- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

তিউনিশিয়ায় মিথ্যা তথ্যের সমস্যা থাকলেও বক্তব্যকে (আরো) অপরাধমূলক করা এর সমাধান নয়

বিষয়বস্তু: মধ্যপ্রাচ্য ও উ. আ., তিউনিশিয়া, অ্যাডভোকেসী, আইন, নাগরিক মাধ্যম, মানবাধিকার, জিভি এডভোকেসী

[1]

১৩ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখে নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্র থেকে একজন সাংবাদিক এবং তার ক্যামেরাম্যান প্রতিবেদন করেছেন। গত বছরের নির্বাচনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কলুষিত করে তোলা হয়েছিল। তিউনিশিয়ার নির্বাচন কমিশন আইএসআইই-এর ছবি [পাবলিক ডোমেন]।

মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং নাগরিকদের শোরগোলের পর তিউনিশিয়ায় অনলাইনে ‘‘মিথ্যা’’ এবং ‘‘প্রশ্নবিদ্ধ’’ সংবাদ প্রচারকে অপরাধমূলক করার চেষ্টা করা একটি বিতর্কিত খসড়া আইন প্রত্যাহার করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে লকডাউনের সময় (বর্তমান শাসক জোটের সদস্য) তাহিয়া তুনেস দলের সাংসদ (এমপি) মাব্রুক করচিড উত্থাপিত এবং ৪৬ জন সাংসদ সমর্থিত এই খসড়া আইনটি অনেক তিউনিশীয়কে অবাক করে দিয়েছে।

এতে জার্মানি ও ফ্রান্সকে ‘‘ভুয়া খবর” এর বিরুদ্ধে আইন তৈরি করা গণতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে সুনামের ওপর আঘাত এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করা প্রতিরোধ করার জন্যে তিউনিশিয়ার দণ্ডবিধির ২৪৫ এবং ২৪৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন [2] করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

তবে খসড়া আইনটির ভাষাটি ব্যাপক বিস্তৃত ও অস্পষ্ট এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড বজায় রাখার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা লঙ্ঘন করবে। তিউনিশিয়ার সংবিধানের [3] ৩১ অনুচ্ছেদে মতামত, চিন্তাভাবনা, মত প্রকাশ এবং গণমাধ্যম ও প্রকাশনার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান এবং এসব স্বাধীনতায় পূর্বের যে কোন সেন্সর নিষিদ্ধ করা ছাড়াও ৩২ অনুচ্ছেদে তথ্য এবং যোগাযোগের নেটওয়ার্কগুলিতে প্রবেশাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তিউনিশিয়া আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের অঙ্গীকার (আইসিসিপিআর) [4]-তে স্বাক্ষরকারী একটি রাষ্ট্রপক্ষও বটে।

খসড়া আইনটিতে “ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থার জন্যে অবমাননাকর কোন মিথ্যা বা প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্য” প্রকাশের দায়ে অভিযুক্ত “যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ ব্যবহারকারীদের” বিরুদ্ধে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ থেকে ২০ হাজার তিউনিশীয় দিনার (প্রায় ৩ থেকে ৬ লক্ষ টাকা) জরিমানার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচনের সময়কালে অথবা নির্বাচনের ছয় মাস আগে কেউ এই বিধান লঙ্ঘন করলে তাদের দ্বিগুণ শাস্তির ঝুঁকি নিতে হবে। পরিচয় গোপন করে এধরনের বিষয়বস্তু ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের শাস্তি দ্বিগুণ হতে পারে।

অধিকন্তু, প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি পাবলিক প্রসিকিউটরকে “ইলেকট্রনিক অপরাধ পর্যবেক্ষণ এবং এগুলি সংঘটনকারীদের উন্মোচিত করার বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদান করবে।” নির্বাচনের সময়কালে  প্রসিকিউটরকে এই ধরনের বিষয়বস্তুর বিস্তার রোধে ”প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ” করতে হবে।.

২০২০ সালের ১২ মার্চ তারিখের এই খসড়া আইনটি ২৯ মার্চ সংসদে জমা দেওয়া হয়েছিল। এর প্রবক্তারা ২০২১ সালে তফসিলভুক্ত দেশটির আঞ্চলিক নির্বাচনের অজুহাতে তা জরুরিভাবে পর্যালোচনা করার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। তবে খসড়া আইনটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করার সাথে সাথে এর সমর্থকরা অনলাইনে মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং ক্ষুব্ধ নাগরিকদের কাছ থেকে একটি পাল্টা প্রতিক্রিয়া পেয়েছে।

খসড়া আইনটি জমা দেওয়ার একদিন পর খসড়া আইনটির প্রবর্তক করচিড বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কারণে তিনি বিলটি “আপাতত” ফিরিয়ে নেবেন বলে ঘোষণা করেন [5]। আর বেশ কয়েকজন সাংসদও তাদের স্বাক্ষর প্রত্যাহার [6] করে নেওয়ার কথা বলেছেন [6]। আর অন্যান্যদের মধ্যে স্বতন্ত্র সাংসদ সাফি দাবি করেছেন [7] যে তারা শেষ পর্যন্ত জমা দেওয়া খসড়া আইনটির থেকে ভিন্ন সংস্করণের একটি খসড়া আইনকে সমর্থন করেছেন।

‘সংস্কার ছাড়া’ মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা

বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো তিউনিশিয়াতেও মিথ্যা ও ভ্রান্ত তথ্য নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের উপর এ জাতীয় বিষয়বস্তুর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগগুলি গত বছরের রাষ্ট্রপতি এবং আইনসভা নির্বাচনের সময় সামনে চলে এসেছিল। নির্বাচনকালীন সময়ে সামাজিক গণমাধ্যম – বিশেষত ফেসবুক রাজনৈতিক গুজব এবং ভুয়া খবরে সয়লাব [8] হয়ে গিয়েছিল।

৭ এপ্রিল পর্যন্ত ইতোমধ্যে ৬২৮ জনকে আক্রান্ত [9] এবং ২৪ জন নিহত করা কোভিড-১৯ এর বিস্তার নিয়ে লড়াই করা দেশটিতে নির্বাচনগুলির অবসান হলেও গুজবগুলির ছড়িয়ে পড়া অব্যহত রয়েছে [10]। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২৯ মার্চ তারিখে একটি বিবৃতি [11] প্রকাশ করেছে যাতে “জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যারা গুজব এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে” বলে সতর্ক করা হয়েছে।

মিথ্যা তথ্য মোকাবেলা করা একটি বৈধ উদ্দেশ্য হলেও শান্তিপূর্ণ বক্তব্যকে আরো অপরাধীকরণ করা হলে তা কেবল ব্যবহারকারীদের অবাধ ও শান্তিপূর্ণ মত প্রকাশ এবং তথ্যে প্রবেশাধিকারকে আর ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে এবং এর ফলে সেটা ২০১১ সালে বেন আলি সরকারের পতনের পর থেকে বিগত কয়েক বছরে লাভ করা তিউনিশীয় গণতান্ত্রিক অগ্রগতিকে হুমকির সম্মুখীন করবে।

তিউনিশীয় মানবাধিকার লীগ (এলটিডিএইচ), তিউনিশীয় সাধারণ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, তিউনিশীয় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সুরক্ষা সমিতি এবং তিউনিশীয় সাংবাদিকদের জাতীয় সিন্ডিকেট (এসএনজেটি) সহ ২৪টি বিভিন্ন নাগরিক সমাজ সংগঠন, মানবাধিকার ও প্রেস স্বাধীনতা গোষ্ঠী ৩০ মার্চ তারিখে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে [12] সতর্ক করেছিল:

ولئن كان التصدي للأخبار الزائفة أمرا مشروعا، إلا أنه لا يجب أن يتحول إلى مطية لضرب الفصلين 31 و32 من الدستور التونسي عبر استعمال عبارات فضفاضة كالتي وردت في المقترح

মিথ্যা সংবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা বৈধ হলেও সেটা খসড়া আইনটিতে থাকা অস্পষ্ট অভিব্যক্তি ব্যবহার করে তিউনিশিয়ার সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করার অজুহাতে পরিণত হওয়া উচিৎ নয়।

অন্যদিকে দেশটির স্বাধীন সম্প্রচার নিয়ন্ত্রক (এইচএআইসিএ) মিথ্যা এবং ভ্রান্ত তথ্য মোকাবেলা করার জন্যে বহু-অংশীজন (মাল্টি-স্টেকহোল্ডার) পদ্ধতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে [13]:

موضوع الأخبار الزائفة يجب أن يطرح في إطار حوار واسع يجمع كافة المتدخلين من مختصين وهياكل مهنية ومؤسسات إعلامية ومكونات مجتمع مدني لإيجاد الحلول الكفيلة بالتصدي لهذه الظاهرة دون المساس من جوهر الحق في حرية التعبير في تناسق تام مع مقتضيات الفصل 49 من الدستور التونسي

স্বাধীনতার অধিকারের প্রতি কোনরকম সংস্কার ছাড়া এবং তিউনিশীয় সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তার সাথে সম্পূর্ণ মিল রেখে মিথ্যা সংবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ খুঁজে বের করার জন্যে বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে পেশাদার অবকাঠামো, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজ পর্যন্ত সকল অংশীজনকে একত্রিত করে এই (মিথ্যা সংবাদের)  বিষয়টিকে একটি বিস্তৃত সংলাপের কাঠামোর মধ্যে বিবেচনা করা উচিৎ।

৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে [3] যে সংবিধানে নিশ্চয়তা দেওয়া অধিকার ও স্বাধীনতাগুলির উপর বিধিনিষেধ কেবল “একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আরোপ করা যেতে পারে,” এবং তা অন্যের অধিকার সুরক্ষা এবং জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন বৈধ কারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তবে “এসব সীমাবদ্ধতা এবং অভীষ্ট উদ্দেশ্যটির মধ্যে আনুপাতিকতা বজায় রাখার কথা মনে রাখতে হবে।”

তিউনিশীয়দের অনলাইনে মত প্রকাশ এবং তথ্যে স্বাধীনতার অধিকার সীমাবদ্ধ করার এই সাম্প্রতিক প্রয়াসটি স্বল্পমেয়াদী হলেও এই অধিকারগুলি ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ শেষ পর্যন্ত করচিড বলেছেন [5] যে তিনি ’’আপাতত’’ খসড়া আইনটি প্রত্যাহার করলেও তিনি “বুঝেছেন” যে এটি স্বাধীনতার জন্যে হুমকি নয়। সুতরাং ভবিষ্যতে বিধায়কদের এটি আবার অথবা এর অন্য কোন সংস্করণ জমা দেওয়ার চেষ্টা করার সম্ভাবনা রয়েছে।

২০১১ সাল থেকে মানবাধিকারে ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করা তিউনিশিয়ার তালিকায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধতা করার মতো আন্তর্জাতিক মান লঙ্ঘনকারী বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে।

টেলিযোগাযোগ বিধি [14]র ৮৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে কেউ “জনযোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি করতে বা তাদের জীবন বিঘ্নিত করার” জন্যে দোষী সাব্যস্ত হলে তার দুই বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। দণ্ডবিধি [15]র মধ্যে মানহানি এবং “জনশৃঙ্খলা বা বা ভাল নৈতিকতার ক্ষতি সাধনের জন্যে দায়ী” বিষয়বস্তু ছড়িয়ে দেওয়ার অপরাধকে দণ্ডনীয় অপরাধ করে তোলার বিধান রয়েছে।

শান্তিপূর্ণ ভাষণকে আরো অপরাধমূলক করে তোলার পরিবর্তে উল্লিখিত বিধিনিষেধ সংশোধন ও বিলুপ্তির জন্যে তিউনিশীয় সংসদের কাজ করা উচিৎ। কেবলমাত্র সরকারি স্বচ্ছতা এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলির উপর নাগরিকদের আস্থা – এবং গণ ও সংবাদ মাধ্যমগুলির স্বাধীনতার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ জোরদার করার মতো পদক্ষেপগুলিই মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার ক্ষতি না করেই মিথ্যা তথ্যকে প্রতিরোধ করতে পারে।