টুইটার বনাম ভারত: একটি কোভিড-১৯ ‘ভুয়া টুলকিট’ নিয়ে বিজেপি-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব

Photo by Solen Feyissa from Pexels. Used under a Pexels License.

সোলেন ফেয়িসার তোলা ছবি, পেক্সেলেস লাইসেন্স এর অধীনে ব্যবহৃত।

গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইন ঘোষণার পর ২৪শে মে দিল্লি এবং গুরগাঁও-এ অবস্থিত টুইটারের দুটি অফিসে পুলিশের উপস্থিতি ভারত সরকার ও আন্তর্জাতিক সামাজিক মিডিয়া কোম্পানির মধ্যে বিরোধ বাড়িয়ে তোলে। দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে টুইটারে শেয়ার করা সরকারকে কোভিড-১৯ অব্যবস্থাপনা” বিষয়ে দোষারোপ করা কথিত একটি টুলকিট সম্পর্কিত অভিযোগের তদন্তের অংশ হিসেবে টুইটারেকে নোটিশ দেওয়ার জন্যে পুলিশ সেখানে গিয়েছিল। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা দলের (বিজেপি) জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্রের একটি টুইটকে কেন “পরিবর্তিত মিডিয়া” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সে সম্পর্কেও সরকার ব্যাখ্যা চেয়েছে।

বৃহস্পতিবার ২৭ মে তারিখে ভারত সরকারকে দেওয়া এক বিবৃতিতে টুইটার ভারতীয় ব্যবহারকারীদের জন্যে “পুলিশ কর্তৃক ভয় দেখানোর কৌশল” এবং ভারতীয় ব্যবহারকারীদের “মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্ভাব্য হুমকি” নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে

সরকার এই বিবৃতিটির প্রতি আপত্তি জানিয়ে বলেছে যে, টুইটার তার নিজস্ব “দুর্বলতাগুলি” গোপন করার চেষ্টা করছে। চিঠিটিতে সাংবাদিক রুবিনা মঙ্গিয়া টুইট করেছেন:

#সদ্যসংবাদ: সরকার #টুইটারের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে এটিকে ভারতের শর্তাবলী নির্দেশনা এবং আইনি ব্যবস্থাকে ক্ষুন্ন করার প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে কোম্পানিটিকে অতিউৎসাহ নিবৃত করার, ‘গঠনমূলক সংলাপ’ করার এবং আইনকানুন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।

দিল্লি পুলিশও টুইটারের প্রতি কড়া ভাষায় বলেছে যে আইনগত কোন ক্ষমতা না থাকলেও সামাজিক নেটওয়ার্কিং পরিষেবাটি একইসাথে “তদন্তকারী ও বিচারক উভয় ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছে।“

দিল্লি পুলিশ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের দায়ের করা অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত নথিভুক্ত করেছে। তাই, এটাকে টুইটারের ভারত সরকারের নির্দেশে দায়ের করা এফআইআর হিসেবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণভাবেই ভুল: দিল্লি পুলিশ

কী কারণে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সেটা বুঝতে, আসুন আমরা আগের সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি দেখি।

কংগ্রেসের টুলকিট বিতর্কটি কী?

১৮ মে তারিখে সম্বিত পাত্র এবং বিজেপির অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ কোভিড-১৯ অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (আইএনসি) তৈরি করা বলে কথিত একটি টুলকিটের পর্দাছবি ভাগাভাগি করতে শুরু করলে বিতর্কটি শুরু হয়। তারা দাবি করেছে যে এই টুলকিটটি করোনভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনটিকে “মোদী স্ট্রেইন” বলে অভিহিত করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।

বন্ধুরা মহামারীর সময় অভাবীদের সাহায্য করার জন্যে #কংগ্রেস_টুলকিট দেখুন!
একটি আন্তরিক প্রচেষ্টার চেয়ে “বন্ধু সাংবাদিক” এবং “প্রভাবশালীদের” সহায়তায় গণযোগাযোগ চর্চার জন্যে আরো কিছু।
কংগ্রেসের এজেন্ডা নিজে পড়ুন: #উন্মোচিত_কংগ্রেস_টুলকিট

তবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কোন টুলকিট তৈরি করার কথা অস্বীকার করে উল্টো বিজেপির বিরুদ্ধে একটি ভুয়া টুলকিট তৈরি করে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছে।

এরপরে বিজেপি নেতারা মেটাডাটা বৈশিষ্ট্যাবলী প্রদর্শন করে কথিত প্রমাণ উপস্থাপন করে তাদের দাবিকে জোরদার করার চেষ্টা করেছে। নথিটিতে দুটি অংশ রয়েছে, যার মধ্যে কোভিড-১৯ অব্যবস্থাপনা উল্লেখ করা চার পৃষ্ঠার একটি “টুলকিট” এবং দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও পরিবেশবিদদের বিরোধিতা করা বিতর্কিত উচ্চাভিলাষী সরকারি মেগা-প্রকল্প কেন্দ্রীয় ভিস্তা পুনর্নিমাণ প্রকল্প সম্পর্কিত আরো চার পৃষ্ঠার গবেষণা দেখা যায়।

প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের রাজধানী দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে বিভিন্ন দপ্তর পুনর্নির্মাণ ও একটি নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের জন্যে বেশ কয়েকটি প্রতিনিধিত্বমূলক স্মারক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা নামের ৩.২-কিলোমিটার এলাকা পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ২৪ হাজার কোটি বাংলাদেশী টাকা) এবং গবেষণা নথিটিতে পরিবেশগত ও নৈতিক উদ্বেগের কথা তুলে ধরে সরকার কীভাবে এই সম্পদগুলি কোভিড-১৯ মহামারী ব্যবস্থাপনার দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে তার পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।

আইএনসি'র গবেষণা শাখার সদস্য রাজীব গৌড়া দাবি করেছেন যে বিজেপি কেন্দ্রীয় ভিস্তা প্রকল্প সম্পর্কে একটি খাঁটি গবেষণা নথির মেটাডাটাকে মোদির মহামারী অব্যবাস্থাপনার অভিযোগ সম্পর্কিত টুলকিট এর বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

কথিত টুলকিটটি পরীক্ষা করে দেখার জন্যে অনেকগুলি স্বাধীন প্রচেষ্টাও হয়েছে:

এই তদন্তে আমরা প্রকাশ করবো কীভাবে বিজেপি সমর্থকদের একটি টুইটার হ্যান্ডল কংগ্রেসকে দায়ী করা ‘টুলকিট’টি প্রকাশের ১০ দিন আগেই একটি ‘নতুন টুলকিট’ নিয়ে কথা বলেছিল যা বিজেপি নেতারা চালাচালি করেছে। @মুক্ত_চিন্তাবিদ

পরিবর্তিত মিডিয়া

বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে বিজেপি'র করা “টুলকিট” এর দাবিগুলি বিরোধীদলীয় কংগ্রেস দলকে আক্রমণ করা বিজেপির বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং কয়েক ডজন সাংসদ ও নেতারা ভাগাভাগি করেছে। বিস্তারিত তদন্তের পর বিভিন্ন স্বাধীন বাস্তবতা যাচাইকারীর উদ্ধৃতি দিয়ে বিজেপির একাধিক নেতার অ্যাকাউন্ট স্থগিত চেয়ে ১৯ মে তারিখে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস টুইটারকে লিখেছে। কংগ্রেসের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিভাগের চেয়ারম্যান রোহন গুপ্ত টুইট করেছেন:

আমরা কংগ্রেসের নামে নকল নথি ছড়িয়ে দেওয়া বিজেপি নেতাদের টুইটার অ্যাকাউন্ট স্থগিত চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে টুইটারের কাছে চিঠিটি লিখেছি।

ইতোমধ্যে একটি এফআইআর দায়ের করা হলেও স্বতন্ত্র বাস্তবতা যাচাইকারীরাও বিজেপির প্রচারণার ঢাকনা খুলে দিয়েছে।

একইসাথে কংগ্রেস ভুয়া “টুলকিট” প্রচারের জন্যে বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে

২১ মে তারিখে টুইটার সম্বিত পাত্রের টুইটটিতে “পরিবর্তিত মিডিয়া” লেবেল যুক্ত করে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট একটি পক্ষের অভিযোগের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তদন্ত এখনো বাকি রয়েছে বলে জানিয়ে ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য মন্ত্রণালয় টুইটারের বৈশ্বিক দলকে ট্যাগটি সরিয়ে নেওয়ার জন্যে চিঠি দেয়।

চিঠিতে কয়েকটি টুইটের ট্যাগ “পূর্বসিদ্ধান্তমূলকভাবে লাগানো” হয়েছে এবং “টুইটার নয়, তদন্তই বিষয়বস্তুর সত্যতা নির্ধারণ করবে” বলে দাবি করা হয়েছে।

সতর্কতাগুলি “প্রতারণামূলকভাবে পরিবর্তিত বা বানোয়াট” পোস্টগুলিতে প্রয়োগ করা হয়েছে বলে টুইটার তার সিদ্ধান্তের পক্ষাবলম্বন করেছে

দীর্ঘ বিতর্কে লিপ্ত অনুগামী বা সমালোচক উভয় ধরনের ভারতীয় নাগরিকই ঘনিষ্ঠভাবে এই বাকযুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করছে। সাংবাদিক রানা আইয়ুব টুইট করেছেন:

টুইটারের বিরুদ্ধে তদন্ত, ভারতে কোভিড-১৯-এর আন্তর্জাতিক প্রকাশনা এবং এর কভারেজকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা, সরেজমিন নির্ভেজাল সত্যের সংবাদ দেওয়া সাংবাদিকদের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি – এগুলোর সবই বিশ্বাসযোগ্যতার নড়বড়ে মাটিতে নিজেকে আবিষ্কার করা একটি সরকারের সমস্ত লক্ষণ।

কার্টুনশিল্পী পেন পেন্সিল ড্র টুইট করেছেন:

অসামাজিকঃ বল পাখি আমাদের বাক স্বাধীনতা রয়েছে

ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহযোগী সুশান্ত সারিন মন্তব্য করেছেন:

টুইটার হলো নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি … এটা স্থানীয় ব্যবহারকারীদের নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে রক্ষার ভান করে। পরে আমাদেরকেই বেশি দামে বিক্রি করে। এটি (মনে হচ্ছে) আইনের ঊর্ধ্বে। এটা নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় সে কোন আইন অনুসরণ করবে, কোনটা মেনে চলবে না আর কোন আইন তৈরি করতে হবে। সংক্ষেপে, (যেন) টুইটার সিদ্ধান্ত নেবে ভারত কীভাবে চলবে

সাংবাদিক অজিত দত্ত বলেছেন:

এখন পর্যন্ত টুইটার এমনভাবে বিতর্ক করছিল যেন তাদের পছন্দমত কাজ তারা করতে পারবে। ভারত সেই বিভ্রমকে ভালভাবেই ভেঙ্গে দিয়েছে।

টুইটার এবং নতুন তথ্যপ্রযুক্তি বিধি

২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে  ভারত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অনলাইন নিউজ ওয়েবসাইট এবং স্ট্রিমিং সাইটগুলির জন্যে নতুন প্রবিধান প্রবর্তন করেছে যার ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়বস্তু নিয়ে ভারতীয় ব্যবহারকারীদের এবং সরকারের অভিযোগের প্রতি সাড়া দিতে তাদেরকে স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগসহ বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। মোটকথা, এই বিধিগুলি প্রস্তুতকারীদের সনাক্তকরণসহ অনলাইন বিষয়বস্তু পুলিশী নজরদারিতে আনতে এবং পুলিশি তদন্তে সহায়তা করতে সরকারকে আরো ক্ষমতা দেবে।

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টুইটারসহ আন্তর্জাতিক সামাজিক মিডিয়া মঞ্চগুলিকে নতুন এই আইন মেনে চলার জন্যে যে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছিল তা শেষ হয়েছে ২৫ মে তারিখে।

টুইটার সেটা এখনো তা মেনে নেয়নি এবং সময় বাড়ানোর  প্রার্থনা করেছে, অন্যদিকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং গুগল ইতোমধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রেরণ করেছে।

টুইটারের জানুয়ারি-জুন, ২০২০ সময়কালের স্বচ্ছতা প্রতিবেদন অনুসারে, ভারত ১৯,৮০৫টি অ্যাকাউন্টের উল্লেখ করে ৫,৮৭৭টি তথ্য পাবার অনুরোধ পাঠালে টুইটার মাত্র আট শতাংশ তথ্য দিয়েছে।  একই সময়ে, ভারত ২৯,২১৩টি অ্যাকাউন্টের উদ্ধৃতি দিয়ে ৫,৪৬৪টি বিষয়বস্তু অপসারণের আইনি দাবি করেছিল, যার মধ্যে কেবল ১২ শতাংশ টুইটার পালন করেছিল।

এখন কেবল এটাই দেখার বাকি রয়েছে নতুন তথ্যপ্রযুক্তি বিধিগুলির প্রয়োজনীয়তা মেনে না চলা সামাজিক মিডিয়ার মঞ্চগুলির প্রতি ভারত কী পদক্ষেপ নেয়

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .