- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

চীনা নাগরিকরা তাদের শহর অবরুদ্ধ করা নিয়ে বিক্ষুব্ধ ‘বেইজিং উহান কে ত্যাগ করেছে!’

বিষয়বস্তু: পূর্ব এশিয়া, চীন, তাজা খবর, দুর্যোগ, নাগরিক মাধ্যম, সরকার, সেন্সরশিপ, স্বাস্থ্য
[1]

টুইটারে দেয়া ছবি যেখানে একজন মহিলা ‘চীনের কেন্দ্রীয় সরকার কি উহানকে ত্যাগ করেছে?’ লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সম্মতি নিয়ে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে।

গত ২৩শে জানুয়ারী, ২০২০ থেকে মধ্য চীনে অবস্থিত হুবেই প্রদেশের উহান শহরকে অবরুদ্ধ করে [2] রাখা হয়েছে করোনা ভাইরাস (২০১৯-এনসিওভি) ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য। ধারনা করা হচ্ছে যে নতুন এই ভাইরাস উহানের একটা সামুদ্রিক মৎস্য বাজারে [3] গত ডিসেম্বরে প্রথম ছড়ায়। এখন শহরটির ১ কোটির বেশী বাসিন্দা আতঙ্কের মধ্যে আছেন, কারণ এখানে যথাযথ চিকিৎসা আর তথ্যের অভাব রয়েছে।

চীনা কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর ৮, ২০১৯ থেকে জানুয়ারী ২৬, ২০২০ পর্যন্ত ২০৩৪ জন আক্রান্ত এবং ৫৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে [4] কেবল মূল চীন ভূখণ্ডে – যা পরবর্তীতে আরও অনেক বেড়েছে।

বেশিরভাগ আক্রান্তরা হয় উহান এর বাসিন্দা বা জানুয়ারি মাসে সেখানে গিয়েছিল। তবে, সরকারী সংখ্যা হয়ত পুরো বাস্তবতা দেখাচ্ছে না কারণ অনেক আক্রান্তের মধ্যে রোগের লক্ষন খুব গুরুতর না [5] আর হাসপাতালের পক্ষে সম্ভব না [6] সামর্থ্যের বাইরে বিপুল পরিমাণে আক্রান্ত বা সম্ভাব্য আক্রান্ত লোককে চিকিৎসা দেয়া।

মহামারী ছড়ানো মডেল ব্যবহার করে আক্রান্তের আসল সংখ্যা জানার বেশ কয়েকটা চেষ্টা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক একটা মেডিকেল দল ধারনা করছে [7] এই হারে বাড়তে থাকলে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ২০২০ এর মধ্যে এই সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৮৯১ হাজার এর কাছাকাছি যেতে পারে।

বর্তমানে ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাস তিব্বত ছাড়া চীনের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে [8], যার মূল কারণ জানুয়ারীর প্রথম দিকে উহান থেকে অনেক কর্মী আর ছাত্ররা তাদের বাড়িতে গিয়েছে পরিবারের সাথে জানুযারীর ২৫ তারিখের নতুন চন্দ্র বৎসর [9] উদযাপন করতে।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২৩শে জানুয়ারী সিদ্ধান্ত নেন শহরটাকে কোয়ারেন্টাইন করতে- সেদিন থেকে বিমানবন্দর, গণপরিবহন এবং ট্রেন স্টেশন সব বন্ধ করে দেয়া হয়। পরের দিন হুবেই প্রদেশের অন্য ১১টি শহরও কোয়ারেন্টাইন এর আওতায় আনা হয় [10]

‘জানুয়ারী ৫ থেকে জানুয়ারী ১৫ এর মধ্যে শূণ্য সংক্রমণ’ ঘোষণাঃ

উহানের বাসিন্দারা ঘোরের মধ্যে আছেন, যেহেতু মাত্র কয়েকদিন আগে কর্তৃপক্ষ তাদের বলেছিল যে ভাইরাসটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে [11] যতক্ষণ না মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমন ছড়ায়।

উহানে থাকা সাংবাদিক চু চাওক্সিন ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর থেকে একটা টাইম লাইন তৈরী করেছেন [12] যেখানে মহামারি সম্পর্কে সাবধানের বার্তা ছড়ানোর সময় থেকে, এবং বিশেষ করে ৫ই জানুয়ারী থেকে ১৫ই জানুয়ারী সময়কাল পর্যন্ত যখন উহান কর্তৃপক্ষ নতুন কোন সংক্রমণের কথা স্বীকার করেননি। নিশ্চিত সংক্রমণের সংখ্যা ৫ থেকে ১৫ই জানুয়ারী পর্যন্ত মাত্র ৫৯ এ রয়ে যায় – ফলে ভয়াবহতা বোঝা যায়নি। এই সময়ের পরপরই লিয়াঙ্ঘুই [13] নামে হুবেই প্রদেশের দুটি বাৎসরিক সরকারী সভা করা হয়ঃ

武汉市的两会期间无新增病例,死的一例公布时间恰好是武汉两会闭幕之后。湖北省的两会期间,也无新增病例,无死亡病例,只有治愈出院的。省里的两会闭幕当日,新增17例,但消息是18日公布的

উহানের দুইটা সভার সময়ে নতুন কোন সংক্রমনের কথা জানা যায়নি। প্রথম মৃত্যুর সংবাদ জানা গিয়েছে এই সভা শেষ হওয়ার পরে। কোন নতুন মৃত্যুর সংবাদ হুবেই এর দুই সভার সময়ে জানা যায়নি। সেখানে কেবলমাত্র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার সংখ্যা জানানো হয়েছে। এই দুই প্রাদেশিক সভা ১৮ই জানুয়ারী শেষ হলে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায় যে ১৭টা নতুন নিশ্চিত কেস আছে।

আরো বেশী চিন্তার বিষয় হল যে কর্মকর্তারা বৎসর শেষের উদযাপনও বাদ দেয়নি। ১৮ই জানুয়ারী উহানে বসবাসকারী একটা গোষ্ঠী বৎসর শেষের ভোজের আযোজন করে ৪০,০০০ পরিবারের জন্য (প্রায় ১৩০,০০০ লোক)। ২১শে জানুয়ারী উহানের হোংশান হলে আয়োজিত হয় [14] হুবাই এর বৎসর শেষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেখানে প্রদেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশগ্রহন করেন।

পরিত্যাক্ত মনে হচ্ছে

২৩শে জানুয়ারীর মধ্যে ৮৮৬ জনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে যাবার খবর নিশ্চিত করা হয় যার মধ্যে চীনের বিভিন্ন স্থানে ২৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, আর বেইজিং হঠাৎ করে উহান বন্ধ ঘোষনা করে। শহরের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে খাবার ও নিত্য প্রযোজনীয় জিনিসপত্র, ঔষধ আর মাস্কের জন্য দৌড়াতে থাকে- আর কেউ কেউ কোয়ারেন্টাইন থেকে পালানোর চেষ্টা করে। অনেকেই হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন, যেমন উহান বন্ধ হওয়ার আগে বেরিয়ে আসা এই নাগরিক লিখেছেনঃ

我不知道政府是昏庸无能还是准备放弃这个省,我宁愿是前者。

因政府失职造成的封城及交通封锁,最起码政府得提供免费口罩,社区消毒,大折扣的食物补给,及医护人员上下班免费班车,病患免费就医通道……且应该在封城前就布属好。这些是一个政府承认过失的基本诚意。然而,什么都没有,只有冰冷的公文…

আমি জানিনা যে সরকার কি আসলেই পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না, নাকি তারা প্রস্তুতি নিয়েছে পুরো প্রদেশকে পরিত্যাগ করতে। সবকিছু বন্ধ হওয়ার দায় সরকারকে নিতে হবে আর তাদের উচিত অন্তত বিনামূল্যে মাস্ক দেয়া, খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকা জীবাণুমুক্ত করা স্বাস্থ্য কর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা আর যারা অসুস্থ তাদের হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। এই সবকিছুর ব্যবস্থা ঘোষনার আগে করা উচিত ছিল। জবাবদিহিতা বিহীন একটা সরকারের ন্যূন্যতম ব্যবস্থা এটা। কিন্তু শুধুমাত্র একটা ঘোষনা ছাড়া কিছু হয়নি।

এর ফলে সকল হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের সাথে মিলে যেতে পারে এরকম লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীতে ভরে গেছে। বেশীরভাগ মানুষকে বাসায় নিজেকে পৃথক হয়ে থাকতে বলা হয়েছে, যেহেতু হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী আর সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা নেই আরো রোগী নেয়ার মতো।

সামাজিক মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি হতে চাওয়া লোকদের সাহায্য করার কথা ঘুরছে। অনেক হাসপাতালে তার স্বাস্থ্য কর্মীদের রক্ষা করার মতো সুরক্ষা পরিধান নেই। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেরাই অসহায় হয়ে পড়েছে। হুয়ানের হাসপাতালের একজন স্বাস্থ্য কর্মীর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার ভিডিও গত কয়েকদিন ধরে ভাইরাল হয়ে গেছেঃ

আমি এই ভিডিও শেয়ার করছি যাতে সবাই বুঝতে পারে যে হুয়ানের স্বাস্থ্যকর্মীরা কেমন বোধ করছেন আর তাদের কাজের প্রতি সবাই একটু সম্মান দেখাবে। উইচ্যাটে এতো বার্তা ছড়িয়ে আছে যেজন্য আমি নিজেকে সংবরণ করেছিলাম এটা দেয়া থেকে। কিন্তু আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে আমরা যদি অক্ষম একটা সরকারের দ্বারা সৃষ্ট সকল সমস্যা অগ্রাহ্য করি, তাহলে একদিন আমরা সবাই এই ভাইরাসের শিকার হব।

জেনিফার যেং নামে একজন স্বাধীন সাংবাদিক উহানের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর খবর জানাচ্ছেনঃ

দক্ষিণ দিকের এক ভূতপূর্ব সাংবাদিকঃ যদিও আমি সার্স মহামারি নিয়ে ১৭ বছর আগে রিপোর্ট করেছি আর ১৬ বছর আগে এভিয়ান ফ্লু এর বিস্তার সিচুয়ান থেকে গুয়াংজি হয়ে ভিয়েতনাম পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে দেখেছি, হুয়ানের পরিস্থিতি দেখে আমি আতঙ্কিত। ২৪শে জানুয়ারীতে এসে হুয়ানের অনেক হাসপাতাল স্বাস্থ্যকর্মী আর জিনিসপত্রের অভাব বোধ করেছে। মৃতদেহের সৎকারের কেউ কোন ব্যবস্থা করেনি। মহামারির ব্যাপ্তি, চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব আর বিক্ষিপ্ত সাড়া – এ সবকিছু আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

আতঙ্কের একটা মূল কারণ হল সেই সমস্ত নাগরিক আর নেট ব্যবহারকারীরা যারা সরকারের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন বা নিজ থেকে সামাজিক মিডিয়া প্লাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই নিয়ে কথা বলার জন্যে। তারা যেসকল ইন্টারনেটে সাহায্য চাচ্ছেন তাদের উপরে দোষারোপ করছেন বা নিজেদের বিরক্তি প্রকাশ করছেন গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে । অনেকে ভাবছিলেন যে হয়ত কর্তৃপক্ষ উহানে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেবে অন্য সবকিছু বন্ধ করার মতো, যেমন চিন্তা করেছেন এই ব্যক্তিঃ

সাহায্য চেয়ে আবেদন! যদি উহানের ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়, কেমন করে আমরা বাকি পৃথিবীর কাছে পৌঁছাব? দয়া করে আমাকে কিছু পরামর্শ দেন। দয়া করে দেন!

নতুন চন্দ্র বৎসরের প্রথম দিন, ২৫শে জানুয়ারী চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিংপিং শেষ পর্যন্ত নতুন করোনা ভাইরাস নিয়ে তার নিরবতা ভেঙ্গে স্বীকার করেন [19] যে নতুন ভাইরাস দ্রুত ছড়াচ্ছে আর দেশটা কঠিন সময়ের মুখোমুখি।

একই দিনে, বেইজিং থেকে ৪৫০ জন সেনা মেডিকেল কর্মীকে উহান প্রদেশে পাঠানো হয় [20] চিকিৎসা কাজে সাহায্যের জন্য। ২৬শে জানুয়ারী থেকে কর্তৃপক্ষ শহরে সকল ব্যক্তিগত গাড়ী চলাচল বন্ধ করে দেয় আর ১০ দিনের মধ্যে উহানে নতুন ২টা হাসপাতাল [21] তৈরীর করার কাজ শুরু করে যাতে অতিরিক্ত ২৩০০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেয়া যায়।

তারপরেও, ভাইরাস যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, অনেকে সাবধান করছে যে কম উন্নত দ্বিতীয় সারির শহর, বিশেষ করে হুবেই অঞ্চলে, একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে পারেঃ

উহানের ঠিক বাইরের শহরগুলোর দিকে অনুগ্রহ করে দৃষ্টি রাখেন। হুবেই অঞ্চলের অবস্থা খুব একটা আশাব্যঞ্জক না। এখন পুরো পৃথিবীর চোখ হুয়ানের দিকে, কিন্তু অন্য শহরের কথা ভুলে যাবেন না, দয়া করে ওদেরও বাঁচান…

গ্লোবাল ভয়েসেস এর বিশেষ কাভারেজ উহান করনা ভাইরাসের প্রভাব [24] নিয়মিত পড়ুন আরও তথ্যের জন্যে।