পেরুর আদিবাসীরা আমাজন বনে চীনা কোম্পানির তেল আহরণের নিন্দা করছে

অ্যামাজন বন, পিক্সাবে থেকে নেওয়া ছবি।

পেরুর বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী ও স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা তাদের সম্প্রদায়গুলিতে চীনা বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতে তাদেরকে অন্তর্ভুক্তি এবং সেটা যেন পরিবেশের ক্ষতি করে করা না হয় তা নিশ্চিত করার জন্যে উদ্ভাবনী প্রচারণা কৌশল ব্যবহার করছে।

দক্ষিণ পেরুর কাস্কো প্রদেশে অবস্থিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্লকটিই হলো ৫৮ নং ব্লক, যেখানে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুত রয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে এটা বিশেষভাবে চীনা তেল-গ্যাস সংস্থা চীন জাতীয় পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ৫৮ নং ব্লকটি এছাড়াও সুরক্ষিত চিরসবুজ অ্যামাজন বনের প্রাকৃতিক সংরক্ষিত অঞ্চলের পাশাপাশি টাঙ্গোশিয়ারি, কিরিগুয়েতি ও কোচিরির মতো বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের সমপতিত।

এসব আদিবাসী সম্প্রদায় ও স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার দাবি আহরণকারী সংস্থাগুলি যেন সেখানে বৃহত্তর স্বচ্ছতা, পরিবেশ এবং আদিবাসী মানুষ হিসেবে তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।

৫৮ নং ব্লকে নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছাড়াই প্রকল্পের জন্যে নতুন ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বেসরকারি সংস্থা অধিকার, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ (স্পেনীয় শব্দসংক্ষেপ ডিএআর) এর মাধ্যমে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকারের পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী ডেনিস লিনারেস।

পরিস্থিতিটি সামাল দিতে, পেরু সরকারকে আরো বেশি করে আদিবাসীদের পরামর্শের অধিকারের সুরক্ষা প্রদান এবং কোম্পানিগুলিকে জবাবদিহি করানোর জন্যে বেসরকারি ও আদিবাসী সংস্থার একটি জোট একসাথে হয়েছে

“আগে থেকে পরামর্শ করাটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে সম্প্রদায়গুলি তাদের জীবনে সম্ভাব্য প্রকল্পগুলি প্রভাবজনিত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে,” লিনারেস হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে গ্লোবাল ভয়েসেসকে জানিয়েছেন। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্তঃপ্রবাহ সত্ত্বেও অঞ্চলটির আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির অধিকার বা জীবনযাত্রার মানের কোন উন্নতি হয়নি। বর্তমানে স্থানীয় জনসংখ্যার অন্তত ২৩ থেকে ২৬ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

৫৮ নং ব্লকের কাছে পেরুর অ্যামাজন বন। ডিএআর থেকে পাওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

৫৮ নং ব্লকের মূল চালিকা হলো চীনের বৃহত্তম তেল-গ্যাস সংস্থা চীন জাতীয় পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (সিএনপিসি)। ২০১৭ সালে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মনে করা এই দানবীয় তেল সংস্থাটিকে  ৫৮ নং ব্লক অন্বেষণ ও আহরণে পেরু সরকারের অনুমতি পেয়েছিল। ২০২৩ সালের মধ্যে সংস্থাটি ৪.৪ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৭,৪০০ কোটি বাংলাদেশী টাকা) বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে।

গত তিন বছরে চীন তার বন্ধনী ও সড়ক উদ্যোগের (বিআরআই) অংশ হিসাবে লাতিন আমেরিকার কৌশলগত জ্বালানী সম্পদ অর্জন করতে শুরু করেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস গোয়েন্দাতথ্য অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিআরআই এর জ্বালানি বিনিয়োগের ৫৬ শতাংশ  তেল ও গ্যাসে এবং ৩৯ শতাংশ নবায়ণযোগ্য ক্ষেত্রে হয়েছে। চীন বিশ্বের শীর্ষ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণকারী

২০৩০ এর আগেই নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় চীনের প্রাকৃতিক গ্যাসের তৃষ্ণা বেড়েছে। গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার তুলনায় প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে।

বাম দিকের অংশে: শুকনো বন (৩.২%), আন্দিজের বন (০.২%), এবং আমাজনের ক্রান্তীয় বন (৫৩.৯%)। ৫৮ নং ব্লক আমাজন বনে অবস্থিত। পেরুর পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া মানচিত্র।

তবে এই চাহিদাটি আমাজনের সীমাবদ্ধ সম্পদ সম্প্রসারণের চাপ সৃষ্টি করেছে।

ব্রাজিল, পেরু এবং কলম্বিয়ার একাংশ জুড়ে থাকা আমাজন বন হলো জ্ঞাত জীববৈচিত্র্যের সমাহারসহ এপর্যন্ত বেঁচে থাকা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনাঞ্চল। বনটি তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুতের উপরে বসে থাকায় অঞ্চলটিতে অভূতপূর্ব গ্যাস উত্তোলন এবং নিবিড়ভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ দ্বারা এটি প্রভাবিত – যা আমাজনে বন উজাড়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাস করতে হলে আমাজনের বনভূমির রক্ষণাবেক্ষণ করাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে আদিবাসীরা পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিএআর অনুসারে, শেল ১৯৮০ এর দশকে উকেয়ালি অঞ্চলে প্রথম মজুত আবিষ্কার করার পর থেকে পেরুতে হাইড্রোকার্বনের এই শোষণ তাদের জীবনকে কয়েক দশক ধরে প্রভাবিত করেছে। এখন সিএনপিসি’র কাছ থেকে পেরুর আদিবাসীরা একইরকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

