এই পোস্টটি শুভাশীষ পানিগ্রাহীর ডিজিটাল পরিচয় ফেলোশিপের [4] অংশ হিসেবে জ্যোতি [5]তে প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল। গ্লোবাল ভয়েসেসের জন্যে এটি সম্পাদনা করা হয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম বায়োমেট্রিক পরিচয় ব্যবস্থা আধার [6] ভারতীয়দের একটি ১২-সংখ্যার অনন্য পরিচয় নম্বরের মাধ্যমে বহু ধরনের নাগরিক সুবিধার পরিষেবায় যুক্ত করে। কর্মসুচিটি ভারতে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সহায়তা করার জন্যে বিদ্যমান এবং ভবিষ্যত উভয় সময়ের আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলির প্রযুক্তিগত সমাধান এর উদ্দেশ্যে [7] প্রণীত। বাস্তবে এটি ঠিক বিপরীত কাজ করেছে – এবং প্রান্তিক [8] ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলির [9] বর্জনকে গভীরতর করেছে।
২০০৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আইএনসি) সরকারে থাকাকালে আধার রূপ নিতে শুরু করলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অনেক প্রদেশে শক্তভাবে প্রভাবশালী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে আগ্রাসী বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করছে। তাই ব্যবস্থাটি কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক উভয় কর্মসুচিতে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হলেও বর্জন অব্যহত রয়েছে।
আশা করা হয়েছিল যে এক দশক পরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান এবং ১৯৪৭ সালে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হওয়ার অনেক পরেও অব্যাহত দেশটির বর্ণগত নিপীড়নের [10] দীর্ঘ ইতিহাসের মতো বিষয়গুলির সমাধান করবে আধার। উল্টো এর কারণে বহু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মৌলিক সুযোগসুবিধা এবং পরিষেবাগুলিতে প্রবেশাধিকার না পেয়ে আরো অনেক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে।
‘প্রান্তিক আধার’ প্রকল্পের (ফিল্ড ডায়রি #১ [11], #২ [12] এবং #৩ [13] দেখুন) জন্যে পরিচালিত গবেষণার অংশ হিসাবে এই ধরনের কয়েকটি সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে কথোপকথন বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সত্তা প্রদর্শিত ‘প্রযুক্তি-সমাধানবাদে [14]’ নিরঙ্কুশ বিশ্বাসের ফলে সবচেয়ে প্রান্তিক যারা তারা আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তবে ভারতীয় সমাজের সর্ববিস্তৃত সামাজিক নিপীড়ন থেকে বিশেষত আধার প্রসঙ্গে বেরিয়ে আসা প্রযুক্তিগত পক্ষপাতগুলি এখনো সমাধান করা যায় নি।
‘গণবর্জনের প্রযুক্তিগত অস্ত্র’
সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক, ভাষাগত, ধর্মীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে পিরামিডের নীচে থাকা ব্যক্তিদের জন্যে সুযোগ-সুবিধায় প্রবেশাধিকারের মতো বিভিন্ন জনমিতির আতশ কাঁচের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিপাত করলে দেখা [13]যায় আধার এর মতো একটি জাতীয় বায়োমেট্রিক-ভিত্তিক পরিচয় ব্যবস্থা নাগরিকদের কাছে যা বোঝায় একজন কেবল তার সামান্যই উপলব্ধি করতে পারে।
পরিচয় ব্যবস্থাগুলিকে প্রকৃতিগতভাবেই সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং ব্যাপকবিস্তৃত অসমতা থেকে শুরু করে আদিবাসীদের [15] বিশেষভাবে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ উপজাতি গোষ্ঠীগুলির [16] সাথে সূক্ষ্ণতর সম্পর্কের মতো ব্যক্তিগত অধিকারের নানা বিষয়কে যুক্ত করতে হয়। সেটা না করা হলে সমাজের বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি বুঝতে না পারা সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ‘গণবর্জনের প্রযুক্তিগত অস্ত্র [9]‘ গড়ে তুলে।
উদাহরণস্বরূপ দুস্থদের মধ্যে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করার কেন্দ্রীয় সরকারের একটি উদ্যোগ গণবিতরণ ব্যবস্থার [17] (পিডিএস) মাধ্যমে খাদ্য রেশন বিতরণে বায়োমেট্রিক-ভিত্তিক প্রমাণীকরণের জন্যে আধার প্রয়োগ করা হয়। নিশ্চিতভাবেই উদ্দেশ্যটি দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্যে হলেও দেশটির আদমশুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে যে ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অভাবী মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ১০ লক্ষ থেকে ২২% বৃদ্ধি [18] পেয়ে ২ কোটি ৬৮ লক্ষ হয়েছে।
প্রযুক্তি প্রাসঙ্গিকীকরণ
বিশেষত ভারতে পদ্ধতিগত বর্ণ বৈষম্যের প্রসঙ্গ না এনে প্রযুক্তি নিয়ে কোন আলোচনাই করা যায় না। আগের যেকোন সময়ের তুলনায় দেশের রাজনৈতিক শক্তির গতিশীলতা অনেক বেশি জাতিগতভাবে বিভাজিত হয়েছে – তারা এখন বর্জনের যন্ত্রাংশে পরিণত হয়েছে।
বর্ণ ব্যবস্থা [19] হিন্দু ধর্মের লোকদের চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করে, যার মধ্যে কিছু লোককে বর্ণের বাইরের বা ‘অস্পৃশ্য’ [20] বলে মনে করা হয়। প্রগতিশীল বক্তব্যে এই সম্প্রদায়গুলি সম্মিলিতভাবে দলিত হিসেবে পরিচিত; ভারতের সংবিধানে এদেরকে তফসিলি সম্প্রদায় [21] (এসসি) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন “উচ্চ বর্ণ” হিন্দু [22] আধিপত্যের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি বিভাজনমূলক নীতির মাধ্যমে দলিত, মুসলমান, আদিবাসী সম্প্রদায় এবং আরো বেশ কয়েকটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাদ দেওয়ার জন্যে চাপ দিচ্ছে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এই নীতিগুলির প্রযুক্তিগত বাস্তবায়ন প্রায়শই সহজাত এবং গুরুতর নকশা ত্রুটি [23]তে অনুদিত হয়।
স্থানীয় ভাষায় তথ্যে প্রবেশাধিকার
মজার ব্যাপার ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নথিভুক্ত ৪০২টি ইন্টারনেট বন্ধের [25] একটি দেশে আধার ব্যবস্থাটি কাজ করার জন্যে ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করে। খাদ্য রেশন পেতে ইচ্ছুক লোকেদের তাদের পরিচয় আঙ্গুলের ছাপ নির্ভর একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবশ্যিকভাবে প্রমাণের পর রেশন কেন্দ্রগুলির কর্তৃপক্ষকে সেই তথ্য যাচাই করতে একটি অনলাইন পোর্টাল ব্যবহার করতে হয়।
একইরকম উদ্বেগজনক বাস্তবতা হলো ইতোমধ্যে বৃহৎভাবে বাদ পড়ে যাওয়া মূলত স্বল্প-আয়ের গোষ্ঠী থেকে আসা ১০ কোটি ৪০ লক্ষ আদিবাসী তাদের মাতৃভাষায় আধার সম্পর্কিত কোনও তথ্য খুঁজে না পাওয়ার কারণে আরো দূরে সরে গেছে।
নিচের ভিডিওটিতে ভারতের উড়িষ্যার সোরা ভাষায় [26] কথা বলা মঞ্জুলা ভূঁইয়া কারো মাতৃভাষায় ডিজিটাল পরিচয় সম্পর্কিত তথ্যে প্রবেশাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ক্যাপশন এবং লিখিত অনুলিপিসহ ডাউনলোডযোগ্য ভিডিওগুলি এখানে [27] পাওয়া যাবে।
ঘোষিত অবৈধ নাগরিক
সর্ববিস্তৃত এই পক্ষপাতের প্রভাব ব্যাপক। আধার ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে স্বল্প আয়ের দলিত ও মুসলমান পরিবারের স্কুল শিক্ষার্থীরা বৃত্তি বঞ্চিত [28] হচ্ছে এবং নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে বলে মুসলমান নাগরিকদের [29] হয়রানি করা হচ্ছে।
আসাম রাজ্যের মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – অবৈধ অভিবাসী নির্মূলের জন্যে তৈরি জাতীয় কর্মসূচি জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন [30] (এনআরসি) চলাকালে রাজ্যটির ৩ কোটি ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ১৯ লক্ষ [31] অধিবাসীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
নিচের ভিডিওটিতে বলা হয়েছে ১৯ লক্ষ অধিবাসীকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে ডিজিটাল পরিচয়ের পরিস্থিতিটি একটি সংকটপূর্ণ দিকে মোড় নেয়। ক্যাপশন এবং লিখিত অনুলিপিসহ ডাউনলোডযোগ্য ভিডিওগুলি এখানে [32] পাওয়া যাবে।
কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এনআরসি প্রয়োগ কিছু সময়ের জন্যে থেমে থাকলেও ইতোমধ্যে অবৈধ ঘোষিতদের মধ্যে সন্ত্রাসের নতুন তরঙ্গ উদ্ভূত হতে শুরু করেছে।
বৈষম্যের শিকার বহু অসমিয়া মুসলমানদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা রাজনৈতিক কর্মী আশরাফুল হুসেন, সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন ” এনআরসি অভিযানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বেশিরভাগ মুসলমান – এমনকি [পশ্চিম] বাংলার বংশোদ্ভূত হিন্দুদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘আদি বাসিন্দা [33]‘ বিভাগ থেকে বাদ দিয়েছে।”
আরও পড়ুন: Millions in India's north-eastern Assam state at risk of losing citizenship [34] (নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের লক্ষ লক্ষ মানুষ)
“বৈধ নাগরিক” তালিকার বাইরে ফেলে দেওয়া ১৯ লক্ষ লোকের একটি শেষ আশ্রয় হলো তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্যে বিদেশীদের ট্রাইব্যুনাল হিসেবে পরিচিত একটি বিচারিক প্রক্রিয়াতে হাজির হওয়া [35]।
তবে হুসেন আশংকা করছেন লকডাউন বিধিনিষেধের ফলে ইতোমধ্যে আরো দরিদ্র হয়ে ওঠা প্রান্তিক মানুষদেরকে কোভিড-১৯ এর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরে নাগরিকত্ব প্রমাণ সম্পর্কিত তাদের আইনী ব্যয়গুলি মেটাতে হবে – এভাবে বর্জন আরো অনেক বিস্তৃত হবে। হুসেনের মতে, “নিরক্ষর হওয়ার কারণে অনেক মুসলমান নারী পিতামাতার সাথে তাদের যোগসূত্র স্থাপনের প্রমাণাদি খুঁজে পায়নি। একারণে তাদের শিশুসহ তারা [এনআরসি] তালিকার বাইরে চলে গেছে।”
এনআরসি আধারের সাথে গভীরভাবে জড়িত। অ্যাটর্নি তৃপ্তি পোদ্দার ব্যাখ্যা করেছেন [36], এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালীন ব্যক্তিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। এনআরসিতে যারা এটা করতে পেরেছে তাদের আধার দেওয়া হয়েছে; যারা করতে পারেনি তাদেরটি অস্বীকার করা হয়েছে। পোদ্দার আরো যুক্তি দেখিয়েছেন, ভারতে বসবাসকারী বিদেশীরাও আধার পেতে পারে, কিন্তু এনআরসিতে চিহ্নিত ভারতীয় নাগরিকদের কাছ থেকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে।