বিশ্বজুড়ে কোভিড ১৯ এর প্রভাব সম্পর্কে গ্লোবাল ভয়েসেস এর বিশেষ প্রতিবেদন দেখুন।
কোভিড ১৯ নামের মহামারির মাঝেই, জাপানের এক প্রিয় খাবার আগের চেয়ে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং মেডিকেল মাস্ক এর মতই সয়াবিন থেকে তৈরি নাট্টো চটচটে,আঁশ যুক্ত এবং কারো মতে অত্যন্ত আঠলো এক খাবার, আর বিশ্বাস করা হয় এই খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ২০২০ এর মার্চ ও এপ্রিলে জাপানের সুপারমার্কেটের তাক থেকে এই খাবার উধাও হয়ে যায়। তবে সৌভাগ্যক্রমে যে কেউ ঘরে বসেই নাট্টো তৈরি করতে পারে।
অনেক সময় নাট্টোকে পনিরের সাথে তুলনা করা হয়। নাট্টো জাপানের এক ঐতিহ্যবাহী প্রচলিত এক খাবার যা ফারমেন্টড বা গেঁজিয়ে তোলা পদ্ধতিতে সয়াবিন থেকে তৈরি হয়, যার নাম বাচিলাস সাবটাইটেল প্রক্রিয়া অথবা নট্টোকিন এর মাধ্যমে। এর সমৃদ্ধ উমামি স্বাদের ( টক, মিষ্টি, তেতো ও ঝাল এর সাথে আরেকটি স্বাদকে যুক্ত করা হয়েছে যা স্বাদের সাথে একটা মজাদার গন্ধ প্রদান করে) কারণে এটি পছন্দনীয়, নাট্টো হচ্ছে জাপানের অনেক এলাকার প্রতিদিনের জনপ্রিয় ও সুলভ মুল্যের এক খাবার, আর এটি ভাত কিংবা টোস্ট, সুশি রোল, স্প্যাঘেটি অথবা কারাশি নামের ঝাল সর্ষে অথবা সাইট্রাস পনজু সস (লেবু জাতীয় ফল থেকে তৈরি সস) এ মিশিয়ে একে শুধু আলাদা খাবার হিসেবে খাওয়া যায়।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে নেক্সার নামে জাপানের এক ভোক্তা গবেষণা কোম্পানি আবিস্কার করে যে তাদের করা জরিপের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যক্তি নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য খাদ্য তালিকায় বিশেষ খাবার রাখে। এই জরিপে দেখা গিয়েছে রোগ প্রতিরোধক খাবার হিসেবে রসুন ও আদা ছিল জাপানীদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার জনপ্রিয় খাবার, অন্যদিকে গাঁজানো খাবার যেমন দই ও নাট্টো তালিকার শীর্ষে ছিল।
একই সাথে মার্চ মাসে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আয়ু বৃদ্ধির এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণ ছিল মূলত ঐতিহ্যগত ভাবে নাট্টো এলাকা হিসেবে পরিচিত ইবারাকি ও আইওয়া এর মত অঞ্চল এ তুলনামূলক ভাবে কোভিড১৯ এর সংক্রমণের নিম্ন হার। ফলে দোকানদারেরা নাট্টো মজুত করা শুরু করে। জাপানের ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠান এমন চিন্তা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করে যে নাট্টো নামের খাবার হয়ত কোভিড ১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে ।
এপ্রিল ২০২০ এর শেষে জাপানে নাট্টোর ঘাটতি দেখা দেয় এবং এই খাবারটি প্রচার মাধ্যমে কোভিড ১৯ থেকে সেরা ওঠার ক্ষেত্রে কেবল মাত্র বিশেষ খাবারের একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়, একই সাথে উড ক্রেসট (正露丸, সেরিওগান, কাঠে লাগানো আলকাতরা উপজাত উপাদান), এবং ব্লাক টি, রসুন ও কোকেইনও এই তালিকায় যুক্ত ছিল।
জাপানে দীর্ঘায়ু সাথে নাট্টো নামের খাবারকে যুক্ত করা হয়েছে
তবে, সম্প্রতি জাপানে দুটি গবেষণায় পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যাচ্ছে নাট্টো যদিও কোভিড ১৯ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে না তবে ফারমান্টেড এই “সুপারফুড” হয়ত সরাসরি জাপানের জনগণের দীর্ঘায়ু প্রদানের সাথে যুক্ত। ১৯৯২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাপানের তাকাইয়ামা শহরের নাগরিকদের খাদ্যাভাস ও এর স্বাস্থ্যগত ফলাফল বিষয়ে এক গবেষণা করা হয়। এতে দেখা গেছে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সপ্তাহে যারা দিনে অন্তত একবার নাট্টো গ্রহণ করেছে তাদের হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যুর হার নাট্টো গ্রহণ না করাদের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম।
৯০,০০০ এর মত মধ্য বয়স্ক ও বয়স্ক নাগরিকদের উপর ১৫ বছর ধরে পরিচালনা করা জাপানের জাতীয় ক্যান্সার সেন্টার পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে বিশেষকরে নাট্টোর মত সয়া জাতীয় খাবার প্রত্যক্ষ না হলে পরোক্ষ ভাবে হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মত রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনে।
যদিও নাট্টো গ্রহণ করার সাথে দীর্ঘায়ু লাভ করা বিষয়টি প্রমাণিত নয় তবে এই খাবার নিয়ে একটা তবে একটা তত্ত্ব রয়েছে, নাট্টোর মধ্যে নাট্টোকিনাসে নামের এক এনজাইম যা চটচটে আঠালো নাট্টোতে পাওয়া যায়, এই উপাদান রক্ত জমাট বাঁধতে বাঁধা দেয় ও হৃদরোগ এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।
‘গাঁজানো খাবার বিশুদ্ধতা, আনন্দ ও স্বাধীনতা প্রদান করে ‘
এর উমামি সুগন্ধ এড়ানো অসম্ভব অথবা নাট্টোর সুপারফুড এর সুনাম সত্ত্বেও এর দুর্দান্ত গন্ধ এবং আঠালো ভাবের কারণে অনেকে এর থেকে দূরে থাকে। জাপানের বাকী অংশের তুলনায় টোকিওর আশেপাশের এলাকা ও পূর্ব জাপানে নাট্টো বেশী জনপ্রিয়।
“ গ্লোবাল ভয়েসেসকে প্রদান করা এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক, লেখক এবং ফটোগ্রাফার জন অ্যাশবার্ন বলেন, ” শুরুতে আমি নাট্টো সম্বন্ধে তেমন একটা আগ্রহী ছিলাম না।। যখন সাসা (একজন রাঁধুনি ও অ্যাশবার্নের স্ত্রী) কাচা কোয়েল পাখির ডিমের এবং এক বিশেষ ধরনের পেয়াজ কুচি দিয়ে প্রস্তুত করে –আর উভয় উপাদান পরিবেশন এর ফলে দুটির গন্ধ কমে আসে সেই শিক্ষা হয়েছিল-আর তখন থেকে আমি এটি পছন্দ করা শুরু করি।”
অ্যাশবার্ন দীর্ঘ সময় ধরে কিয়োটো শহরে বাস করছেন এবং নিজেকে মাশরুম চাষী ও উৎপাদনকারী বলে অভিহিত করে, জাপানী খাদ্য বিষয়ে উত্তম লেখক অ্যাশবার্ন এই বিষয়ে লোনলি প্লানেট গাইড বুকে লিখেছেন
অ্যাশবার্ন নিজের নাট্টো নিজেই তৈরি করে
“অ্যাশবার্ন বলেন গাঁজানো প্রক্রিয়া খাবারে বিশুদ্ধতা, আনন্দ এবং স্বাধীনতা প্রদান করে। আপনি নিজে ঘরে নাট্টো বানিয়ে খাদ্যশিল্পের সাথে জড়িত কোম্পানির একচেটিয়া প্রাধান্য এড়াতে পারেন। এটি বিশেষ, ব্যক্তিগত, প্রায় অসম্ভব এবং এমন এক বিষয় যার পুনরাবৃত্তি ঘটানো প্রায় অসম্ভব। এমন কী যদিও আমি চাই, আমি মনে করি না প্রতিবার আমার নাট্টো একই রকম হবে। “
অ্যাশবার্ন বলছেন তিনি যে সীম (সয়াবিন) ব্যবহার করেন সেগুলো বিভিন্ন ধরনের হয় সীম ও বিভিন্ন প্রক্রিয়া তিনি নাট্টো তৈরি করেন। কখনো সীম ভাপিয়ে আবার কখনো সিদ্ধ করে, আবার কখনো হালকা আচে প্রস্তুত করেন কোনবুতে মিশিয়ে, তবে প্রায়শ সেটি ছাড়া।
” অ্যাশবার্ন জানান, “মনে হয় এই নাট্টোর অণুজীবগুলির নিজস্ব অণুবীক্ষণিক মনের এক অন্য রকম গুণ আছে। ঘরে বসে সামান্য পরিমাণ নাট্টো তৈরির ক্ষেত্রে এর রন্ধন প্রণালীর চেয়ে এর গাঁজন প্রক্রিয়া আমাকে বেশী আকৃষ্ট করে।” .
ঘরে কী ভাবে নাট্টো বানাতে হয়
জাপান ছাড়া যে সকল রাষ্ট্রে নাট্টো জনপ্রিয়, সেখানকার সুপারমার্কেটেও এই খাবারটি পাওয়া কঠিন, তবে সঠিক উপাদান এবং রান্নার সারঞ্জাম পেলে যে কেউ ঘরে বসে নাট্টো বানাতে পারে।
হালকা আঁচ এর মাধ্যমে জীবানুমক্ত কাঁচের বোয়ম অথবা এমন কি প্লাস্টিক এর বোতল এর মাধ্যমে ওভেন এ নাট্টো তৈরি করা যেতে পারে। ইনস্টান পট অথবা প্রেসার কুকার ব্যবহার করে সহজে নাট্টো তৈরি করা যেতে পারে। নাট্টো স্টাটার স্পোরস এর খুঁজে পাওয়া একটা প্রধান সমস্যা, যার মধ্যে নাট্টোকিন থাকে আর এটাই ফারমানটেশন এর জন্য জরুরি। বিশাল পরিমাণ নাট্টোর জন্য দ্রুত একটা পদ্ধতি হচ্ছে প্যাকেজ নাট্টো ব্যবহার করা।