পরিবেশ বিনষ্টের হুমকির মুখে “সমুদ্রের লালা” দ্বারা আচ্ছাদিত মর্মর সাগর

পাতলা সমুদ্রের শ্লেষ্মার দ্বারা নৌকো অবরুদ্ধ।

পাতলা সমুদ্রের শ্লেষ্মার দ্বারা নৌকো অবরুদ্ধ। আল জাজিরার ইউটিউব চ্যানেলের একটি ভিডিওর স্ক্রিনশট, যার নাম “তুরস্কের “সমুদ্রের লালা”: ঘন শেত্তলা শ্বাসরোধ করেছে জলজীবন।

মর্মর সাগর একটি পরিচ্ছন্ন জলরাশি, যা দারদানেলিস প্রণালী থেকে বসফরাস প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত। গত মে মাসের শেষদিকে মর্মর সমুদ্র একটি দুর্ভাগ্যজনক কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে।

“সমুদ্রের লালা” কি এবং কেন এটি হয়ঃ

মর্মর সাগরে একটি “পাতলা, জৈব ফেনা” ছড়িয়ে গেছে যা আনুষ্ঠানিকভাবে “সামুদ্রিক মিউসিলেজ(শ্লেষ্মা)” নামে পরিচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি অণুবীক্ষণিক শ্যাওলা জাতীয় পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, দ্বারা গঠিত হয়। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নিজে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়,তবে ক্রমবর্ধমান জলের তাপমাত্রা, জলে বর্জ্য, কীটনাশক এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার সাথে মিলে এটি দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এইসব বাহ্যিক কারণে শ্লেষ্মা দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করে ছড়িয়ে যায় যা ক্ষতিকারকভাবে জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে – যেমন সূর্যের আলো জলে প্রবেশ করে বাধা দেয় এবং সমুদ্রের জলে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস করে।

আনাদোলু এজেন্সির মতে, এই ঘটনাটি প্রথম নয়। এর আগে ১৯৯৭ সালে এটি প্রথম এবং পরে ২০০৭ সালেও দারদানেলিস এবং মর্মর সমুদ্রের কাছাকাছি এরকম দেখা গিয়েছিল। তবে এই বছরের প্রাদুর্ভাব সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব ফেলছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রথম এটি লক্ষ্য করা গেছে, তবে সময়ের সাথে সাথে এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় এবং জুনের মধ্যে কাছাকাছি সমুদ্র উপকূলগুলি শ্লেষ্মার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ঢেকে যায়। এটি সমুদ্রের পৃষ্ঠ থেকে ৮০ থেকে ১০০ মিটার নীচে পর্যন্ত প্রবেশ করেছে এবং সমুদ্রের তলে আরও ডুবে যেতে পারে।

দ্য সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনে একটি সাক্ষাৎকারে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্তা বারবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিদ এবং অধ্যাপক এমেরিটাস অ্যালিস অলরেডজ “সামুদ্রিক লালা”কে সংজ্ঞায়িত করেছেন:

বিভিন্ন ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন প্রজাতির দ্বারা তৈরি শ্লেষ্মাকে বোঝানোর জন্য “সামুদ্রিক লালা” একটি ডাকনাম যা বেশ প্রচলিত হয়েছে। এতে ব্যাকটিরিয়া থেকে উৎপন্ন শ্লেষ্মার উপাদানও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে এবং এমন কোনও কোষও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যা ভাইরাস আক্রমণ থেকে মুক্ত হয়ে তাদের প্রোটোপ্লাজম উন্মুক্ত করেছে। এভাবেই এই শ্লেষ্মার কলেবরে বেড়ে ওঠে। এটির গঠন বেশিরভাগ পলিস্যাকারাইড উপাদান দিয়ে – যা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন থেকে পাওয়া যায় – তবে এতে উপরোক্ত অন্যান্য সম্ভাব্য উপাদান ও থাকে।

অলরেজ বলেছেন, তার প্রধান উদ্বেগ হ'ল যদি শ্যাত্তলাগুলি ডুবে যেতে থাকে তবে এটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করতে পারে এবং বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি সম্ভাব্যভাবে প্রবাল, মাছ এবং ক্ষুদ্র ক্রাস্টেসিয়ানদের হত্যা করতে পারে কারণ শ্লেষ্মার কারণে তাদের জন্যে জলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকবে না। সামুদ্রিক জীবনের বেশিরভাগের বেঁচে থাকা নির্ভর করে যথেষ্ট পরিমাণে দ্রবীভূত অক্সিজেনের উপর – অর্থাৎ অক্সিজেনের অণু জলে মিশে যাবার উপর। বর্তমান পরিস্থিতিতে, শ্যাওলা মরে গিয়ে পচে গেলে এটি দ্রবীভূত অক্সিজেন দখল করে নেয় যা মাছ এবং অন্যান্য জলজগুলির জীবন ধারণের মুল উপজীব্য।

টার্কিশ মেরিন রিসার্চের অধ্যাপক বায়রাম ওজতুক একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে:

মিউসিলাজের অত্যধিক বৃদ্ধির কারণে বেশ কয়েকটি প্রজাতি হুমকির মুখে রয়েছে, [যেমন] অয়েস্টার, ঝিনুক, সি স্টার … এটি আসলেই একটি আসন্ন বিপর্যয়।

বিশেষজ্ঞরা “সমুদ্রের লালা”‘র উত্থানের জন্যে দূষণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর সংমিশ্রণকে দায়ী করেছেন যা পাতলা শ্লেষ্মাকে জন্য দায়ী শ্যাত্তলাগুলির বৃদ্ধিকে তরান্বিত করেছে। রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাইড্রোবায়োলজিস্ট লেভেন্ট আর্টুজ পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ করার জন্য বিশ্ববাসীকে তাদের আচরণ পরিবর্তন করার আহ্বান জানানঃ “যতক্ষণ আমরা এইসব (দূষণ) চালিয়ে যাব, ততক্ষণ ভিন্ন ফলাফল আশা করা করা অবান্তর।” সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উপকূলীয় জলে নর্দমার স্রাবের দূষণের বর্ধিত হারের বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমরা এ জাতীয় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতেই থাকব।”

ক্ষতিগ্রস্থ শিল্প

মর্মর সাগর অঞ্চলে মাছ ধরা হল এলাকাবাসীর অন্যতম বৃহত্তম আয়ের যোগানদার। এ অঞ্চলে পাওয়া মাছের মধ্যে নীলফিশ, গার-ফিশ এবং ঘোড়া ম্যাকেরেলের মতো পরিযায়ী মাছ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যারা ভূমধ্যসাগর থেকে আসে। তারা এরপর মর্মর সাগর দিয়ে কৃষ্ণসাগরে পৌঁছায়। ম্যাকেরেল, সোর্ডফিশ এবং কম্বার ও এ অঞ্চলে পাওয়া যায় এবং অনেক জেলের আয় এদের উপর নির্ভরশীল। বর্ধিত “সমুদ্রের লালা”র কারণে এদের মধ্যে কিছু মাছ অকালে মারা যাচ্ছে

অন্যরা আশঙ্কা করছে যে “সমুদ্রের লালা” পর্যটনকে প্রভাবিত করবে, এটি এমন একটি শিল্প যা ইতিমধ্যে কোভিড-১৯ বিধিনিষেধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত

তুরস্ক সরকার দ্রুত কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গত ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে রাষ্ট্রপতি এরদোগান ইস্তাম্বুলে একটি জাতীয় উদ্যানের উদ্বোধন সভায় অংশ নিয়েছিলেন যেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সমস্যার সমাধান করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন যে “সমুদ্রের লালা”র কারন হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি ও মানুষ কর্তৃক মর্মর সাগরে বর্জ্য ফেলা।

সরকার “সমুদ্রের লালা” দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করতে ৩০০ সদস্যের একটি দল পাঠিয়েছে

“যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন তবে আমরা আমাদের সমুদ্রকে এই সব শ্লেষ্মা থেকে রক্ষা করব। আমি আশঙ্কা করি যে এটি কৃষ্ণসাগরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি করা উচিত [পরিষ্কার করা] … আমাদের বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই শ্লেষ্মা সমস্যাটি দুর করা যেতে পারে। “

এ ছাড়াও, তিন মাসের জন্য মিউজিলেজ এবং এর কারণগুলি পরিদর্শন ও তদন্ত করার জন্য একটি ১৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরিবেশমন্ত্রী মুরাত কুড়ুম ১৫ই জুন টুইট করেছেন যে ৭ দিনে তারা আক্রান্ত অঞ্চলগুলি থেকে ২,৬৮৪ ঘনমিটার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করেছে। তার সর্বশেষ একটি টুইটে তিনি তাদের পরিষ্কার করার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আরও তথ্য দিয়েছেন।

“তদন্ত চালিয়ে নিবিড়ভাবে শ্লেষা পরিষ্কার করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ১৫ই জুন থেকে আমরা ৩,২২৯টি তদন্ত শেষ করেছি এবং যেসব সংস্থা তাদের আইনী বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে না তাদের জন্য আমরা ১কোটি ৪৯ লক্ষ ৫০ হাজার টার্কিশ লিরা জরিমানা করেছি।

পরিবেশ ও নগরায়ণ মন্ত্রী মুরাত কুড়ুম গত ১৬ই জুনের এক বিবৃতিতে বলেছিলেন যে মোট ৩,২৮৮ ঘনমিটার শ্লেষাকে মর্মর সাগরের নিকটবর্তী স্থলভূমিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। ২০ শে জুন অবধি, ২৯৩ টি স্থানে অভিযান চালিয়ে মোট ৫,০০০ ঘনমিটার শ্লেষা সংগ্রহ করা হয়েছিল

২২শে জুন আর একটি বিবৃতিতে কুরুম বলেছিলেন, পরিস্কার দলগুলি কোকেলি উপসাগরীয় অঞ্চলের ৪ টি পয়েন্ট থেকে ৩০ মিটার গভীরতায় এবং ইস্তাম্বুলের পেন্ডিক জেলার উপকূলে অবস্থিত আরেকটি এলাকায় অক্সিজেন ভরার জন্যে প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা, এবং সফল হলে মন্ত্রণালয় শ্লেষ্মা দ্বারা প্রভাবিত অন্যান্য জায়গাগুলিতে একই প্রযুক্তি অনুমোদন করবে। এখন অবধি, পরিষ্কার দলগুলি সমুদ্রের উপরিভাগের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নৌকা দিয়ে বাধা দেয়ার ব্যবস্থা করছিল, এছাড়া ও ১৮টি জাহাজ শ্লেষ্মা ছড়িয়ে পড়ার প্রতিরোধে কাজ করছে। এরই মধ্যে, কর্তৃপক্ষগুলি ১৪টি শিল্প কারখানার কার্যক্রম স্থগিত করেছে যা মর্মর সাগর দূষিত করেছিল। সরকার আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে মর্মর সমুদ্রের জন্য নতুন সুরক্ষা প্রবর্তন করার।

তবে চলমান পরিচ্ছন্নতার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শ্লেষ্মা সমস্যাটি অব্যাহত রয়েছে। গত ১৬ই জুন একদল ডুবুরি ইস্তাম্বুলের উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপের কাছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ মিটার নিচে ডুব দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটি তদন্ত করে। হুরিয়াত নিউজের এক খবরে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে ডুবুরিরা আবিষ্কার করে যে ক্ষতি আরও বেড়েছে, এবং সমুদ্রের জলের অতলে শ্লেষ্মার জাল বেড়ে যাওয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না এমনকি সমুদ্রের তলদেশে শ্লেষ্মা ছড়িয়ে গেছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .