- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

‘বাইরের পৃথিবী জানেই না যে নেপালি সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ’ – লেখক ড. সঙ্গিতা সেচ্ছার সাক্ষাৎকার

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, নেপাল, নাগরিক মাধ্যম, ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতি, সাহিত্য
[1]

গত আগস্ট ৩-৫, ২০১৯ এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নেপালি সাহিত্য সম্মেলন ‘গুলাফসাঙ্গাকো প্রেম'। ছবি ড. সঙ্গিতা সেচ্ছা।

যুক্তরাজ্যে প্রবাসী ড. সঙ্গিতা সেচ্ছা [2] হচ্ছেন একজন নেপালি সাহিত্য ব্যক্তিত্ব যার কবিতা, গল্প ও কলাম নেপাল এবং যুক্তরাজ্য দুদেশেই প্রকাশিত হয়েছে। তার কিছু কবিতা নেপালি রেডিও এবং টেলিভিশনেও সম্প্রচারিত হয়েছে। এছাড়াও তার দুটো যৌথ গল্প সংকলন, ‘আসাহামাতি কা পাইলাহারু’ এবং ‘গুলাফসাঙ্গাকো প্রেম’ প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘পাখালিয়েকো সিউন্দো’ [3] লিখেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে এবং সে সময়ই তা সাহিত্য বোদ্ধাদের নজর কাড়ে। উপন্যাসটিতে সন্ধ্যা নামের একজন নেপালি নারীর জীবন সংগ্রাম, দুঃখ কষ্ট এবং কিভাবে সে তার অতীতের অপচ্ছায়া থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসে সেই গল্প বলা হয়। নেপালের মানব পাচার বিষয়টিই এই উপন্যাসের মুল উপজীব্য বিষয় ছিল। গ্লোবাল ভয়েসেস তার সাথে তার কাজ এবং তার সাহিত্য প্রেরণা নিয়ে আলোচনা করে।

গ্লোবাল ভয়েসেসঃ ঠিক কবে থেকে আপনি লেখালেখি শুরু করেন?

ড. সঙ্গিতা সেচ্ছাঃ সঠিক সাল আমার মনে নেই, তবে ১২ বা ১৩ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করি। আমার ঠিক মনে নেই সে সময় আমি কবিতা লিখতাম নাকি অন্য কিছু তবে আমার যা মনে হত তাই লিখতাম। আমি ছোটবেলা থেকেই বেশ লাজুক ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলাম, কথা বলার থেকে আমি বেশিরভাগ সময় চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শুনতাম। আমার মনের ভাব আমি কথা বলার চেয়ে লিখে প্রকাশ করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবিতার মাধ্যমে।

জিভিঃ নেপালি ভাষায় লেখালেখি করতে কে আপনাকে উৎসাহিত করেছে?

এসএসঃ নেপালি ভাষা হচ্ছে নেপালের জাতীয় ভাষা, তাই একজন নেপালি হিসেবে ইংরেজির চেয়ে আমি আমার ভাষাতে লেখালেখি করতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যদিও আমার মনে নেই আমি কবে থেকে লেখালেখি করছি তবে আমার মা বাবা সব সময়েই আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। প্রথম প্রথম আমি আমার মা বাবাকে কিছুই বলিনি। বেশ কয়েক বছর পর আমি তাদের বলি যে আমি লিখতে ভালবাসি এবং বেশ কয়েক বছর থেকেই আমি লিখে আসছি। প্রথম দিকে আমি আমার লেখা লুকিয়ে রাখতাম বা ছিড়ে ফেলতাম। আমার মনে হয় আমার বাড়ির চারপাশের নৈসর্গিক পরিবেশই আমাকে উৎসাহ দিত। আমি আজো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।

জিভিঃ আপনার উপন্যাস ‘পাখালিয়েকো সিউন্দো’ সম্পর্কে কিছু বলেন।

এসএসঃ ‘পাখালিয়েকো সিউন্দো’ মূলত নারীর ভোগান্তি, কষ্ট সহনশীলতা এবং কিভাবে পরিস্থিতি নারীকে শক্ত হতে শেখায় সেই কথা বলা হয়েছে। এই গল্পে এটাও বলা হয়েছে যে কিভাবে নারী তার প্রেমিক বা আত্মীয়ের মাধ্যমে পন্য হিসেবে বিক্রি হয়। এই গল্পে একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারীর কথা বলা হয়েছে, যে কিনা জীবনের সকল বাঁধা বিপত্তির মধ্যেও লড়ে যায় এবং শক্ত হাতে নিজের জীবনের স্বপ্নগুলো পুরন করে।

[4]

ড. সঙ্গিতা সেচ্ছা

উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হয় তখন আমার বয়স ১৮, নেপালে সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সদ্য আই.এসসি (দ্বাদশ শ্রেণীর সমমান) পাশ করেছি। পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, হাতে তেমন কোন কাজ না থাকায় ভাবলাম কিছু গল্প লেখা যাক। একটা গল্প শুরু করলাম আর ওটাতে এত বেশী জড়িয়ে গেলাম যে লেখা আর যেন থামছিলই না। পরে দেখলাম যে গল্পটা ২৬৫ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি ভেবে এখনও অবাক হই যে ওই বয়সে আমি কিভাবে এত বড় একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। লেখা শেষ হবার পর আমার বাবা আমাকে উৎসাহ দেন প্রকাশ করার জন্য। শুরুর দিকে আমার বাবা মায়ের সমর্থন আমার লেখক হয়ে উঠার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম যে উপন্যাসটি প্রকাশ হবার পর নেপালি পাঠক, সমালোচক ও নেপালি মিডিয়ার প্রশংসা পেয়েছিলাম। পরের কয়েক বছর আমি আরো বেশী লেখালেখি এবং বিভিন্ন সাহিত্য বিষয়ক কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলাম। এর মধ্যে ছিল ‘আকাশ’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা। আমি তখন এই পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করতাম। এছাড়াও আমি বিভিন্ন জাতীয় ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রেও লেখালেখি শুরু করলাম। তারপর আমি কলাম ও রিপোর্ট লেখার আহ্বানও পেতে শুরু করি। আমার উপন্যাস এখন প্রতি সপ্তাহে নেপাল রেডিও এফএম ৯৬.৪ এ প্রচারিত হচ্ছে। তাছাড়া অনলাইন রেডিও ও ইউটিউবের মাধ্যমে এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরছে জেনেও আমি খুশি। এই উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ চলছে এবং আমি আশা করছি খুব শীঘ্রই এর একটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হবে।

জিভিঃ একবিংশ শতকে নেপালি সাহিত্য নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

এসএসঃ নেপালি ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীতে। এর আগে নেপালি সাহিত্যের ভাষা ছিল সংস্কৃত। নেপালি ভাষায় প্রথম রচিত সাহিত্য ছিল ভানুভোগতার [5] রামায়ণ। সেদিক থেকে নেপালি সাহিত্যের ইতিহাস একশ বছরেরও বেশী। এই সময়ে বিভিন্ন ধারার সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে এবং একবিংশ শতাব্দীতে তা আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। শুধু সংখ্যায় যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নয় দিনে দিনে সাহিত্যের মানও উন্নত হচ্ছে। তাছাড়া প্রতি বছর নতুন নতুন ধারার সাহিত্য প্রকাশিত হচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে নতুন সব রচনাশৈলী। যেহেতু এই সাহিত্যকর্ম গুলো বেশীর ভাগই নেপালি ভাষায় রচিত হচ্ছে তাই বাইরের জগৎ জানেই না যে নেপালি সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নেপালি সাহিত্য বাইরের পৃথিবী থেকে এখনও বিচ্ছিন্ন। তবে এখন ধীরে ধীরে অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে। শুধু যে ইংরেজীতে সাহিত্য চর্চা করছেন এমন লেখক বাড়ছে তা নয়, অনেক মৌলিক নেপালি সাহিত্যও বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হচ্ছে। আমি মনে করি এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীর মানুষ নেপালি সাহিত্যকে আরো ভালভাবে জানবে এবং নেপালি সাহিত্য ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর সবখানে।

তাছাড়া আজকের উন্নত বিশ্বে নেপালি লেখকেরা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এই সব লেখকদের একটি সাধারণ অবকাঠামোর আওতায় আনার জন্যেই স্থাপিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল নেপালি লিটারেচার সোসাইটি [6] (আইএনএলএস) । ৮০ টিরও বেশী দেশে আইএনএলএস এর কার্যালয় রয়েছে। কিছুদিন আগেই লন্ডনে আইএনএলএস এর সম্মেলন হয়ে গেল, সেখানে ১০০ বেশী নেপালি লেখকেরা উপস্থিত ছিলেন, তাদের এই উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে দেশে এবং দেশের বাইরে যত নেপালি লেখক আছেন তাদের উন্নয়নের জন্য সকলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই সম্মেলনে ইংরেজী ভাষায় ছোট গল্পের একটি সংকলন ‘সিলভার ক্যাসকেড’ উন্মুক্ত করা হয়। নেপালের বুক হিল পাবলিকেশন এই সংকলনটি প্রকাশ করে যেখানে নেপালের গুণী সব লেখকদের গল্প রয়েছে। আমরা আশা করি যে ইংরেজী ভাষায় অনুদিত নেপালের সাহিত্য আন্তর্জাতিক পাঠকদের কাছে আরো সমাদৃত হবে এবং এ ধরণের সাহিত্য আরো প্রকাশিত হবে। বর্তমানে আমার গল্প সংকলন ‘গুলাফসাঙ্কো প্রেম’ ইংরেজী ভাষায় অনুদিত হচ্ছে।

ড. সঙ্গিতা সেচ্ছার [2] সাক্ষাৎকারটি ইমেইলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে।