নেপালের দুর্গা প্রসাদ তিমসিনা, যিনি জাইসি নামেও পরিচিত তিনি ৪০ বছর কারাগারে কাটানোর পর সম্প্রতি কলকাতার দমদম সেন্ট্রাল সংশোধন কেন্দ্র থেকে ছাড়া পান। ৬১ বছরের দুর্গা প্রসাদ ভারতের বিভিন্ন জেলে চার দশক এমন এক অপরাধে আটকে ছিলেন যার কোন শক্তিশালি প্রমাণ ছিল না, আর তিনি বার বার জোরালো কন্ঠে বলেছেন তিনি নির্দোষ। অবশেষে তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে ২১ মার্চ ২০২১ এ নেপালের পূর্বাঞ্চলের লুম্বাকে মায়ের সাথে মিলিত হন।
তিমসিনা যখন কাজের সন্ধানে ভারতের দার্জিলিং এ যান তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। ১৯৮০ সালে নাইনা ঘালে নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির অভিযোগে তিমসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। নাইনা ঘালের অভিযোগ ছিল যে তিমসিনা তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে, তবে ঘালে পরে এই মামলা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি।
নেপালি মিডিয়া সেতোপতিকে প্রদান করা এক ভিডিও সাক্ষাতকারে তিমসিনা বলেনঃ আমাকে বলা হয়েছিল যে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আমাকে চাকুরী দেওয়া হবে, পরে আমাকে খুনের মত মিথ্যা অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়, কিন্তু আমি নির্দোষ।
পরিবারের ধারণা ছিল ১৯৮০ এর দশকে দার্জিলিং এ গোর্খাল্যান্ড নামের আন্দোলনে তিমসিনা নিহত হয়েছে। এরপর তারা আর তিমসিনার খোঁজ করেনি। ২০২০ সালে তিমসিনার পরিবার আবিস্কার করে যে সে জীবিত এবং ভারতে কারাগারে দিন কাটাচ্ছে। এরপর তারা তিমসিনাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা শুরু করে।
নেপালি মিডিয়াকে দেওয়া এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিমসিনার মা বলেন, এখন আমি খুশী যে সে আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে। ছেলেকে খুঁজতে থাকার সেই দিনগুলো আমার ফুরালো। একসময় মনে হয়েছিল আমি বুঝি আর কোনদিন আমার সোনাকে দেখতে পাবো না।
যারা তিমসিনার মুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়েছে
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী অনেকে তিমসিনার ঘরে ফিরে আসায় আনন্দ প্রকাশ করার পাশাপাশি এই মামলা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। .
নেপালের সাংবাদিক ধ্রুব এইচ অধিকারী:
Release from detention of Durga Prasad Timsina, a Nepali national, on a Calcutta court order, has provided relief to the people of Nepal.
But—
The case deserves full investigation—and compensation—because he was incarcerated for 40 years WITHOUT TRIAL.@narendramodi @MEAIndia— Dhruba H. Adhikary (@dhrubahari) March 21, 2021
কলকাতার এক আদালতের আদেশে নেপালের নাগরিক তিমসিনার কারাগার থেকে মুক্তি লাভের ঘটনায় নেপালের অনেক নাগরিক স্বস্থি বোধ করেছেন-তবে এই মামলা বিষয়ে এক পরিপূর্ণ তদন্ত হওয়া দরকার-কারণ বিনাদোষে তাঁকে ৪০ বছর জেল খাটতে হয়েছে
সেতোপতির ব্যবহারকারীরা এর ইউটিউব চ্যানেলে মন্তব্য করেছে:
মদন ওঝা: মদন ওঝাঃ চল্লিশ বছর পর কলকাতা জেল থেকে অবশেষে মায়ের কোলে। ভারত সরকারকে ক্ষতি পূরণ প্রদান করা উচিত। সবসময় ভাল মানুষেরা ফাঁদে পড়ে। সকলের (অন্যায়ের বিরুদ্ধে) আওয়াজ তোলা উচিত। !
রোশন খড়কা: ভারত সরকারের অবশ্যই ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিত!
সুশীল রানা: এমন কি প্রবীণ বয়সেও তিমসিনার মুক্তি ও তাঁকে এক মুক্ত স্বাধীন জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যে সকল ভারতীয় ও নেপালি নাগিরক দিনরাত কাজ করেছেন তাঁদের ধন্যবাদ। এ রকম এক সুন্দর তথ্যচিত্র বানানোর জন্য সেতোপরিকে ধন্যবাদ।
তিমসিনার মুক্তির বিষয়টি যিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন তিনি হচ্ছেন রাধেশ্যাম দাস। এরা দুজনে এক সময় কলকাতার দমদম সংশোধনাগার কেন্দ্রে ছিলেন। জেলে থাকার সময় রাধেশ্যাম শুনেছিলেন তিমিসেনার ঘটনার কথা, দশ বছর জেলে কাটানোর পর মুক্তি পেয়েই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে তিমসেনার মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করবেন।
রাধেশ্যাম দাস পশ্চিম বাংলার রেডিও ক্লাব হ্যাম রেডিওর কাছে তিমসিনার কাহিনি তুলে ধরেন। সাথে সাথে এই কাহিনী চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক আইনজীবী তিমসেনার সমর্থনে ও তাঁর মুক্তির জন্য এগিয়ে আসেন। অন্য অনেক আইনজীবীর সাথে হিরা সিনহা নামের এক আইনজীবী কোন ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই এই মামলা লড়েন আর নেপাল ও ভারত সরকারের অনেক মানুষের সহযোগিতায় তিমিসেনা জামিনে মুক্তি লাভ করেন। তবে ভারতের হাইকোর্ট এখনো এই মামলার চুড়ান্ত রায় প্রদান করেননি।
ন্যায় বিচারের জন্য এক দীর্ঘ যাত্রা
দীর্ঘ এবং কঠোর এক কারাবাসের পর, তিমসিনা শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নেপালি মিডিয়াকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিমিসেনা অনেক কিছু মনে করতে পারেননি, এমনকি তিনি ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছেন না।
তিমসিনা চার দশক কারাগারের চার কুঠুরির মধ্যে কাটিয়েছেন। এখন সে এত দুর্বল যে এমন কি কারো সাহায্য ছাড়া সে ঠিকমতো হাঁটতেও পারে না। জীবনের দুই তৃতীয়াংশ সময় কারাগারে কাটিয়ে সে ঘরে ফিরে এসেছে আর এখন তাঁর কাছে জীবন এখন অর্থহীন।
তিমসিনার ফিরে আসার সাথে সাথে নেপাল সরকার তাঁর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করেছে এবং তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয়ভার বহনের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। তবে সফল ভাবে তাঁর পুনর্বাসনের জন্য এ ধরনের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। .
তিমসিনাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হচ্ছে তাঁর অর্থনৈতিক দুরবস্থা। কিশোর বয়সে সে তাঁর বাবাকে হারিয়েছে, আর তাঁর মায়ের বয়স ৮৬ বছর যে এখন শারীরিক ভাবে চলাফেরায় অক্ষম। তাঁর পারিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল না।
তিমসিনার পরিবার কিছু সাহায্যের আশা করছে, বিশেষ করে কলকাতা হাইকোর্ট পশ্চিম বঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করে যেন তাকে কিছু সাহায্য প্রদান করা হয়। তবে, কারো সাহায্য ছাড়া তিমসিনার পরিবারের পক্ষে ক্ষতিপূরণ এর দাবী সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো পূরণ করা অসম্ভব প্রায়।
কেন নেপাল তার অভিবাসী শ্রমিকদের রক্ষায় ব্যর্থ?
তিমসিনা নেপালের একমাত্র নাগরিক নন যিনি এ রকম ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ রকম হাজার হাজার নেপালি নাগরিক রয়েছে যারা একই রকম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। নেপালের নাগরিকেরা বিদেশে যায় কারণ স্বদেশে তাঁদের কাজের সুযোগ এবং তারা গরীব আর নেপালী শ্রমিকের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কাজের সন্ধানে ভারতে যায়। নেপালের সাথে ভারতের একটা দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে আর ভারতে কাজ খুঁজতে যাওয়ার জন্য নেপালের নাগরিকদের ভিসা কিংবা ওয়ার্ক পারমিটের প্রয়োজন হয় না।যে সমস্ত রাষ্ট্র থেকে নেপাল সবচেয়ে বেশী রেমিটেন্স লাভ করে থাকে ভারত তাঁর মধ্যে অন্যতম আর এর জন্য নেপালের অভিবাসীদের ধন্যবাদ।
যদিও ভারতের ‘বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ আইন ২০০৭’ অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে,তবে এর কার্যকারী প্রয়োগের বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। কাজ করার অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট নেই মানে হচ্ছে অভিবাসী শ্রমিকদের আইনগত নিরাপত্তা নেই আর এই বিষয়টি ভারতে কর্মরত অনেকে নেপালিকে অনেক ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দেয়; এর ফলে তাদের ধর্ষণ, শোষণ অথবা মানব পাচারের শিকার হওয়ার মত ঝুঁকির মাঝে থাকতে হয়।
নিরাপত্তাহীনতা এবং অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থা নেপালের এক প্রধান সমস্যা হয়ে রয়েই গেছে। এই বিষয়ে নেপাল সরকারের নীতি প্রধান এক উদ্বেগ এর বিষয়, প্রায়শ যার সমালোচনা করা হয়ে থাকে।
অনেক নেপালি পরিবার বিদেশী কর্মরত পরিবারের প্রিয় সদস্যকে মৃত্যুর কারণে চিরতরে হারিয়ে ফেলছে। ৪ এপ্রিল ২০২১ এ মালয়েশিয়া থেকে ১২ জন নাগরিকের লাশ নেপালে নিয়ে আসা হয় যাদের বেশীর ভাগ ছিল তরুণ। মালয়েশিয়া হচ্ছে কাজের সন্ধানে যাওয়া নেপালি নাগরিকদের অন্যতম এক প্রধান গন্তব্য স্থান। এই ধরর ঘটনা বর্তমান পরিস্থিতি ও নেপালের অভিবাসী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হয় সেগুলোকে তুলে ধরছে।