- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

অবিবাহিত নারী ও যৌন স্বাস্থ্য: কলঙ্কের বোঝা বইতে হয় ভারতে

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, ভারত, নতুন চিন্তা, নাগরিক মাধ্যম, প্রতিবাদ, মানবাধিকার, স্বাস্থ্য
Young couple walk down a quiet path in Delhi park surrounded by green trees

দিল্লির কেন্দ্রস্থলের একটি পার্কে তরুণ দম্পতি, ২০১৯। লেখকের ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

বিবাহপূর্ব যৌনতার প্রতি ভারতে কুসংস্কার বজায় রাখার অর্থ হলো যৌন স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার চেষ্টা করার সময় অবিবাহিত নারীরা চিকিৎসা প্রদানকারীদের কাছে কলঙ্কের সম্মূখীন হন।

দেশটিতে ক্রমবর্ধমান হারে নারীরা [1] বিয়ে করতে দেরী করায় সামাজিক নিয়ম সত্যিই বদলে যাচ্ছে। ভারত এখন অনলাইন ডেটিং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারগুলির চতুর্থ বৃহত্তম [2] ব্যবহারকারী। তবে বদলে যেতে থাকা সামাজিক  ও যৌন দৃশ্যপট সত্ত্বেও এমনকি ভারতের বড় বড় শহরগুলিতেও যৌন বিষয়ে চিকিৎসা পেশাগত মনোভাব এখনো রক্ষণশীলতায় নিমজ্জিত।

গত চার বছর ধরে দিল্লি-ভিত্তিক যুব সংগঠন হাইয়া পরিচালিত কলঙ্কের আগে স্বাস্থ্য নামে একটি অভিযান এই ব্যবস্থাটিকে চ্যালেঞ্জ করে যৌন স্বাস্থ্য এবং প্রজনন পরিষেবাগুলির সাথে অবিবাহিত নারীদের যুক্ত করে ভারতের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মনোভাব পরিবর্তন করে আসছে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি কলঙ্কের আগে স্বাস্থ্য [3] এর প্রচারণা পরিচালক শ্রীজানি মালাকারের সাথে দেখা করলে তিনি ব্যাখ্যা করেন:

আপনার যৌনভাবে সক্রিয় থাকার পূর্ব শর্ত হলো আপনাকে বিবাহিত হতে হবে। বিবাহিত না হয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে আপনি অশুচি বিবেচিত হবেন এবং চিকিৎসকেরা আপনার চিকিৎসা করবে না। এটা একটা সামাজিক কলঙ্ক; চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশাজীবিরা সামাজিক ব্যবস্থারই উৎপাদ। আর এর সাথে জড়িত লজ্জার মাত্রা এতটাই বেশি নারীরা প্রায়ই তাদের প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি নিজেরা নিতে পারেন না।

ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু ধর্মে বিয়ের আগের যৌন সম্পর্ককে অশূচির উৎস [4] হিসেবে দেখা হয় এবং বিয়ে বহির্ভূতভাবে কলঙ্কিত করা হয়; আর ইসলামে এটা নিষিদ্ধ [5]। মালাকার বলছেন চিকিৎসকদের মধ্যেকার এই মনোভাবগুলি অবিবাহিত নারীদের তাদের যৌন স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তাগুলিকে অগ্রাধিকার দিতে বাধা দেয় এবং উপযুক্ত সেবা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।

২০১৮ সাল জুড়ে দিল্লিতে বসবাসরত অবিবাহিত নারীদের উপর হাইয়া পরিচালিত এক সমীক্ষায় মাত্র ৫ শতাংশ উত্তরদাতা [6]কে চিকিৎসা পেশাদারদের কাছ থেকে যৌনতা বা গর্ভনিরোধ সম্পর্কে তথ্য নিতে দেখা গেছে। তারা জেনেছে, এদের বেশিরভাগকে ইন্টারনেটে বা বন্ধুদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে।

অন্যান্য পরিসংখ্যান এই শূন্যতার পরিণতি প্রকাশ করে। এই সমীক্ষাটি থেকে জানা গেছে, সমীক্ষা করা হয়েছে এমন নারীদের মাত্র ২০ শতাংশ গর্ভপাত সম্পর্কিত তাদের অধিকার বুঝতে পেরেছেন। এদিকে আপনিই_সরকার ভারত সমীক্ষা ২০১৮ [7] অনুসারে ১৫ শতাংশ নারী মনে করেন যে জরুরি গর্ভনিরোধক গর্ভনিরোধের নিয়মিত পদ্ধতি হিসাবে উপযুক্ত নয়; আর ৪৯ শতাংশ এবিষয়ে নিশ্চিত নন।

‘ফার্মেসির লোকটি আমার কথা ভুল শোনার ভান করে’

অল্প বয়স্ক অবিবাহিত এক নারী স্বপ্না দেবী (তার আসল নাম নয়) গত ফেব্রুয়ারি মাসে তার নিজের শহর জয়পুরে একটি সাক্ষাৎকারে আমার সাথে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন। তিনি  বলেছেন, “ফেসবুকে পরিচিত আমার সর্বশেষ বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমি যখন দেখা করি তখন আমার ১৮ বছর বয়স। আমরা দু'বছর দেখা সাক্ষাৎ করেছি এবং হোটেলগুলিতে মিলিত হয়েছি যাতে কেউ আমাদের দেখতে না পায়।”

অবিবাহিত নারী বলে প্রথম স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ তাকে কীভাবে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন স্বপ্না। এবার তিনি বাগদত্তার ভান করে গর্ভনিরোধক ইনজেকশন নিতে সক্ষম হন। পরবর্তী মাসগুলিতে তার অনিয়মিত রক্তস্রাব হলেও তিনি ভেবে দেখেছেন যে তিনি আর সেই চিকিৎসকের কাছে ফিরে যেতে পারবেন না। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি কনডম এবং জরুরী গর্ভনিরোধকের আশ্রয় নিয়েছেন।

প্রাক-মহামারী এক জরিপ অনুসারে, ৭৭ শতাংশ একক মায়ের [8] কাছে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বত্ত্বেও প্রতি ডোজ ১.৫০ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী প্রায় ১২৮ টাকা) মূল্যের  জরুরী গর্ভনিরোধক বড়িটি ভারতের মহিলাদের জন্যে গর্ভনিরোধের সবচেয়ে সহজলভ্য বিকল্পগুলির একটি।

“ফার্মেসির লোকটা সবসময় আমার কথা ভুল শোনার ভান করে আমাকে দু'বার জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য করলেও এটাই সবচেয়ে সহজ বিকল্প বলে আমি পাত্তা দিই না,”দেবী বলেছেন।

নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা

দেবীর মতো গল্পগুলিই হাইয়াকে ২০১৭ সালে কলঙ্কের আগে স্বাস্থ্য [9] প্রচারণাটি শুরু করতে বাধ্য করেছিল।

সেসময়, হাইয়া “যোনি সংলাপ” [10] নামে অবিবাহিত নারীদের তাদের যৌন স্বাস্থ্যের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলতে উৎসাহিত করা এক সেট সাক্ষাৎকার পরিচালনা করেছিল। সংলাপগুলি সমস্যাটির এমন মাত্রা প্রকাশ করে যে হাইয়া রাস্তায় গিয়ে নারীদের নিজ নিজ গল্পগুলি ভাগাভাগি করে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আন্দোলনটিকে আরো প্রশস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

উদাহরণস্বরূপ, হাইয়া জেনেছে যে অনেক চিকিৎসক অবিবাহিত নারীদের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা করতে চান না; নিরাপদ গর্ভনিরোধের অনুরোধগুলি প্রত্যাখ্যান করা হয়; বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে ভারতে ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত বৈধ গর্ভপাতগুলির জন্যে অধিকাংশ সময় ব্যয়বহুল অবৈধ ক্লিনিকগুলিতেই রেফার করা হয়।

নিন্মমানের সরকারি ব্যবস্থা এবং বেসরকারি সেবাদাতাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা [11]র মানেই হলো গর্ভপাতের খরচ বেশিরভাগ রোগীর – বিশেষত অবিবাহিতদের – আর্থিক সামর্থের বাইরে।

প্রচারণাটির হ্যাশট্যাগ #আমার_গাইনি_গল্প [12] একটি অত্যন্ত যৌন রক্ষণশীল সমাজ বিরচিত স্বাস্থ্যসেবা – শারীরিক ও মানসিক উভয় – ব্যবস্থার মারাত্মক কয়েকটি পরিণতির প্রমাণ তুলে ধরে।

লেখিকা, গায়িকা এবং নারীবাদী অস্মিতা ২০১৯ সালে টুইট করেছেন:

অবিবাহিত নারী হিসেবে গাইনি চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ইতোমধ্যেই একটি মারত্মক চাপের অভিজ্ঞতা। প্রাক-বিবাহ যৌন সম্পর্কের নিষেধাজ্ঞা, বাবা-মায়ের এই সব খুঁজে পাওয়ার ভয় আমাদের যৌন স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া খুব কঠিন করে তোলে! নিজের বিচার চাপিয়ে দেওয়া চিকিৎসকদের উচিৎ নয়। #আমার_গাইনি_গল্প

এবং লেখিকা মনজিমা মিশ্র বলেছেন:

স্বাস্থ্যসেবা অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। এটি আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন স্তরের জনগণকে একটি সামাজিক সুরক্ষা জাল প্রদান করে। যারা বয়স এবং আর্থিক কারণে অসুবিধায় রয়েছে তাদের জন্যে গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ সাশ্রয়ী মূল্যের হওয়া উচিৎ। #আমার_গাইনি_গল্প

এসব প্রমাণাদি নিয়ে সজ্জিত হাইয়ার পরবর্তী লক্ষ্য ছিল চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলির মধ্যে অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আনতে তারা চিকিৎসকদের সমর্থন প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিল।

চিকিৎসক এবং অবিবাহিত নারীদের মধ্যে হাইয়া'র একটি প্রাথমিক আলোচনায় উপস্থিত থাকা চিকিৎসক ডাঃ শেহলা জামাল বর্তমানে এই প্রচারণায় তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে জড়িত রয়েছেন। দিল্লি থেকে তিনি আমার সাথে ফোনে কথা বলেছেন:

এর আগে আমি ত্রিশের কোটায় থাকা স্বত্ত্বেও অর্থাৎ ততটা বয়স্ক না হলেও আমি আমার চিকিৎসা করা সব অবিবাহিত মেয়ে্দের নিয়ে বাছ-বিচার করতাম। কিন্তু সেই ধরনের সামাজিক চিন্তাভাবনাগুলি হলো বদ্ধমূল। আমাদের যা কিছু শেখানো হয়েছে, চারপাশে যা কিছু দেখছি আমরা সেরকম একপাক্ষিক ভাবেই ভাবতে চাই। কেউ এসে আমাদের এই সমস্যাটির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন না করা পর্যন্ত বিষয়টি গুরুত্ব দিই না, এটা নিয়ে অন্যভাবে ভাবিও না।

এই প্রচারণাটি পরে স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে নারীদের চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসকদের জন্যে এক সেট ন্যূনতম মান [16] স্থির করে। চিকিৎসার আগে চিকিৎসকরা প্রায়শই স্বামীর অনুমতি চান বলে এই “১০টি শিল” এর মধ্যে গোপনীয়তা বজায় রাখা এবং নারী রোগীদেরকে স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে চিকিৎসা করার মতো নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এই প্রচারণাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হলো, ২০১৯ সালে এই মানদণ্ডগুলিকে দিল্লির অন্যতম বৃহত্তম চিকিৎসা সমিতি দিল্লি চিকিৎসা পর্ষদসহ দু’টি মেডিকেল কাউন্সিল গ্রহণ করেছে [17]

করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালে কলঙ্কের আগে স্বাস্থ্য তার বিস্তৃতি বাড়াতে অনলাইনে চলে যাওয়ায় ভারতে অবিবাহিত মহিলাদের যৌন স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ করাটা আর কঠিন থাকেনি। যোগাযোগের প্রধান বাহন হিসেবে ইনস্টাগ্রাম [18] ব্যবহার করে প্রচারাভিযানটি সাড়া দেওয়ার মতো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগগুলি ভাগাভাগি করছে এবং নারীদের যৌন স্বাস্থ্য উদ্বেগ নিয়ে ডাক্তারদের সাথে অনলাইনে আলোচনা করার সুযোগ দিয়ে  “অ্যাক্সেসের দিনের” আয়োজন করে থাকে।

View this post on Instagram

A post shared by Health Over Stigma (@healthoverstigma) [19]

এই অভিযানটি এখন “রক্ষক” নামে  অবিবাহিত নারী স্বেচ্ছাসেবীদের এবং দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা এবং গৌহাটি – এই  চারটি শহর জুড়ে বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে রোগীদের চিকিৎসা করতে ইচ্ছুক  চিকিৎসকদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার [20] প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। গোষ্ঠীগুলি এখন অনলাইনে সাক্ষাৎ করছে, গল্প ভাগাভাগি করছে এবং কীভাবে পরিবর্তন আনতে হবে তার কৌশল অবলম্বন করছে। এই আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়লেও ভারতের সামাজিক কাঠামো বিকাশ অব্যাহত থাকায় আরো অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে।

জয়পুরে সদ্য একা হওয়া দেবী তার প্লেটের চারপাশে ছোলে ভাতুরে [21] সরিয়ে রেখে আড্ডা দিতে দিতে তিনি বলেন, “ভারতে সবাই সেক্স করছে। “কিন্তু সেগুলি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে”, তার মতো অন্যদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে ফেসবুককে চালাতে চালাতে তিনি বলেন।