- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

নারীদের ‘অন্য কারো চিন্তার মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার দরকার নেই,’ বলেছেন তুর্কি মহাকাশ প্রকৌশলী

বিষয়বস্তু: তুরস্ক, নাগরিক মাধ্যম, বিজ্ঞান, ভাল খবর, লিঙ্গ ও নারী, শিক্ষা
Gökçin Çınar [1]

ইয়োকচিন চিনাস/ অনুমতিসহ ব্যবহৃত

ইউনেস্কো তথ্য (২০১৪-২০১৬) [2]  অনুসারে বিশ্বব্যাপী সমস্ত নারী শিক্ষার্থীদের মাত্র ৩০ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত) ক্ষেত্রগুলি পছন্দ করেন।

প্রায়শই খুব অল্পবয়স থেকে বাচ্চাদের মধ্যে প্রোথিত লিঙ্গ পক্ষপাত এবং ক্ষতিকর ছকেবাঁধা চিন্তা কীভাবে এধরনের বৈষম্যে অবদান রাখে তা ভালভাবেই নথিবদ্ধ।

তুরস্কের ইজমিরের ৩০ বছর বয়সী মহাকাশ প্রকৌশলী ইয়োকচিন চিনাস এসটিইএম কর্মজীবন শুরু করা হাতে গোনা নারীদের মধ্যে একজন।

তিনি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় অবস্থিত জর্জিয়া প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের (জর্জিয়া টেক) মহাকাশ ব্যবস্থার নকশা গবেষণার (এএসডিএল) একজন গবেষক। তার কাজ নতুন ধরনের আকাশযানের নকশা এবং প্রযুক্তির উপর মনোনিবেশ করা যা আকাশযান চলাচলকে আরো টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব করে তুলতে সাহায্য করতে পারে।

চিনাস এবং তার স্বামী ইউটিউবে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল সম্পর্কিত একটি জনপ্রিয় চ্যানেল [3] পরিচালনা করেন। এই দম্পতি প্রায়শই যুবতী নারীদের তাদের আবেগ এবং স্বপতসাহিতকে অনুসরণ করতে উৎসাহিত করে থাকেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে ৪ মার্চ তারিখে আমি তার কর্মজীবন, তার কর্মক্ষেত্র এবং ইউটিউবে তার দুঃসাহসিকতা নিয়ে ফোন এবং ইমেল মাধ্যমে চিনাসের সাথে কথা বলেছি।

এই সাক্ষাৎকারটি কিঞ্চিত সম্পাদনা করা হয়েছে।

সেভজি ইয়ামুস: আপনি কীভাবে মহাকাশ রকৌশলে আগ্রহী হয়ে উঠলেন?

ইয়োকচিন চিনাস: ছোটবেলা থেকেই আমি সবসময় উড্ডয়নের বিষয়টি নিয়ে মুগ্ধ। আমার মনে আছে ছোট থেকেই আমার পাইলট হওয়ার ইচ্ছে ছিল। আমি নির্মাণের জিনিসও পছন্দ করতাম। কোন ঘটনা বা ব্যক্তি যে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে আমি এমন মনে না করলেও প্রকৌশল বিভাগটি অবশ্যই আমার পরিবারের পুরুষদের থেকেই এসেছে। আমার বাবা একজন খুব কর্মতৎপর সৃজনশীল ব্যক্তি। আমি সবসময় তাকে এটাসেটা থেকে বিভিন্ন জিনিস নকশা এবং তৈরি করতে সাহায্য করেছি। আমি যখন ছোট একটি মেয়ে ছিলাম তখন আমার নিজের একটি ছোট হাতুড়ি ছিল যেটা দিয়ে আমি আমার দাদার সাথে কাঠের বিমান তৈরি করতাম। আমাকে যা করতে হয়েছে সেটা হলো প্রকৌশলের প্রতি আমার আগ্রহের সাথে উড্ডয়ন এবং মহাকাশের প্রতি আমার আবেগকে যুক্ত করা। আমার ধারণা এটা হওয়ারই কথা ছিল।

ইয়ামুস: আপনার পড়াশুনার ক্ষেত্রটি বেছে নেওয়ার সময় আপনি কি কোন লিঙ্গভিত্তিক ছকেবাঁধা চিন্তার মুখোমুখি হয়েছিলেন?

হাইস্কুলে আমার চাওয়া একমাত্র পেশা ছিল মহাকাশ প্রকৌশল। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার নম্বর পেলে আমার বাবা-মা এবং আমি খুব আনন্দিত হয়েছি, যা আমাকে শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান দিয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমার স্বপ্নের ক্ষেত্রে।

আমি আমার বর্ধিত পরিবার, শিক্ষক বা সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া সমালোচনা সম্পর্কে খুব কমই জানতাম। অনেক মানুষ ভাবেই নি যে মহাকাশ প্রকৌশলে আমার কোন ভবিষ্যৎ রয়েছে। কেউ কেউ ভেবেছিল যে আমি স্পষ্টতই আমার লিঙ্গের জন্যে বেশি উপযুক্ত চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা না করে আমার পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরকে “নষ্ট” করেছি, অন্যরা ভেবেছিল আমি হয়তো প্রকৌশল পড়তে চাই। আমার এমন কিছু বেছে নেওয়া উচিত ছিল যা আরো বেশি “মেয়েসুলভ,” তার অর্থ যাই হোক না কেন। তবে আমি এসবের কোন কিছুই শুনিনি। আমি নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম এবং আমি জানতাম যে আমি কী চাইছিলাম। আর তাই দিন শেষে আমার জীবনে এসবের এমনকি সামান্যতম প্রভাব পড়েনি। আমার বাবা-মা আমাকে সর্বোতভাবে সমর্থন করায় আমি নিজেকে সেই অর্থে সুবিধাপ্রাপ্ত মনে করি।

ইয়ামুস: আপনার কাজের কোন দিকটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করে?

আমার গবেষণা নতুন ধরনের আকাশযানের নকশা এবং প্রযুক্তির উপর মনোনিবেশ করে যা আকাশযান চলাচলকে আরো টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে দায়বদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করতে পারে। এই মুহূর্তে বৈশ্বিক আকাশযান চলাচল শিল্পটি জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী না হলেও আমরা আকাশযানের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এর অংশগ্রহণ দ্রুতি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করি। অনেক ধরনের নকশাগত সমাধান, প্রযুক্তি এবং কর্মকাণ্ডগত উন্নতি আকাশযান উড়াতে প্রয়োজনীয় জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ হ্রাস করতে সাহায্য কতে পারে। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক এবং সবচেয়ে মৌলিক সমাধানগুলির মধ্যে একটি: বিদ্যুতায়িত আকাশযান বিষয়ে আমি আমার পিএইচডি করেছি। বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং ব্যাটারিগুলিতে সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা এখন আকাশযান চালনা ব্যবস্থা বিদ্যুতায়নের বিষয়ে কথা বলতে পারি। বিদ্যুতায়িত আকাশযান চাল্না একটি অভিনব প্রযুক্তি যা আরো সাশ্রয়ী মূল্য এবং শান্ত আকাশযানের সুযোগ করে দেওয়ার সাথে সাথে জ্বালানি খরচ ও আকাশযানের (কার্বন) নির্গমনকে পুরোপুরি হ্রাস করতে পারে। অবশ্যই আমাদের প্রকৌশলীদের অনেকগুলি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। নাসাসহ মার্কিন সরকার অর্থায়িত আমার বর্তমান গবেষণা প্রকল্পগুলি এই চ্যালেঞ্জগুলির সঠিক সমাধান অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করে থাকে।

ইয়ামুস: একজন বিদেশী নারী প্রকৌশলী হিসেবে আপনি কি আপনার লিঙ্গ ও জাতিসত্ত্বার জন্যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন? এগুলি কাটিয়ে উঠার জন্যে আপনি কী করেছেন?

আমি মনে করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা একটি যুগ সন্ধিক্ষণে বসবাস করছি যেখানে প্রতিদিন এবং পেশাদার জীবনে উভয় ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি আরো বেশি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা এখনো সেখানে পৌঁছেনি। বিশেষ করে আমরা যারা এখনো এসটিইএম-এ রয়েছি, তাদের সামনে অনেকটা পথ পড়ে রয়েছে। আমি ভাগ্যবান যে আমার বর্তমান কর্ম পরিবেশ বৈচিত্র্য সমর্থন করলেও অবশ্যই আমি সারাক্ষণ আমার বুদ্বুদের মধ্যে বসবাস করি না। শ্বেতাঙ্গ-পুরুষ-অধ্যুষিত ক্ষেত্রে কর্মরত বিদেশী নারী প্রকৌশলী হিসেবে কয়েক বছধরে আমার অনেক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে।

সম্প্রতি আমাকে কর্তৃপক্ষীয় একটি উৎস বলেছে যে উচ্চারণ করা কঠিন বলে আরো সফলতার জন্যে আমাকে আমার নামটা পরিবর্তন করা দরকার। এই ধরনের নিত্যদিনের ছোট ছোট আগ্রাসনগুলি আমরা একটি হাসি দিয়ে খুব একটা চেষ্টা না করে নিজেদের সেরা দেখানোর মাধ্যমে মোকাবেলা করবো বলে আশা করা হয়। এবং আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়তে থাকলেও উচ্চ স্তরের পদে এখনো বেশি সংখ্যক নারী প্রকৌশলী নেই। শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মহাকাশ প্রকৌশল বিভাগেও বেশি সংখ্যক নারী শিক্ষাবিদ নেই। বেশিরভাগ প্যানেল এখনো পুরুষ-অধ্যুষিত। এবং আমার অন্যান্য অনেক নারী সহকর্মী যেমন করেন তেমনি আমি যা কিছু করি তার থেকে আরো বেশি চেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম করে নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে এই জাতীয় চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করি।

ইয়ামুস: আপনি নাসা এবং বোয়িং ও এয়ারবাসের মতো বিমান চলাচলের অন্যান্য দানবদের সাথে কাজ করার কথা উল্লেখ করেছেন। আপনার কাজ শিল্পটিতে কীভাবে অবদান রাখছে?

আমি জর্জিয়া টেকের মহাকাশ ব্যবস্থা নকশা গবেষণাগার (এএসডিএল)-তে পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং স্নাতক গবেষণা সহকারী হিসেবে আট বছর আগে যোগদান করি। এএসডিএল একটি খুবই অনন্য গবেষণাগার। এতে অনেক বড় সংখ্যক এবং বহুমাত্রিক একটি দল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকমণ্ডলী রয়েছে। এএসডিএলে শিল্পটির সাথে আমাদের উপভোগ করা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি আমাদেরকে বাস্তব জগতের সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করে আমাদের ক্ষেত্রটিতে গবেষণার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সাহায্য করে। একাডেমিয়ায় আমাদের গবেষণার ফলাফলগুলি বাস্তব জগতের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে এবং সরকার ও শিল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অবহিত করা হচ্ছে যেটা আমার কাজের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ।

ইয়ামুস: আপনার কাছে এসটিইএম কেন্দ্রিক একটি ইউটিউব চ্যানেল এবং # কাদেন্দেদিয়িন [আপনি বলছেন আপনি একজন নারী] নামে একটি ধারাবাহিক রয়েছে। কী কারণে আপনি চ্যানেল এবং ধারাবাহিক এদু’টি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এসবের মূল উদ্দেশ্য কী?

২০১৬ সালে জর্জিয়া টেকের স্নাতক শিক্ষার্থী থাকার সময় আমার মধ্যে অভিনয় ও প্রকৌশল সম্পর্কে আমার আবেগকে একসাথে করার একটা ধারণা জাগে। আমার তৎকালীন ছেলেবন্ধু  এবং এখন আমার স্বামী ধারণাটি পছন্দ করায় আমরা একসাথে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল বিজ সিজ ওনলাস [3] [আমারা, তোমরা, তারা] তৈরি করি।

আমরা বিভিন্ন প্রকৌশল ক্ষেত্র সম্পর্কে ভিডিও তৈরি করেছি যেখানে আমরা একে অপরের এবং আমাদের এসটিইএম ডিগ্রিধারী বন্ধুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এই ভিডিওগুলি দিয়ে আমি উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার অভিজ্ঞতালব্ধ ছকেবাঁধা লিঙ্গচিন্তা ভাঙ্গতে সহায়তা করতে চেয়েছি। আমি সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী নয়, বরং অল্পবয়সী নারীদেরকে তাদের স্বপ্ন অনুসরণ করতে এবং তাদের আবেগ অনুসারে তাদের পেশা বেছে নিতে উৎসাহিত করতে চেয়েছি। এই সাক্ষাৎকার ভিডিওগুলি প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যেই, আমি তুরস্কের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বার্তা পেতে শুরু করি। এটা আমাকে কিছু কিছু অল্পবয়সী, মেধাবী মেয়েদের সব ধরনের চ্যালেঞ্জ বুঝে উঠতে সাহায্য করেছে। মূলত অবদমন এবং এর বিরুদ্ধে তাদের প্রশংসনীয় প্রতিরোধের গল্পগুলির কারণেই আমি সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষ সমর্থন করা কখনোই বন্ধ করবো না। আমার লক্ষ্য হলো তাদের দেখানো যে তাদের কী হওয়া উচিত, তাদের কেমন আচরণ করা উচিত, তাদের কী স্বপ্ন এবং কী অর্জন করা উচিত সে সম্পর্কে অন্য কারো এমন ধারণার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দরকার নেই। আমি মনে করি তরুণ প্রজন্মকে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ছকেবাঁধা জীবনের বাইরে জীবনযাপন করা সম্ভব দেখানোটা একটা শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হতে পারে।

ইয়ামুস: আপনার পরবর্তী লক্ষ্য কী?

অনেক কিছু! আমি যতো বেশি ধাপ উঠছি, ততই আমার লক্ষ্য উপরে উঠছে। আমি চাইলেও আমি এখানে যা করতে চাই তার সবকিছুর তালিকা দিতে পারবো না। তবে অদূর ভবিষ্যতে আমার শীর্ষ দু’টি লক্ষ্য হলো একজন সফল একাডেমিক অনুষদ সদস্য হওয়া এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার পাইলট লাইসেন্স নেওয়া।