বাংলাদেশে উনিশশো নব্বই দশকের প্রজন্মের কাছে টিনটিন এক নস্টালজিয়ার নাম। অন্য এক আবেগ জড়িয়ে রয়েছে তার সঙ্গে। কৈশোরে স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, পাড়ার লাইব্রেরি কিংবা বড়দের কাছ থেকে বাংলা কমিক ধার নিয়ে এসে টিনটিনের সাথে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়া ছিল নিত্যদিনের রুটিন।
অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিনটিন (তাতা) হ'ল বেলজিয়ামের কার্টুনিস্ট হের্গের (আসল নাম জর্জেস রেমি) অমর কীর্তি — ফরাসী ভাষায় ২৪টি কমিক বই এর (বিডি) সিরিজ — যেখানে টিনটিন নামে একজন তরুণ বেলজিয়ামের সাংবাদিক তাঁর কুকুর স্নোই অভিযানে বেড়িয়ে পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম কঙ্গো, পেরু, ভারত, মিশর, মরোক্কো, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, তিব্বত, চীন ইত্যাদি অনেক দেশে। কিন্তু, আক্ষেপের ব্যপার হ'ল তারা বাংলাদেশে কখনো আসেননি।
তবে কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় টিনটিনের দেখা পাওয়া গেল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়, কখনো চট্টগ্রাম, কখনো বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারে। কার্টুনিস্ট জাহিদুল হক অপু দেশজুড়ে ঐতিহাসিক স্থানগুলিতে প্রিয় কমিক বইয়ের চরিত্রকে নিয়ে গিয়ে তাঁর শৈল্পিক চিত্রায়ন ‘বাংলাদেশে টিনটিন’এর মাধ্যমে টিনটিনের স্মৃতি পুনরুত্থিত করেছেন। তার এই দুঃসাহসিক কাজগুলি ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরেছে।
ইংরেজি সংস্করণের পাশপাশি বাংলাতেও কমিক্সগুলো অনূদিত হয়েছিল। টিনটিন সিরিজের জনপ্রিয় বাংলা অনুবাদ ভারত থেকে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশ করেছিল ১৯৯০ এর দশকে। টিনটিনের অনুরাগী এবং ব্লগার রাসেল জন তার ব্লগে অনুবাদিত সিরিজের সমস্ত মূল কভার আর্ট তুলে দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন:
১৯৮৮ সালে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কমিক বইয়ের প্রথম শিরোনামটি ছিল “তিব্বতে টিনটিন”। এর পরের বছর “কাস্টাফিয়োরের পান্না”, এবং ২০০৬ সালে ঐ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ শিরোনাম ছিল “কঙ্গোতে টিনটিন”।
টিনটিনকে বাংলাদেশের আনার পেছনের রূপকার শিল্পী জাহিদুল হক অপু। তিনি আরজে অপু নামেই বেশি পরিচিত। ১৫ বছর ধরে রেডিও ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন। বর্তমানে একটি রেডিও স্টেশনের প্রোগ্রাম হেড হিসেবে কর্মরত আছেন। পেশা রেডিও জকি হলেও, নেশা আঁকাআঁকি করা।
গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা’র পক্ষ থেকে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম জাহিদুল হক অপু’র সাথে। মুঠোফোনের মাধ্যমে তার বাংলাদেশে টিনটিন ফ্যান আর্ট নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। চলুন, শুনে আসি অপুর মুখেই।
ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকির ঝোঁক ছিল। কিন্তু সেটায় সময় দিতে পারছিলাম না। করোনা এসে সেই সুযোগ করে দেয়। কারণ, তিন মাস আগে আমি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। টানা ২১ দিন সবার থেকে আলাদা ছিলাম। এ সময় মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে ভালো ছিলাম না। কিছুই ভালো লাগতো না। যেহেতু কিছুই করার নেই, ভাবলাম, আঁকাআঁকিতে একটু সময় দিই।
হঠাৎ একদিন কৈশোরের পছন্দের চরিত্র টিনটিনের কথা মাথায় এলো। ছোটবেলায় টিনটিনের খুব ফ্যান ছিলাম। টিনটিন তখন বাংলা অনুবাদে বের হতো। বাংলায় পড়তাম। কিন্তু রাস্তাঘাট, গাড়ি-ঘোড়া, মানুষজন সবকিছুই বিদেশি। বাংলাদেশি কিছু নাই। তখন বুঝতাম না কিছু। তাই মনে প্রশ্ন আসতো, টিনটিন কেন বাংলাদেশে আসে না
[..] সেই ভাবনা থেকেই টিনটিনকে আঁকতে শুরু করি।
ফেসবুকে অপু তার নিজের টাইমলাইনে টিনটিনকে নিয়ে করা ফ্যান আর্ট পোস্ট করেন। কাজগুলি সবার ভালো লাগে। সবাই তাকে উৎসাহ দেন। এরপর কাজগুলি ব্যাপক শেয়ার হতে থাকে। এমনকি ফেসবুকে একটি জনপ্রিয় টিনটিন ফ্যান গ্রুপেও তা ছড়িয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসাহ পেয়ে আর্টস বাই অপু নামে ফেসবুকে একটা পেইজ খোলেন। সেখানেই ফ্যান আর্টগুলো নিয়মিত আপলোড করে থাকেন। এ পর্যন্ত তার ৮০০০ এর বেশী ফলোয়ার হয়েছে।
টিনটিন নিয়ে তার আঁকাগুলো নিয়ে মূলতঃ ফেসবুকে মানুষের কাছ থেকে তিনি প্রচুর মন্তব্য পেয়ে থাকেন। চাঁদপুরের আদনান সৈকত তাঁর শিল্পের প্রশংসা করেছেন:
আমাদের চাঁদপুরের লঞ্চঘাটের সাথে বেশ মিলে গেলো। গেইট দিয়ে ঢুকে হাতের ডান পাশ ঠিক এমনই! সুন্দর…
শুধু ঐতিহাসিক স্থান নয়, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং কাল্পনিক চরিত্রের মিশ্রণ – এই উদ্ভাবনী ফিউশন তৈরি করতে শুরু করেছেন অপু। তার সর্বশেষ শিল্পগুলোর একটিতে, টিনটিনকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিকশনাল চরিত্রের একটি বাকের ভাইয়ের সাথেও দেখা গেছে।
ফেসবুকে জাসারাত আল আতুন মন্তব্য করেছেন এ নিয়েঃ
ইশ যদি এই কনসেপ্ট আর্ট এর উপর সত্যি একটা কমিক বুক বানানো হত!
অপু জানাচ্ছেন বাকের ভাইয়ের মত চরিত্র কে নিয়ে আসার পিছনের কারণঃ
আমার একটা মেয়ে আছে। ৬ বছর বয়স। ভীষণ কৌতুহলী। ওকে আমি আমার ছেলেবেলা, নব্বই দশকের কথা বলি, কিছু বোঝে; আবার অনেক কিছুই বোঝে না। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ঘরে বন্দি আছে। বাংলাদেশকেও ওকে ঘুরিয়ে দেখাতে পারি নাই। তখন মাথায় এলো, বাচ্চারা যেটা পছন্দ করে, সেটার মাধ্যমে যদি চেনানো যায়। আমার মেয়ে টিনটিন পছন্দ করে। তাই টিনটিনের থ্রুতে ওকে বাংলাদেশ চেনানো শুরু করি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তরা টিনটিনকে বাংলাদেশে দেখে স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়েছেন। তাদের নিজেদের শহরে বা এলাকায় দেখতে চাচ্ছেন। এ সম্পর্কে অপু জানাচ্ছেনঃ
টিনটিনকে নিয়ে আমার ফ্যান আর্ট দেখে অন্যরাও যখন নস্টালজিক হন, তখন মনে হয়, আমি একা নই, আমার মতো আরো অনেকেই আছেন। টিনটিনকে বাংলাদেশের আরো বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক, কতোটা পারি।