গত ২৪ এপ্রিল তারিখে নেটফ্লিক্সে এক্সট্রাকশন (যার পূর্ব নাম ছিল ঢাকা) চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়, আর ব্যাপক দর্শক নন্দিত হয়। প্রথম চার সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৯ কোটি দর্শক এই চলচ্চিত্রটি দেখে। করোনা ভাইরাসের লকডাউনের সময় এই ছবিটি কেবল নেটফ্লিক্সে মুক্তি দেওয়ায় প্রচুর বাংলাদেশী নাগরিক এটি অনলাইনে দেখতে আগ্রহী হয় কারণ চলচ্চিত্রটির পটভূমি ছিল ঢাকা শহর। তবে বাংলাদেশ ও এর রাজধানী ঢাকাকে ভুলভাবে উপস্থাপনের কারণে এই চলচ্চিত্রটি প্রবল সমালোচনা ও বিতর্কের মুখেও পড়ে।
The way Dhaka was shown in Extraction, the Netflix Original movie, it was ridiculous. They made it seem like Dhaka is full of slums which portrays how they look down to us. It's pathetic how they've shown the worst places in the world to be in Dhaka. Pathetic! #ExtractionNetflix
— Tazreen Alam (@AlamTazreen) April 26, 2020
নেটফ্লিক্সের নিজস্ব চলচ্চিত্র এক্সট্রাকশন এ ঢাকাকে অদ্ভুতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, মনে হচ্ছে তাদের চোখে ঢাকা হচ্ছে এক বস্তির নগরী আর এভাবেই তারা আমাদের বস্তির বাসিন্দা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
চলচ্চিত্রের যত ভুলঃ
এক্সট্রাকশন দিয়ে হলিউডের জনপ্রিয় স্টান্ট কোঅরডিনেটর স্যাম হারগ্রেভ এর চলচ্চিত্র নির্দেশনার শুরু, যাতে অ্যাভেঞ্জার সিনেমার থর চরিত্রে নন্দিত অভিনেতা ক্রিস হেমসওয়ার্থ অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রটির অন্যতম দুই প্রধান চরিত্র টাইলর রেক (ক্রিস হেমসওয়ার্থ) ও নিক খানকে (গোলশিফতে ফারহানী) ভারতীয় এক কারাবন্দী মাদক সম্রাট ভাড়া করে বাংলাদেশের এক মাফিয়া বসের হাতে কিডন্যাপ হওয়া তার পুত্রকে উদ্ধারের জন্য। আন্দ্রে পার্কস রচিত সিউদাদ নামের এক গ্রাফিক নভেল এর এই কাহিনী প্যারাগুয়ের সিউদাদ দেল এস্টে নামের শহরের প্রেক্ষাপটে রচিত, যাতে সে শহরের বাস্তবতা উঠে এসেছে। এই মুভির চিত্রনাট্যকার ভ্রাতৃদ্বয় জো ও অ্যান্থনি রুশো মূল কাহিনী বদলে এর পটভূমি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার এক শহরকে বেছে নেন।
যদিও গল্পের পটভুমি বাংলাদেশ এর রাজধানী শহর ঢাকা কিন্তু এর দৃশ্যায়ন এর জন্য বেছে নেওয়া হয় ভারতের আহমেদাবাদ ও মুম্বাই শহরকে, আর এর বেশ কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয় থাইল্যান্ডের ব্যাং পং শহরে। তবে এই মুভিতে বাংলাদেশের কিছু সত্যিকারের ছবি ব্যবহার করা হয় যেমনটা হারগ্রেভ তার ইনস্টগ্রাম অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেছেঃ
Dhaka in “Extraction” versus Dhaka in real life pic.twitter.com/OdaqNcMkcs
— m? (@mhaanbiizba) May 6, 2020
এক্সট্রাকশন চলচ্চিত্রে ঢাকা বনাম আসল ঢাকা
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের এই মুভির বিষয়ে অভিযোগ হচ্ছে এতে স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়ে যথাযথ গবেষণা করা হয়নি। বরং এতে ঢাকা শহরকে অনেক বেশী একপেশে ভাবে সহিংস এবং উত্তেজনাপূর্ণ এক শহর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এছড়াও চলচ্চিত্রে যে ভাবে একজন মাদক সম্রাটের ইশারায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন জৈষ্ঠ কর্মকর্তা ক্রিস হেমসওয়ার্থ অভিনীত চরিত্রের বিরুদ্ধে তার বাহিনীকে লেলিয়ে দেন সেটিও বাংলাদেশকে এক ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে।
ছবিটি দেখে ঢাকার বাসিন্দা ও পেশায় স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন ফেসবুকে মন্তব্য করেছেঃ
এক্সট্রাকশন ছবিটা দেখলাম।
বেশি মারপিট। স্টোরি বলে কিছু নাই। স্টান্টবাজি দিয়ে কভার করার চেষ্টা।
বিদেশীদের চোখে ঢাকা শহরকে দেখার জন্যই আগ্রহ নিয়ে ছবিটা দেখলাম।
বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই এই ছবি দেখে অপছন্দ করবে। কারন ঢাকাকে খুব বাজে ভাবে দেখানো হয়েছে।
পেশায় ব্যাংকার ও মুভি পাগল মুকিত আল রহমান গ্লোবাল ভয়েসেসকে এই মুভির এক রিভিউ প্রদান করেছেঃ
নিঃসন্দেহে এটি মান সম্পন্ন অ্যাকশন দৃশ্যে ভরপুর এক মুভি। তবে ঢাকা তথা বাংলাদেশের এক নাগরিক হিসেবে যে ভাবে ঢাকাকে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আমি রীতিমত আঁতকে উঠেছি আর আবার সেই সাথে কিছু ক্ষেত্রে হাসি চেপে রাখতে পারিনি। এই মুভির অনেক অভিনেতা যদি ঢাকার কিন্তু তাদের মুখের ভাষা কলকাতার (যদিও অভিনেতাদের অনেকে বিহারীদের মত কথা বলছে তবুও সেটি মেনে নেওয়া যায়)। আবার বিপরীতে ভারতীয় চরিত্রের অভি বা সাজুর মত একেবারে খাঁটি বাংলা নামও মেনে নেওয়ার মত নয়। এই মুভিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে যে বাড়াবাড়ি রকমের নেতিবাচক ভাবে প্রদর্শণ করা হয়েছে, সেটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। তবে ঢাকা শহরকে এই মুভিতে ঢাকা বলে মনে হয়নি, মনে হয়েছে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা অথবা আফ্রিকার কোন একটা শহর। তবে আমি ভাবছি, এই গল্পের জন্য কেন ঢাকার নাম বেছে নেওয়া হল। মনে হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির তেজিভাব এখন এখানে মুভির বাজার খুলে দেওয়ার এক রাস্তা তৈরি হয়েছে, অন্তত অনলাইনে। এখন অনলাইনে মুভি প্রদর্শনকারী প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্সের বাংলাদেশী দর্শকের সংখ্যা বাড়াটা অবশ্যই নেটফ্লিক্স উপভোগ করবে।
সিফাত নাজমুল ইসলাম টুইট করেছেন:
এক্সট্রাকশন একটানা কুড়ি মিনিট দেখলাম। বাংলা ভাষা শুইনা বন্ধ কইরা দিছি… যা দেখছি এনাফ…
— Sifat Nazrul Islam (@sifat2188) April 24, 2020
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার ছাত্র ও কপিরাইটার রেজা ই রাব্বি গ্লোবাল ভয়েসেস এর জন্য একটা রিভিউ ইমেইলে পাঠিয়েছেঃ
এই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আমি মনে করি পরিচালক যাদু দেখিয়েছেন, বিশেষ করে এর অ্যাকশন দৃশ্যে। সিউদাদ নামের এক কমিক বুক থেকে নেওয়া গল্পকে নতুন ভাবে সাজানো হয়েছে, আর প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা করা হয়েছে। আমার মনে পড়ে না সাম্প্রতিক সময়ে আমি এমন দুর্দান্ত এবং গতিশীল অ্যাকশনে ভরপুর হলিউড মুভি দেখেছি। বাকী বিশ্বের মানুষদের কাছে এটি একটি অ্যাকশন মুভি কিন্তু আপনি যদি বাংলাদেশী হন তবে আপনি এক মিনিটের মধ্যে বেশ কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পাবেন।
তবে যদি আপনি অন্যান্য হলিউড মুভিগুলি লক্ষ্য করেন তবে আপনি দেখতে পাবেন যে কোন আন্তর্জাতিক স্থান সম্পর্কে সঠিক বিবরণ এবং সাদৃশ্যের অভাব কোনও নতুন বিষয় নয় এবং সেই স্থানগুলো আপনার পরিচিত না হলে আপনি বরং সেগুলো পছন্দ করবেন। এই মুভিটির কাহিনী ঢাকার উপর হলেও, বাস্তবে এর শুটিং হয়েছে ভারত ও থাইল্যান্ডে। আর বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে গবেষণায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকলেও টান টান উত্তেজনা সৃষ্টিতে এই মুভির কোন ঘাটতি নেই।
এই সমস্যাগুলি থাকলেও এর মারামারির চিত্রায়নটি আকর্ষণীয় ছিল। এমনকি ৫ সেকেন্ডের কোন শটে, ব্যাকগ্রাউন্ডে স্থির বা গতিশীল উভয় বিষয়ই ছিল যা আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে এটি ঢাকা শহরই আপনি দেখছেন।
সুতরাং, চিত্রনাট্য ও চিত্রায়ন অনুসারে, ‘এক্সট্রাকশন’ হলিউডের আরেকটি উপভোগযোগ্য অ্যাকশন ফিল্ম যাতে অনেকগুলি গতানুগতিক গল্প ছিল – ভাড়াটে সৈনিক, অপহরণ, এক্সট্রাকশন (তুলে আনা) ইত্যাদি। তবে সব মিলিয়ে নতুন লোকেশনে এটি উপভোগযোগ্য ছিল।
চলচ্চিত্রে এই বাংলা র্যাপ গানটি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কিছুটা অরিজিনাল ভাব পাওয়া গেছেঃ
তবে অনেক বাংলাদেশী এই মুভি নিয়ে হতাশ নয়। অনেক নাগরিক এক্সট্রাকশন চলচ্চিত্রের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি জাভেদ ইকবাল ফেসবুকে লিখেছেন:
যে কোন পাবলিসিটিই ভাল পাবলিসিটি। [..] তারা দর্শকদেরকে নতুন লোকেশন দিতে চেয়েছে। নেটিফ্লিক্সের প্ল্যান, আগামী ৫ বছরে তারা ইন্ডিয়াতে দশ কোটি নতুন গ্রাহক চায়। তাই ওরা ইন্ডিয়ার ওপর প্রচুর টাকা ঢালছে। এই সিনেমাও সেটার একটা উদাহরণ। বাংলাদেশেও তাদেরকে আসতে হবে।
এক্সট্রাকশন এর দারুণ সাফল্যের পর জো রুশো জানিয়েছেন এর এক্সট্রাকশন-২ অচিরেই আসছে। তবে রাফিউল হাসান হলিউডকে বাস্তবতার সাথে মিলের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেনঃ
Next time Hollywood centres a movie around Dhaka, they better get everything right down to the last details.
ভবিষ্যতে হলিউড যদি ঢাকা শহরকে নিয়ে কোন ছবি বানাতে চায়, তাহলে অবশ্যই পূর্বে পর্যাপ্ত গবেষণা করে নিবেন।