করোনাভাইরাস লকডাউনের সময় বাংলাদেশিরা ভিডিও সাইটগুলিতে সময় কাটাচ্ছে

বিস্তারিত জানতে গ্লোবাল ভয়েসেসের বিশেষ কভারেজ কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক প্রভাব ^[2] দেখুন।

প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে দুই বিলিয়নেরও বেশি ব্যবহারকারী ইউটিউবে ^[3] এক বিলিয়ন ঘন্টার বেশি ভিডিও দেখেন। প্ল্যাটফর্মটি এত জনপ্রিয় ^[4] যে প্রতি মিনিটে 500 ঘন্টারও ^[5] বেশি ভিডিও আপলোড করা হয় বিশ্বের ১০০র ও বেশী দেশ থেকে।

ধীর ইন্টারনেট গতি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তুলনামুলকভাবে কম থাকার ফলে বাংলাদেশে ইউটিউবের প্রবৃদ্ধি দীর্ঘদিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৮ সালে মোবাইল কোম্পানিগুলো ফোর জি পরিষেবা চালু করার পর ^[6] থেকে দেশে ইউটিউব দর্শকদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এটি বিশেষত বাংলা ভাষায় নতুন ভিডিও নির্মাতাদের প্রণোদনা দিয়েছে যারা সহজে প্রচুর পরিমাণে দর্শক ও নিয়মিত গ্রাহক পেয়েছেন।

করোনাভাইরাসের কারণে চলমান “দেশব্যাপী দীর্ঘ ছুটির ^[7]” (লকডাউন) চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশীরা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫০ শতাংশেরও বেশি সময়ে ইন্টারনেট ডেটা ব্যবহার করছেন বলে রিপোর্ট এসেছে ^[8], এবং তাদের বেশিরভাগ স্থানীয় ভাষায় ইউটিউব এবং ফেসবুক ভিডিও দেখছেন।

মোবাইল ভিত্তিক প্রবৃদ্ধি

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, বাংলাদেশে ১৬ কোটির ^[9] বেশি মোবাইল ফোন গ্রাহক এবং ৯.৯৯ কোটি ^[10] ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিলেন, যার মধ্যে ৯৪ শতাংশের বেশি মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন।

গত তিন বছরে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও ^[11] বেশি বেড়েছে। ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন অনুসারে ^[6], ২০১৮ সালে ইউটিউব দর্শকদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন কোটির মত, তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে এবং আরও ২৩ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে।

২০১৮ সালের জুন মাসে ^[12] সরকার ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম ৫০ শতাংশ হ্রাস করার পরে এই পরিসংখ্যানগুলি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

বিনোদন

স্থানীয় ভাষার ভিডিওগুলির বিষয়বস্তুর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ^[6] হ'ল বিনোদন (৪৭ শতাংশ), সঙ্গীত (২৪ শতাংশ) এবং জীবনযাপন (১৭ শতাংশ)। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন মৌলিক ভিডিও নির্মাতা তাদের প্রকাশিত ভিডিওর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ২০১২ সালে সালমান মুকতাদির তার “স্যামোন দ্যা ব্রাউনফিশ ^[13]” চ্যানেল শুরু করেছিলেন; এখন তাঁর ১৩ লাখের বেশী ইউটিউব গ্রাহক রয়েছে এবং তরুণ বাংলাদেশিদের সমসাময়িক জীবনধারা নিয়ে তাঁর মজাদার ভিডিওগুলো অনেক দর্শকের মনোরঞ্জন করে চলেছে:

অন্যান্য জনপ্রিয় ইউটিউব বিনোদনদাতাদের মধ্যে রয়েছে প্রত্যয় হিরণের “দ্য আজাইরা লিমিটেড ^[14]” এবং “প্র্যাঙ্ক কিং এন্টারটেইনমেন্ট ^[15]“।

তৌহিদ আফ্রিদি ^[16] ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অন্যতম কনিষ্ঠ ইউটিউবার হিসাবে ভিডিও আপলোড শুরু করেছিলেন এবং এখন ত্রিশ লাখের বেশি গ্রাহককে নিয়ে গর্ব করেন। তার ভিডিওর বিষয়বস্তু হচ্ছে মজাদার কৌতুক এবং ব্যক্তিগত ভ্রমণ নিয়ে ভ্লগ যা বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের মন জয় করেছে ^[17]। অন্যান্য ইউটিউবার এর মত আফ্রিদিও করোনাভাইরাস মহামারীর সময় কীভাবে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে সে সম্পর্কে ভিডিও পোস্ট ^[18] করেছেন।

নামেই পরিচয়, “জি-সিরিজ বাংলা মুভিজ ^[19]” হ'ল একটি ইউটিউব চ্যানেল যেখানে বিনামূল্যে বিভিন্ন “ঢালিউড ^[20]” বাংলা চলচ্চিত্রগুলি দেখা যায়, যার অনেকগুলি এইচডি মানের। মাত্র পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া এই চ্যানেলটিতে শত শত চলচ্চিত্র রয়েছে – যা দেশের ভেতরে এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় ত্রিশ লক্ষ বাংলাদেশী গ্রাহককে আকর্ষণ করেছে। “জাজ মাল্টিমিডিয়া ^[21]” সিনেমা ভিত্তিক অনুরূপ একটি বিনোদন চ্যানেল।

বাংলা দর্শকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হচ্ছে বাংলা টেলিভিশন নাটকগুলি, তাই “এনটিভি নাটক ^[22]” এর মত বেশ কয়েকটি নাটকের চ্যানেল রয়েছে যা লক্ষ লক্ষ দর্শক ও গ্রাহককে আকর্ষণ করে প্রতিদিন।

“মায়াজাল ^[23]” বাংলা ভাষায় দেশ বিদেশের বিচিত্র বিষয় নিয়ে করা একটি ভিডিও চ্যানেল। কয়েক যুবক ইউটিউবার এটি চার বছর আগে শুরু করেছিলেন এবং বর্তমানে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

সঙ্গীত

এক চতুর্থাংশ বাংলাদেশি ইউটিউব দর্শক দেখেন বাংলাদেশী ব্যান্ডের গানগুলোর পাশাপাশি সিনেমা এবং টিভি নাটকগুলির গান। ইউটিউবে বাংলা গানের ভিডিও চ্যানেলগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় “ঈগল মিউজিক ভিডিও স্টেশন ^[25]” যার প্রায় ৪৯ লক্ষ গ্রাহক রয়েছে এবং ৯৫ কোটি বারেরও বেশি এর ভিডিওগুলি দেখা হয়েছে এ পর্যন্ত।

জনপ্রিয়তায় তার পেছনে রয়েছে “জি সিরিজ মিউজিক ^[26]“, “অনুপম চলচ্চিত্রের গান ^[27]” এবং “সংগীতা মিউজিক ^[28]“।

“গান বাংলা” স্যাটেলাইট টিভির ইউটিউব চ্যানেল ^[29]ও ১৪ লাখ গ্রাহককে আকর্ষণ করে বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়াও অনেক দর্শকদের পছন্দ “ফোক স্টুডিও বাংলা ^[30]“, যা বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতকে তুলে ধরে:

খাদ্য

অনলাইনে আপনি সহজেই ভারতীয়, এশিয়ান বা পাশ্চাত্য খাবারের রেসিপিগুলি বা রান্নার ভিডিও খুঁজে পেতে পারেন। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বাংলাদেশি খাবারের জন্য তৈরি বাংলা ভাষায় রান্নার ভিডিও খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। কিন্তু এখন ক্রমবর্ধমান হারে বাংলাদেশি ইউটিউবাররা রান্নার ভিডিও আপলোড করা শুরু করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা ^[32] পেয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, “উম্মে রান্নার স্টুডিও ^[33]” এর ১৪ লাখের বেশী গ্রাহক রয়েছে এবং ২১ কোটির বেশী তার ভিডিও দেখা হয়েছে। এইসব ভিডিওগুলিতে রান্নার প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনের যুক্তি ব্যাখ্যা করে এবং প্রায়শই উপকরণ সহজলভ্যে না হলে বিকল্প উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ পুরানো ঢাকার বিখ্যাত “হাজী বিরিয়ানি ^[34]” রেসিপিটি:

“স্পাইস বাংলা ^[36]” অনুরূপ জনপ্রিয় রান্নার চ্যানেল, এবং এতে দেশী খাবারের পাশাপাশি ভারতীয় ও চৈনিক খাবারের ভিডিওর সম্ভার রয়েছে। এদিকে, কেক এবং বিস্কুটের দিকে মনোনিবেশকারী নাহিদা তুলির রন্ধন চ্যানেল ^[37] গত বছর ডিসেম্বরে ১০ লক্ষ গ্রাহকে ^[38] বরণ করেছে।

খবর

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোর অনেক বাড়িতে কেবল টিভি সম্প্রচার ধরার সেবা না থাকার জন্য বাংলাদেশি বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের সম্প্রচার ও সংবাদ পাওয়া দুরূহ। তবে ইন্টারনেট এর দাম কমা এবং স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল এখন ইউটিউব ^[39] এ তাদের বিষয়বস্তু ^[40], বিশেষ করে সরাসরি সংবাদ প্রচারকে ^[41] গুরুত্ব দিচ্ছে। ইউটিউবে এইসব চ্যানেলগুলি বেশ জনপ্রিয় এবং প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে দর্শকদের আকৃষ্ট করে, উদাহরণস্বরূপ ১৮ লাখ ^[42] থেকে ৫০ লাখ গ্রাহক ^[43] রয়েছে কিছু চ্যানেলের।

ব্যতিক্রমী বিষয়বস্তু

উপরোক্ত বিষয়গুলোর বাইরে ইউটিউবে প্রযুক্তি ^[44] সংক্রান্ত পর্যালোচনা ^[45], শিক্ষা ^[46] এবং ধর্মীয় বিষয়বস্তু সহ আরও বিভিন্ন বিষয়ের চাহিদা রয়েছে দেশী শ্রোতাদের কাছে।

উদাহরণস্বরূপ, রাজশাহী ক্যাথলিক ডায়োসিসের একটি ইউটিউব চ্যানেল ^[47] রয়েছে, যা প্রতিনিয়ত বিশপের বানী, রবিবারের প্রার্থনা এবং বিষয়বস্তু ভাগ করে নিতে ব্যবহার করে। ডায়োসেসিয়ান কমিশনের সেক্রেটারি ফাদার প্যাট্রিক গোমেজের মতে ^[48], এই চ্যানেলের উদ্দেশ্য হল “যেসব বিশ্বস্ত রবিবারের প্রার্থনায় অংশ নিতে পারে না, তাদের আত্মাকে পুষ্ট করে তোলা”, যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সপ্তাহান্তের ছুটির দিনটি রবিবার নয়, শুক্রবার।

“ফারজানা অঙ্কন একাডেমি ^[49]” একটি বাংলাদেশি মেয়ের ব্যক্তিগত চ্যানেল যাতে সে শুধু তার পেন্সিলে আঁকার ভিডিও আপলোড করে। আশ্চর্যের বিষয় যে বিশ্বব্যাপী তার প্রায় চল্লিশ লক্ষ গ্রাহক রয়েছে এবং গত চার বছরে তার ভিডিওগুলি প্রায় ৪৬ কোটি বার দেখা হয়েছে।

পঁচিশ লাখ গ্রাহক রয়েছে “অ্যারাউন্ড মি বিডি ^[50]” নামের একটি অসাধারণ ইউটিউব চ্যানেল এর। কুষ্টিয়ার খোকসা থানার শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা লিটন আলী খান শখের বশে তার গ্রামের মাছের বাজার এবং বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের পরামর্শ নিয়ে ভিডিও আপলোড করা শুরু করেছিলেন পাঁচ বছর আগে। তার চ্যানেল ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পরে, তিনি ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত উপার্জন ব্যবহার করে প্রতি সপ্তাহে তার গ্রামের ৫০০ থেকে ১০০০ লোককে খাওয়ানো শুরু করেন এবং পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে ভিডিও আপলোড শুরু করেন। খ্যাতনামা আমেরিকান ফুড ব্লগার সনি এই কার্যক্রমটি সরেজমিনে দর্শন করে একটি ভিডিও প্রচার করার পরে ^[51] শিমুলিয়া প্রথম ইউটিউব ভিলেজ ^[52] হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে – গ্রামের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে ভিডিওগুলি ইউটিউবে আপলোড করা হয় এবং গ্রামের বাসিন্দারা সম্মিলিতভাবে লাভের ভাগীদার হন।

ইউটিউব ছাড়িয়ে ভিডিও

বাংলাদেশে অনলাইনে বিনোদন দেখার বিষয়টি ইউটিউবে সীমাবদ্ধ নয়। বঙ্গবিডি-র ^[53] মতো প্ল্যাটফর্মগুলিও ইউটিউবের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম শুরু করলেও এখন মৌলিক বাংলা ভিডিও তৈরি করা, বিষয়বস্তু কিনে নেওয়া এবং অনলাইনে স্ট্রিম করছে। “বাংলাদেশের নেটফ্লিক্স ^[54]” হিসাবে চিহ্নিত, বঙ্গবিডির সাবস্ক্রিপশন-ভিত্তিক অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আছে এবং একটি নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে ফোনে ভিডিও দেখার জন্যে।

র‍্যাবিটহোলবিডি ^[55] অনুরূপ একটি মালটিপ্ল্যাটফর্ম বিনোদন উদ্যোগ, যার জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলও ^[56] রয়েছে।

করোনাভাইরাসের সময়ে ভিডিও

করোনাভাইরাস মহামারির আলোকে, বঙ্গবিডি'র ইউটিউব চ্যানেল ^[57] সুরক্ষা ও সতর্কতা সম্পর্কে স্থানীয় ভাষায় তথ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি শিক্ষামূলক ভিডিও আপলোড করছে:

লকডাউন শুরু হওয়ার পরে দেশবাসীর ঘরে বসে বিনোদন দেওয়া এবং বাইরে যাওয়া বিমুখ করার প্রচেষ্টায়, “বঙ্গবিডি” তার বাণিজ্যিক ভিডিও স্ট্রিমিং সেবার পুরো বিনোদন লাইব্রেরিটি ^[58] বাংলাদেশের সকল ব্যবহারকারীর জন্য বিনামূল্যে করে দিয়েছে ^[58]।

ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির, যিনি ওজন হ্রাস এবং জীবনযাত্রার পরিমার্জনের জন্য একটি নিখরচায় ইউটিউব পরামর্শ চ্যানেল পরিচালনা করে থাকেন, লকডাউনের সময় শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য যোগব্যায়াম এবং অনুশীলনের বিষয়ে পরামর্শগুলি ভাগ করছেন ^[59]।

২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী ^[60] গতবছর দেশে ইউটিউব ভিডিওর দর্শক ৬১ শতাংশ বেড়েছিল। বর্তমান প্রবণতা অনুযায়ী আশা করা যায় যে এর সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকবে এবং স্থানীয় ভাষার ভিডিও নির্মাতাদের কাছে এটি একটি আকর্ষণীয় বাজার হিসাবে পরিগণিত হবে।