আমাজনের আদিবাসীরা হাজার বছর ধরে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় প্রতিবেশকে নতুনভাবে তৈরি করাসহ বনটি সম্পর্কে যে বিশাল জ্ঞান অর্জন করেছে, সেটা আমাজনীয় পরিবেশ সংরক্ষণ প্রচারণাকারী বেসরকারি সংস্থা আমাজন ফ্রন্টলাইনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

সক্রিয় কর্মীরা ৫৮ নং ব্লকের মানচিত্র দেখাচ্ছে, ডিএআর থেকে নেওয়া ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

আন্তর্জাতিক পণ্ডিতরাও আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছেন। ২০২১ সালের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ড. কেরি রাতিগান লিখেছেন যে এসব প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তরা হলো “সামান্য অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে পরিবেশগত পরিণতি ভোগকারী দরিদ্র, আদিবাসী, গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জনগণ। এসব সত্ত্বেও পেরু সরকার সম্পদের আহরণ অব্যাহত রাখার পক্ষে।”

এছাড়াও, ২০১৮ সালে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলি সিএনপিসি’র পরামর্শের অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ পর্ষদে “লোট ৫৮″ (৫৮ নং ব্লক) মামলাটি উপস্থাপন করেছে

একবছর পর চীন জাতিসংঘের সুপারিশক্রমে কয়েকটি গ্রুপের দাবি  মেনে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, এটি প্রকল্পগুলি মানব ও পরিবেশগত অধিকারের সাথে সামঞ্জস্য রাখা উৎসাহিত করতে রাজি হয়েছে। চীন আরো অন্যান্য পদক্ষেপসহ তার শিল্পগুলির কার্যক্রম পরিচালনার সময় বিদেশে মানবাধিকার অক্ষুন্ন রাখা নিশ্চিত করার জন্যে একটি আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার বিষয় বিবেচনা করতে রাজি হয়েছে

উরুবাম্বা জেলার প্রবেশপথ, যেখানে লোট ৫৮ অবস্থিত। ডিআর থেকে পাওয়া ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

তবে আদিবাসীরা জানিয়েছে, প্রকল্পটির অগ্রগতি চলতে থাকা স্বত্ত্বেও এখন পর্যন্ত তাদের সাথে পরামর্শ করা হয়নি।

২০২০ সালের অক্টোবর আদিবাসী অধিকার সংগঠনগুলি “পেরুর জটিল পরিবেশগত ও সামাজিক বাস্তবতার জন্যে টেকসই উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ সুশাসন প্রচারের কাঠামো শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি দিয়ে” পেরু-চীন মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে একটি পরিবেশ অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে উভয় সরকারকে অনুরোধ করতে পেরুতে নিযুক্ত  চীনা রাষ্ট্রদূতকে একটি চিঠি লিখেছে।

উচ্চ ঝুঁকির কারণে চীন সরকার পেরুর বেসরকারি সংস্থাগুলিকে চীনা রাষ্ট্রপরিচালিত সংস্থা এবং সরকারিভাবে সংগঠিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যেমন, সবুজ উটের ঘণ্টা, চীনা নাগরিক জলবায়ু কর্মকাণ্ড নেটওয়ার্ক, চংকিং নবায়নযোগ্য জ্বালানী সমিতি, চংকিং আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিনিময় কেন্দ্র এবং চীনা জবাবদিহি প্রকল্পের ঝাং জিংজিং এর সাথে কথাবার্তা চালানোর সুযোগের প্রস্তাব দেয়। পেরুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং এর পরিবেশগত ও সামাজিক নিয়মনীতি আরো ভালভাবে বুঝতে চীনকে সাহায্য করার জন্যে ২০২০ সালে ডিএআর এসব  চীনা সংগঠনের সাথে অনলাইন আলোচনা করেছিল।

দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিনিময়গুলি জড়িত সম্প্রদায়গুলির চাহিদা বোঝার এবং পূরণের ক্ষেত্রে সত্যিকারের কোন ভূমিকা পালন করেনি।

চীন ও পেরুর কর্মকর্তাদের নানা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এই মেগাপ্রোজটগুলি বাস্তবে পরিবেশের ক্ষতি হ্রাস করবে, আদিবাসীদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করবে এবং দরিদ্র অঞ্চলে তাদেরকে বিশালাকার বিনিয়োগের কিছু সুফল উপভোগ করতে দেবে কিনা, সেটা এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।


চীনের বন্ধনী ও সড়ক উদ্যোগের প্রতিযোগিতামূলক বিবরণের উপর একটি নাগরিক মিডিয়া মানমন্দির তদন্তের অংশ এই গল্পটিতে কীভাবে সমাজ ও সম্প্রদায় চীনা নেতৃত্বাধীন উন্নয়নের সম্ভাব্য সুবিধা ও ক্ষতি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পায় তা অনুসন্ধান করা হয়েছে। এই প্রকল্প এবং এর পদ্ধতি সম্পর্কে আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .