অ্যামাজন প্রাইমের ধারাবাহিকে ইলম তামিলের কথা ও ইতিহাসকে মারাত্মক ভুলভাবে উপস্থাপন

Screenshot from the YouTube Video by user "Soch by Mohak Mangal".

কিছু কিছু তামিল পারিবারিক পুরুষ – মরশুম ২ কেন বয়কট করছে তা ব্যাখ্যা করা ব্যবহারকারী “মোহাক মঙ্গলের সোচ” এর একটি ইউটিউব ভিডিওর পর্দাছবি।

২০২১ সালের মে মাসে অ্যামাজন প্রাইমে দ্বিতীয় মৌসুম শুরু করা একটি ভারতীয় অ্যাকশন থ্রিলার টিভি ধারাবাহিক নাটক দ্যা ফ্যামিলি ম্যান (পারিবারিক পুরুষ) চূড়ান্ত বর্ণবাদী এবং সমস্যাজনকভাবে (শ্রীলংকার তামিল) ইলম তামিলদের চিত্রিত করে গভীর বিতর্কে জড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন ডিএমকে (দ্রাবিড় প্রগতিশীল ফেডারেশন) সরকার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন টিভি প্রদর্শনীটির উপর নিষেধাজ্ঞার দাবি করেছে

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ওটিটি (ওভার দ্য টপ) মঞ্চ অ্যামাজন প্রাইম একটি ভারতীয় গুপ্তচরবৃত্তির ধারাবাহিক দ্যা ফ্যামিলি ম্যান প্রচার করেছে, যেখানে মুম্বাইয়ের একজন ছদ্মবেশী মধ্যবিত্ত ব্যক্তিকে ঝামেলাপূর্ণ ব্যক্তিগত জীবন যাপনের পাশাপাশি রাতের বেলা গোয়েন্দা কর্মী হিসেবে কাজ করতে দেখা যায়।

ধারাবাহিকটির প্রথম মৌসুমে একটি নাটকীয় অভিঘাতের মাধ্যমে  গভীরভাবে প্রোথিত ভয়, টগবগে উত্তেজনা, লুক্কায়িত বাসনা, এবং রাজনৈতিক বর্ণনার পাশাপাশি বন্ধনহীন রোমাঞ্চের মতো সবকিছু অনুসরণের মাধ্যমে স্তরযুক্ত গল্পকথন প্রদর্শন করা হয়েছে। কাহিনীটি মূলত কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চারদিকে আবর্তিত হয়ে অর্থহীন হাস্যরসের মাধ্যমে সহিংস উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলিকে যুক্ত করার পাশাপাশি উগ্রজাতীয়তাবাদ ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে গৎবাঁধা আলোচনা উস্কে দিয়ে প্রদর্শনীটিকে পলাতক গ্রীষ্মের আলোচিত একটি অবস্থানে নিয়ে যায়।

২০২১ সালের ১৯ মে প্রকাশিত ২য় মৌসুমের ট্রেইলারটি তামিল ইলমের স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্যে আইসিস (জঙ্গি সংগঠন) এর সাথে হাত মিলিয়ে ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনাকারী সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর উস্কানিমূলক বোধশক্তিহীন বাগাড়ম্বরপূর্ণ চিত্রনাট্য ভারত ও শ্রীলঙ্কা জুড়ে সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে তামিল সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যাকে অনেকেই দুই দেশের মধ্যকার অতিসরলীকৃত রাজনীতি বলেছে।

প্রকাশ পরবর্তী মিশ্র প্রতিক্রিয়া

প্রথম প্রদর্শনীর প্রায় চার সপ্তাহ পরে ধারাবাহিকটিতে মূলত ইলম তামিল আন্দোলনকে অসম্মানিত করে তামিল-বিরোধী বক্তব্যকে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইলম তামিল ও তাদের তামিলনাড়ু সমর্থকদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্যে বিশ্বজুড়ে তীব্র মিশ্র প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

একটি সাম্প্রতিক ইউটিউব ভিডিওতে তামিল ডিজিটাল মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে পরিচিত ইউটিউবার রাজমোহন আরুমুগাম প্রদর্শনীটির সমালোচনা করেছেন:

ভিডিওটি থেকে নেওয়া অংশের অনুবাদ: ভিডিওটি থেকে নেওয়া অংশের অনুবাদ: “তামিল ইলম” শব্দটিকে কেন ঘৃণা ও অবজ্ঞা করা হয়? এই চলচ্চিত্র নির্মাতারা কেন শুধু শ্রীলঙ্কায় প্রযুক্ত  সিংহলা একক আইন হিসেবে পরিচিত ১৯৫৬ সালের আনুষ্ঠানিক ভাষা আইন নিয়ে কথা বলতে ব্যর্থ? সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা ফাদার লি কুয়ান ইউ তার জাতি তৈরিতে কঠোর শ্রম দেওয়া তামিলদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে তামিল ভাষাকে একটি সরকারি ভাষা হিসেবে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে শ্রীলঙ্কায় ঐতিহাসিকভাবে সিংহলি জনগণের সাথে একসাথে বসবাস করা তামিল জনগণকে ধ্বংস করার জন্যে আনীত বর্জনের নীতিগুলি নিয়ে কারো এরকম কোন সেলুলয়েড কল্পনাবিলাস নথিবদ্ধ করার চিন্তা আছে বলে মনে হয় না।

দর্শক-শ্রোতারা টেলিভিশন অনুষ্ঠানটির মানসিক স্বাস্থ্য, লিঙ্গচিন্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাবগুলি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। তামিল সিনেমা কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র সমালোচক রাজেশ রাজমণি টুইটারে ধারাবাহিকটির বিশ্লেষণে বলেছেন:

ভারত সরকার যেভাবে তাদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাগুলিকে প্রভাবিত করে তাতে ভারতে ইলম তামিল শরণার্থীদের জীবন ইতোমধ্যে একটা লড়াইয়ে পর্যবসিত। সম্ভাব্য ‘জঙ্গি’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিত্রিত করে এই ধারাবাহিকটি তাদের জীবনকে আরো খারাপ করে তুলেছে।

(পুরো আলোচনাসুত্রটি এখানে পড়ুন)

নির্মাতাদের বিরুদ্ধেও সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি, পুনরুদ্ধার ও বেঁচে থাকার জন্যে আন্তঃজন্মের সংগ্রামগুলির প্রতি মারাত্মকভাবে অসম্মানজনক নির্জলা বিভাজনমূলক চরিত্রায়ণ এবং সূত্রবদ্ধ সৃজনশীল সিদ্ধান্তে লিপ্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, “সত্যিকারভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে” বাদামী-মুখাবরণ নিয়ে রাজি (একজন মহিলা ইলম সৈনিক) চরিত্রে সাদা-চামড়ার একজন দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী সামান্থা আক্কিনেনি অভিনয় করেছেন। এটা অবজ্ঞাপূর্ণভাবে বর্ণবাদী ইঙ্গিত এবং কালো-বিরোধী বক্তব্যকে উৎসাহিত করে এবং এর মূল বর্ণবাদে প্রোথিত

টুইটার ব্যবহারকারী @রিডস্পিডস অনলাইনে নির্লিজ্জ বর্ণবাদের অভিযোগ করেছেন:

ঠিক আছে এখানে বিষয়টা হলো: আমি পারিবারিক পুরুষ এর ধারাবাহিক-২ দেখছি। তবে, চরিত্রটির সাথে মানিয়ে নিতে তারা সামান্থা আক্কিনেনির ত্বককে  আক্ষরিক অর্থেই কালো করেছে। ভাই, শুধু কালো ত্বকের কাউকে ভাড়া করাটা তেমন কঠিন নয়

অন্যান্য পর্যালোচনাতে ধারাবাহিকটি ইতোমধ্যে নিপীড়িত সম্প্রদায়ের বোঝাটিকে কীভাবে আরো ভারী করেছে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেছে। সাংবাদিক @বালা_জি টুইট করেছেন:

পুরো পারিবারিক পুরুষ ধারাবাহিকটি খুব সমস্যাপূর্ণ। এতে প্রকট ইসলামভীতি রয়েছে। তারা এটাকে ‘নিরপেক্ষ’ করার চেষ্টা করলেও এটা দেখা অস্বস্তিকর। এবং সেটা সর্বশেষ সিক্যুয়েলের জন্যেও প্রযোজ্য। সামান্থার ‘বাদামী মুখ’ বানানোটা সামান্য সমস্যার। এবং সত্যিকারভাবেই সে ভয়ানক।

বাস্তব এবং কল্পনার মাঝামাঝি

তবে কিছু কিছু ভক্তের কাছে সমালোচনাগুলিকে দূরবর্তী এবং অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়েছে। অনেকেই পুরানো স্কুল বলিউড শৈলীর সাথে সম্পর্কিত চিত্রায়নের সাথে সহমত এবং সমঝোতার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট। অন্যান্যরাও ক্লান্তিকরভাবে চাপানো বিভিন্ন ধরনের সাধারণ উপমাগুলি উপভোগ করেছে  মনে হয়, যেমনটা স্রধাঞ্জল্লি পাত্রের চিন্তাশীল মন ব্লগের পর্যালোচনাতে উল্লেখ করা হয়েছে:

[..] পরিচালকরা প্রদর্শনীটিতে মাতৃভাষায় কথা স্থানীয় অভিনেতাদের নিয়েছেন। অন্যান্য অঞ্চল থেকে লোক নিয়ে তাদের কণ্ঠস্বর মেলানো অথবা এখনো পর্যন্ত অস্তিত্বশীল গৎবাঁধা কিছু  চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে এটা বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে। [..] এটা সত্য সত্যই তামিলদের মতোই দেখিয়েছে।

তামিল যুদ্ধের শরণার্থী এবং তামিল জনগণের মতো বৈচিত্রময়  জীবন্ত অভিজ্ঞতা না থাকা জনগণ আদৌ এই কথা বলতে পারে কীনা সেটা এখনো ভাবনার বিষয়।

তামিল ইলম জনগণের সংগ্রাম:

Areas in India and Sri Lanka where Tamil is spoken.

ভারত এবং শ্রীলঙ্কার যে অঞ্চলগুলিতে তামিল ভাষায় কথা বলা হয়। উইকিপিডিয়া মাধ্যমে পাওয়া প্লেনম্যাডের চিত্র। সিসি বাই-এসএ ৩.০

শ্রীলঙ্কা জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় একটি দেশ যার ভূগোল সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী এবং স্থানীয় তামিল সংখ্যালঘুদের মধ্যে উপনিবেশোত্তর বিরোধে কালিমা লিপ্ত। সদ্য ঔপনিবেশিকতামুক্ত শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধধর্মকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রাথমিক ধর্ম এবং সিংহলিকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা এবং স্থানীয় তামিলদের ভোটাধিকার বঞ্চিত করে তাদের জীবন-জীবিকাকে সংকুচিত করার মাধ্যমে বৈষম্যমূলক আইন ও নীতিমালা প্রয়োগ করে। এই পরিস্থিতিটি ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশ লাভের জন্যে বেশ কয়েকটি প্রান্তিক তামিল গোষ্ঠীর উত্থান ঘটালে জাতিগত উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এর ফলে সৃষ্ট ব্যক্তিগত দুর্ভোগ পথের কাঠামোটি তৈরি করে একটি স্বতন্ত্র স্বদেশের (বা ইলাম) স্বপ্নকে আরো গভীর করে। এসবই দুই দলের মধ্যেকার ভাষাগত, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উত্তেজনাকে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত করে।

ক্ষমতার এই লড়াই প্রায় তিন দশক স্থায়ী এবং ২০০৯ সালের মে মাসে সিংহলি অধ্যুষিত শ্রীলঙ্কা সরকারের অনুকুলে শেষ হয়। ইলম তামিল সম্প্রদায় বর্তমানে যুদ্ধোত্তর মানসিক আঘাতে খাবি খাচ্ছে।

ভারত এবং বিদেশের জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলি তামিল জনগণের সমস্যা উপস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চলচ্চিত্র সমালোচক রাজেশ রাজামণির মতে, ইলম এবং তামিল চরিত্রগুলি নিয়ে একতরফাভাবে অবিবেচকের মতো খেলা করা এবং “তাদের জীবনকে তাদের নিজস্ব বিবরণ থেকে ভিন্ন ও ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপনের জন্যে চলচ্চিত্রকারদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার তামিল প্রবাসীদের মধ্যে প্রদর্শনীটি প্রত্যাহার করার দাবি বিশ্বজুড়ে অনুরণিত হচ্ছে। চেন্নাই ভিত্তিক তামিল অধিকার কর্মী মোহন কিচ এবং কুড্ডালোর ভিত্তিক কর্মী তামিজ সিলান টুইটারে মতামত দিয়েছে:

ভারত বিশ্বের কাছে তামিল টাইগারদের আইএসআইএসের এর সাথে যুক্ত হিসেবে দেখাচ্ছে। #পরিবার_পুরুষ২ স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। আমরা এর প্রশংসা করছি না এবং বিতরণকারীদের এই রাজ্যে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন না করার অনুরোধ করছি।  @সামান্থাপ্রভু২ – তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ সামান্থা। #তামিলবিরোধী_পরিবারপুরুষ২

এটা ছিল নিপীড়নকারী শ্রীলঙ্কা সরকার এবং তামিল টাইগারদের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় সংঘটিত একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিন্দা করা বন্ধ কর @রেইনডিকে #তামিলবিরোধী_পরিবারপুরুষ২

এসব সত্ত্বেও নির্মাতারা একটি “সংবেদনশীল, ভারসাম্যপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় গল্প” নিশ্চিত করার কষ্ট সহ্য করে পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ধারাবাহিকটি প্রকাশ করেছেন বলে আশ্বস্ত করে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .