- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

করোনা ভাইরাস ও নজরদারি প্রযুক্তি: সরকারগুলো কতদূর যেতে পারবে?

বিষয়বস্তু: পূর্ব এশিয়া, ইজরায়েল, ইরান, চীন, সিঙ্গাপুর, হং কং (চীন), নাগরিক মাধ্যম, প্রযুক্তি, মানবাধিকার, স্বাস্থ্য, জিভি এডভোকেসী
[1]

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি যাত্রীর হাতে ইলেকট্রনিক অনুসরণকারী হস্তবন্ধনী। ফাইল ছবি: র‍্যাচেল ওয়াং/ এইচকেএফপি।

কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখনী, অলঙ্কারশাস্ত্র ও ডিজিটাল বিদ্যার সহকারী অধ্যাপক শুই-ইন শ্যারন ইয়ামের লেখা নিচের পোস্টটি প্রথমে ২০২০ সালের ২৪ শে মার্চ তারিখে হংকং ফ্রি প্রেসে প্রকাশিত হয়েছিল এবং একটি বিষয়বস্তু অংশীদারিত্ব চুক্তির আওতায় সেটা এখানে গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক প্রভাব [2] নিয়ে গ্লোবাল ভয়েসেসের বিশেষ কভারেজটি দেখুন।

কোভিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মহামারী আকার ধারণ করার পর থেকে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো ভাইরাসটির বিস্তার ধীরগতির করার প্রচেষ্টায় নতুন নতুন নীতিমালা প্রয়োগ করেছে।

অ-নাগরিকদের জন্যে সীমান্ত বন্ধ করার পাশাপাশি অনেক সরকার ভ্রমণকারী ও নাগরিক উভয়কে একইভাবে অনুসরণ এবং ধারণ করার জন্যে ডিজিটাল নজরদারি প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছে।

বুধবার হংকং সরকার ঘোষণা করেছে যে শহরের সমস্ত নতুন আগন্তুককে তাদের  ফোনের অবস্থান সনাক্তকারী অ্যাপ্লিকেশনটির সাথে সংযুক্ত একটি ইলেকট্রনিক হস্তবন্ধনী [3] পরিধান করে অবশ্যই দুই সপ্তাহ আত্ম-সঙ্গরোধ (সেলফ কোয়ারেন্টাইন) করতে হবে।

অ্যাপ্লিকেশনটিতে ব্যক্তির অবস্থানের পরিবর্তন সনাক্ত হলে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পুলিশকে সতর্ক করবে। এই নতুন নীতিটির আগে শুধুমাত্র সাম্প্রতিককালে চীনের হুবেই প্রদেশে ভ্রমণকারীদের সঙ্গরোধের সময়কালে এই পর্যবেক্ষণকারী হস্তবন্ধনীটি পরিধান করতে হতো।

নজরদারি প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাগুলো ভাইরাসটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সুরক্ষার বোধ দিলেও মহামারীটি কমে যাওয়ার পরে তাদের অব্যাহত ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে এবং খেয়াল রাখতে হবে।

ইতালি, স্পেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলি বর্তমানে মারাত্মকভাবে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত। এদিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে এশিয়ার দেশগুলির দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহার প্রশংসিত হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ সিঙ্গাপুর সরকার এমন নীতিমালা কার্যকর করেছে যা কার্যকর ও কঠোরভাবে যোগাযোগের একটি জটিল শৃঙ্খলাকে অনুসরণ করতে পারে [4]। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের যে কোন সরকারি বা কর্পোরেট ভবনে প্রবেশকারী প্রত্যেককে তাদের যোগাযোগের তথ্য সরবরাহ করতে হয়েছে।

এর ওপর সরকার সংক্রমণের প্রতিটি পরিচিত ঘটনা ছাড়াও ঐ ব্যক্তি যেখানে বসবাস ও কাজ করে এবং তার সাথে সংযুক্ত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে আসছে।

এখন পর্যন্ত এই পদক্ষেপগুলির ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেলেও সেগুলো প্রত্যেকটি ব্যক্তির গতিবিধি এবং জীবন পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও ক্ষমতা তুলে ধরেছে মাত্র।

প্রথমবারের মতো কোভিড -১৯ সনাক্ত হওয়া চীনে আত্ম-সঙ্গরোধ ও বিচ্ছিন্নতার সাথে জনসাধারণের সঙ্গতি নিশ্চিত করতে সরকার কঠোর লকডাউন নীতি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের নজরদারি প্রযুক্তিও জারি করে আসছে।

জনগণের গতিবিধির উপর নজর রাখা ও  তাদের ঘরে বসে থাকা নিশ্চিত করার জন্যে পাঁচটি চীনা শহরে পুলিশ ড্রোন ব্যবহার [5] করার পাশাপাশি থার্মাল স্ক্রিনিং প্রযুক্তিতে সজ্জিত স্মার্ট হেলমেট পরে রাস্তায় টহল দিচ্ছে যা কোন ব্যক্তির দৈহিক তাপমাত্রা প্রান্তসীমার চেয়ে বেশি হলে সতর্কতা সংকেত বাজায়।

সরকার হানওয়াং প্রযুক্তি লিমিটেড কোম্পানির সহযোগিতায় [6] তাদের বিদ্যমান মুখ চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তিটির আরো সূক্ষ্মতা বৃদ্ধি করেছে যাতে ব্যক্তি মুখোশ পরে থাকলেও এটা কাজ করতে পারে।

কোন তাপমাত্রা সংবেদক এবং চীনা সরকারের বিদ্যমান ডাটাবেজের পাশাপাশি প্রদেশগুলোর গোয়েন্দা তথ্যের সাথে সংযুক্ত হলে এই প্রযুক্তি কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক দেহের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকা প্রত্যেকটি ব্যক্তির নাম সনাক্ত করে দেয়।

হানওয়াং প্রযুক্তির তথ্য অনুসারে, পরিমার্জিত মুখ সনক্তকারী এই প্রযুক্তিটি “এক সেকেন্ডের মধ্যে” ৩০ জন পর্যন্ত লোককে সনাক্ত করতে পারে।

এই জাতীয় নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহার চীনে নিশ্চিত ঘটনার সংখ্যা হ্রাস করার ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও এটি ঝুঁকিবিহীন নয়।

মহামারীটির কথা বাদ দিলেও চীনা সরকার এবং সংস্থা উভয়েরই এই প্রযুক্তিটি আরও বিকাশ ও প্রয়োগের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে: সরকার রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর নজর রাখতে ও দমন করতে এবং সংস্থাটি আর্থিকভাবে আরো লাভবান হতে এর ব্যবহার করতে পারে।

বর্তমানে গণ-বন্দি শিবিরে অবস্থানে এবং জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য হওয়া উইঘুর জনগণের আন্দোলনকে আরো পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্যে চীনের সন্ত্রাসবাদবিরোধী বাহিনীগুলোও এই প্রযুক্তিটি বেছে নিতে পারে।

এশিয়ার বাইরে, ইসরায়েল এবং ইরানের মতো মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিও করোনা ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে একইধরনের নজরদারি প্রযুক্তি স্থাপন করে আসছে [7]

ইসরায়েলি সরকার এখন জনগণের যোগাযোগের নেটওয়ার্ক সনাক্ত করার মাধ্যমে যাদের আলাদা করা দরকার তাদের সনাক্ত করতে মুঠোফোনের ডেটা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার জন্যে তৈরি করা প্রযুক্তির ব্যবহার করছে।

তখন জনগণের মুঠোফোনের মাধ্যমে জড়ো করা ভূ-অবস্থান নির্ধারণী ডেটা ব্যবহার করে সংক্রমণের ধরনের ভিত্তিতে জনসাধারণকে সেখানে না যাওয়ার জন্যে সতর্ক করা হবে।

ইসরায়েলের জন্যে জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায় সন্ত্রাসবাদবিরোধী ডেটা ব্যবহার করা শুধু নজিরবিহীন নয়, নিউইয়র্ক টাইমসের [7] মতে এই তথ্য ভাণ্ডারের অস্তিত্বও এর আগে জানা যায়নি।

৬ মার্চ তারিখে গবেষক নরিমান গারিব প্রকাশ করেছেন যে [8] করোনা ভাইরাস ডায়াগনস্টিক সরঞ্জামের ছদ্মবেশযুক্ত একটি অ্যাপের মাধ্যমে ইরান সরকার নাগরিকদের ফোনের ডেটা অনুসরণ করছে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নিকোলোস ক্রাইসেইদোস নিশ্চিত করেছেন যে অ্যাপটি সংক্রমণের সাথে সম্পর্কিত নয় – উদাহরণস্বরূপ, ফিটনেস ট্র্যাকার যেভাবে ব্যবহারকারীর শারীরিক গতিবিধি রেকর্ড করে – এমন সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে।

গুগল গুগল প্লে থেকে অ্যাপটি সরিয়ে নিলেও এই ক্ষেত্রটি জনস্বাস্থ্যের নামে সরকারের নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণের ধারাবাহিক সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

ঐতিহাসিকভাবেই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মূলধারার প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো্র অভিবাসী, জাতিগত সংখ্যালঘু, এলজিবিটিকিউ জনগণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মতো প্রান্তিক মানুষের জীবনকে কলঙ্কিত, পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করার যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আমরা বর্তমান মহামারী ছাড়াও এর বাইরে নজরদারি প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহারের জন্যে আমাদের সরকারকে জবাবদিহিতায় আনতে না পারলে ইতোমধ্যে প্রান্তিকতায় পর্যবসিতদের আরো নিয়ন্ত্রণ, দমন ও নিপীড়নের ঝুঁকিতে ফেলে দেবো।