‘নো ভ্যাট অন প্যাড’ আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশে স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার

এ বছর জুন মাসে নাইজেরিয়ার সরকার ২০১৯/২০২০ অর্থবছরের বাজেটে স্যানিটারি প্যাড এর উপর ট্যাক্স পুনর্বহাল করার সিদ্ধান্ত নেবার পরে দেশে আন্দোলন হয়েছে। গত বছর তুমুল প্রতিবাদের মুখে ভারত সরকার ২০১৭ সালে বলবৎ করা স্যানিটারি প্যাড এর উপর ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনেক দেশে দৃশ্যমান ব্যাপী স্যানিটারি প্যাড এর উপর করের ফলে দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে।

‘নো ভ্যাট অন প্যাড’ আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামাল আমদানির উপর আরোপিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। সম্প্রতি সরকার এ বিষয়ে এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

উল্লেখ্য, নতুন অর্থ বছরের (২০১৯-২০২০) বাজেটে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামাল আমদানিতে ৪০% ভ্যাট আরোপ করে। এর সঙ্গে আগের ১৫% মূল্য সংযোজন করও ছিল।

বাংলাদেশে এমনিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম অনেক বেশি। নতুন করে ভ্যাট আরোপ করায় নারীদের প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম আরো বেড়ে গিয়ে অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেত। তাই ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিবাদ।

পিরিয়ড পরিস্থিতি

বাংলাদেশে এখনো পিরিয়ড একটি ট্যাবু। নারীদের কাছে লজ্জার বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলতে বা প্রকাশ্যে কিনতে তারা স্বচ্ছন্দবোধ করেন না। ফলে এই সময়কার পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে তাদের তেমন একটা ধারনা নেই। তারা পিরিয়ডের সময় ঘরের পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন।

২০১৪ সালের ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন সার্ভে অনুযায়ী, স্কুলগুলোতে পিরিয়ডবান্ধব টয়লেট না থাকায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী পিরিয়ডকালীন স্কুলে যায় না। ছবি ফিরোজ আহমেদের। সর্ব স্বত্ব ডেমোটিক্স (২/১/২০১৪)

দাম যখন প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং আইসিসিডিআরবি পরিচালিত ২০১৪ সালের ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভেতে জানা গেছে, দেশটির ৮৬% নারী পিরিয়ডের সময় পুরোনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন। এর পিছনে একটি বড় কারণ হলো স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্য।

বাংলাদেশের স্যানিটারি ন্যাপকিন (ডায়াপার-সহ) বাজার প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো। এর ৯০% দেশীয় কোম্পানিগুলোর দখলে। ব্র্যান্ড ভেদে প্রতি প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম ১০০-১৬০ টাকা। যা দেশের বেশিরভাগ নারীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

উল্লেখ্য, স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির কাঁচামাল বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। আমদানি করতে হয় বাইরে থেকে। স্থানীয়ভাবে এই পণ্যটি উৎপাদনের জন্যে আমদানিকৃত কাঁচামালের উপর কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি, সাপ্লিমেন্টারী ডিউটি, আর উৎসে আয়কর ইত্যাদি দিতে হয়। আর বিক্রয়যোগ্য পণ্যের উপর ১৫% ভ্যাট তো আছেই।

কাঁচামাল আমদানির উপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলেও কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম আগের মতোই থাকবে বলে জানিয়েছেন এই খাতের সাথে যুক্ত একজন। তার মতে, আমদানি পর্যায়ে আগে সম্পূরক শুল্ক ছিল না। ভ্যাট যা ছিল, তা সরবরাহ পর্যায়ে। সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট তুলে নিলে দামে প্রভাব ফেলতে বলে তিনি মনে করেন।

পুরোনো কাপড় বা ন্যাকড়ার ব্যবহার

অনেক নারী ডিসপোজেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে পুরোনো কাপড় বা ন্যাকড়ার ব্যবহার করার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা জানেন না। ২০১৪ সালের ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভেতে দেখা গেছে যে ক্রয়ক্ষমতার অভাবে আর সামাজিক লজ্জার কারণে নিরুপায় হয়ে নারীরা স্যানিটারি প্যাডের বদলে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করছে।

শামীমা ইসলাম নামের একজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী উল্লেখ করেছেন যে পিরিয়ডকালীন অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ নারী জরায়ু, জরায়ুমুখ ও মূত্রনালির সংক্রমণের শিকার হন, যা থেকে ক্যান্সার হতে পারে।

তাই, অনেক নেটিজেনই পিরিয়ডের সময়ের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব নারীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

স্যানিটারি প্যাড কোনো বিলাসী পণ্য নয়, নারীদের জন্য খুব দরকারি এটি। পিরিয়ডের সময় স্বাস্থ্যসম্মত সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে ক্ষতিকর রোগ হতে পারে। তাই, স্যানিটারি প্যাডের উপর আরোপিত ভ্যাট নারী বিরোধী এবং নারীর প্রতি অপমানজনকও।

শুধু ভ্যাট প্রত্যাহার নয়, শাহরিয়ার শুভ স্যানিটারি প্যাডের উপর ভর্তুকি দাবি করেছেন:

এদেশে এমপি – মন্ত্রীদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ী আনার সুবিধা রাখা হয় আর অতিরিক্ত ৪০% ভ্যাট ধরা হয় নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর ।
শুধু ভ্যাট প্রত্যাহারই নয় স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য করনে এর উপর ভর্তুকির দাবি জানাচ্ছি ।

ঢাকার শাহবাগ অঞ্চলে বেশকিছু ছাত্রছাত্রী এ নিয়ে আন্দোলন ও করেছেনঃ

পিরিয়ড বিষয়ক সচেতনতা তৈরি করতে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন সাকিয়া হক। ভ্যাট আরোপের কথা শুনে তিনি তার ফেইসবুকে লিখেছেন:

সারা দেশে যে বলে আসলাম,মিন্সট্রেশনের সময় স্যানিটারি প্যাড ইউজ করবা,unhygienic কাপড় না।।
এখন কিভাবে মুখ দেখাব?

যাদের মাসে আয় ২০০০-৩০০০টাকা, তাদের কাছে আগেই প্যাড কিনা বিলাসিতা ছিল! আর এখন? […]

পুষ্পিতা মন্ডল নারী বিষয়ক ওয়েবসাইট নারীতে তার এক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন:

আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিলো একবার। মনে হয় ২০০৯ সালের কথা। হলে থাকতাম। আশুলিয়ায় গেলাম ছোটবেলার বান্ধবীর বাসায়। ও আর ওর বর হামিম গার্মেন্টসে জব করতো। আমার পিরিয়ডের ডেইট মনে ছিলো না এবং হঠ্যাৎ পিরিয়ড হয়। কিন্তু ওর কাছে প্যাড নেই, সেপ্যাড ইউজ করে না। আমরা দু'জন ওর বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় গেলাম। ছোটো ছোটো বেশ কয়টা ফার্মেসী পেলাম। কিন্তু কোথাও কোন প্যাড নেই। বলে কেউ কিনে না, তাই রাখি না। আমি এতো অবাক হয়েছিলাম! এতো এতো মেয়ে কাজ করে এখানকার গার্মেন্টসগুলোতে আর কেউ প্যাড ব্যবহার করে না! অথচ আমার গ্রামের ছোট ফার্মেসিতেও অল্প করে হলেও ন্যাপকিনের প্যাকেট থাকে। কিন্তু গার্মেন্টস এরিয়াতে পাইনি। কারণ কী? কারণ একটাই, দাম। কতো আর বেতন পায় যারা গার্মেন্টেসে কাজ করে?

পিরিয়ড নারীর শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ সময়ে স্বাস্থ্যসুবিধা পাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। তাই অনেকেই, স্যানিটারি ন্যাপকিনকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পণ্য বিবেচনা করে সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .