়কগুলি অবরুদ্ধ হয়ে যায়। এটি মানুষের জন্যে দুর্দশা বয়ে নিয়ে এলেও তা এই খেচরদের জন্যে হয়ে ওঠে খাওয়ার উন্মাদনা উপভোগের একটি সময়।

পোখারার ফুস্রে নদীর তীরে একটি কুকুর হিমালয় গ্রিফন এবং সাদা ছোপ ছোপ শকুনের এক ঝাঁককে তাড়া করছে। নেপালি টাইমসের মাধ্যমে কৃষ্ণ মণি বড়ালের তোলা ছবি। অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।
অল্প ঢাল, মৃদু জলবায়ু এবং নিকটবর্তী ৮,০০০ মিটারের বেশি উঁচু অন্নপূর্ণা পর্বতশ্রেণীর কারণে পোখারা উপত্যকা হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশীয় নয়টি প্রজাতির শকুনের বাসস্থান।
সোজা উপর দিকে উড়ে গিয়ে চক্কর কেটে কেটে মাটিতে খাদ্য অনুসন্ধানের জন্যে উপত্যকাটির ভূমিরূপ শকুনদের জন্যে আদর্শ। উড়ন্ত শকুনদের অনুকরণ করে প্যারাগ্লাইডাররা প্রায়শই সারংকোটের উপরে পাখিদের সঙ্গী হয়ে খেলাধুলার জন্যে পোখারাকে একটি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে পরিণত করে তোলে।

পোখারার সারংকোটের একটি শকুন এবং একজন প্যারাগ্লাইডার। নেপালি টাইমসের মাধ্যমে কৃষ্ণ মণি বড়ালের তোলা ছবি। অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।
মৃত-রোগাক্রান্ত খাদ্যাভ্যাসের কারণে শকুনদের দুর্নাম থাকলেও তারা নেপালের বাস্তুতন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শবদেহ ভক্ষণের মাধ্যমে তারা মানুষ এবং এমন অন্যান্য প্রাণীকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। নেপালের পার্বত্য এলাকায় শকুনের জনসংখ্যা স্থিতিশীল মনে হলেও সমতল এলাকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল জুড়ে এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে শকুনদের আশ্রয়ের পাশাপাশি খাবারেরও ঘাটতি রয়েছে। উচ্চ-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক শকের কারণে এদের মৃত্যু সংখ্যাও বাড়ছে। এর উপর মারাত্মক কীটনাশক ব্যবহার করে নির্বিচারে অপ্রয়োজনীয় প্রাণী হত্যা এই উচ্ছিষ্টভোগীদের খাদ্যের উৎসকে দূষিত করে এদের গণমৃত্যু ঘটাচ্ছে।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে নাভালপাড়াসি এলাকার একটি কলেজ ক্যাম্পাসের মাঠে আইইউসিএন-এর মারাত্মক বিপন্ন পাখিদের তালিকাভুক্ত দু’টিসহ চারটি প্রজাতির (সাদা ছোপ ছোপ, হিমালয়ের গ্রিফনস, সিনেরিয়াস এবং সরু-ঠোঁট) ৬৯টি শকুন মৃত পাওয়া গেছে।
প্রাথমিক তদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কীটনাশক বিষ দিয়ে হত্যা করা কুকুর পাওয়া যায়, যা শকুনের সাধারণ খাদ্যের উৎস। ১৯৯০-এর দশকে রহস্যজনকভাবে মারা যেতে থাকা পাখিদের বিলুপ্তির মুখ থেকে রক্ষা করা নেপালের সফল প্রচেষ্টার জন্যে এই ঘটনাটি ছিল বিরাট এক ধাক্কা।
অসুস্থ প্রাণিসম্পদের চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক নামে একটি ব্যাথানাশক হলো এই হ্রাসের কারণ। ডাইক্লোফেনাকের মাত্র ৩০ মিলিগ্রাম ৮০০টি শকুনকে হত্যা করতে পারে। পরবর্তীকালে ২০০৬ সালে দক্ষিণ এশিয়া এবং নেপালে এই স্টেরয়েডটি নিষিদ্ধ করা হয়।
তখন থেকে দেশের স্থানীয় সম্প্রদায় এবং প্রকৃতি গোষ্ঠী এই খেচরদের খাওয়ানোর জন্যে নিরাপদ-অসংক্রমিত মাংস সরবরাহ এবং শকুন ছানাদের উদ্ধার যত্ন নেওয়ার জন্যে ‘জটায়ু রেস্তোঁরা’ (জেআর) – শকুন রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠা করাসহ শকুনের জনসংখ্যাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
কাসকির ঘাচোকের একটি জেআর-এ যেকেউ সহজেই প্রতিদিন ৫ থেকে ৬টি বিভিন্ন প্রজাতির শকুন দেখতে পাবেন। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একেকটি জেআর হলো শকুনদের জন্যে সম্প্রদায় পরিচালিত একটি খাওয়ানোর কর্মসূচি, যা সুরক্ষিত শকুন অঞ্চল (ভিএসজেড) সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এর প্রজাতিগুলিকে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করে। বৈশ্বিকভাবে মারাত্মকভাবে বিপন্ন সরু-ঠোঁট এবং সাদা ছোপ ছোপ শকুনরা বছরের পর বছর ধরে নির্মল পোখারি এবং ভারত পোখারি অঞ্চলে বাসা বেঁধে তাদের বাচ্চাদের লালন-পালন করে আসছে।

ফুস্রে নদীর তীরে শকুনেরা একটি ষাঁড়ের মৃতদেহ খাচ্ছে। নেপালি টাইমসের মাধ্যমে কৃষ্ণ মণি বড়ালের তোলা ছবি। অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।
তারাই ও এর পাদদেশ জুড়ে নওলাপারসি, রূপনদেহি ড্যাং, কৈলালী, কাসকি এবং সুনসারি জেলায় এখন অর্ধ ডজনেরও বেশি জটায়ু রেস্তোরাঁ রয়েছে। এই প্রচেষ্টার ফলে ১৬ লক্ষ থেকে ২০ হাজারের মধ্যে নেমে আসা নেপালের শকুনের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।