বাংলাদেশে ফেইসবুকে পোস্ট দেয়ার কারনে গ্রেফতার বাড়ছে, নেটনাগরিকেরা আতংকে

Poet Henry Swaopon and Lawyer Imtiaz Mahmood.

কবি হেনরি স্বপন এবং আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ। অনলাইনে শেয়ার হওয়া তাদের ছবি থেকে কোলাজ বানানো হয়েছে।

ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে গত ১৪ এবং ১৫ মে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী দু’জন নাগরিককে গ্রেফতার করেছেন। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেশটির নেটনাগরিকদের মধ্যে ক্রোধ এবং উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

কবি হেনরি স্বপন গ্রেফতার

গত ১৪ মে বরিশালের নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয়েছেন কবি ও সাংবাদিক হেনরি স্বপন। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লংঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে’ আঘাত হানার কারণে হেনরি স্বপনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলায় আরো দু’জনকে আসামী করা হয়েছে। এরা হলেন তার ভাই আলফ্রেড এবং জুয়েল সরকার।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশী কবি ও সম্পাদক হেনরি স্বপনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার ভাষ্যমতে, ফেইসবুকে একটি পোস্ট লিখেছিলেন, যেখানে তিনি বরিশালের ক্যাথলিক ডাইওসিসের বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার সমালোচনা করেছিলেন। কারণ, বিশপ শ্রীলংকায় চার্চ এবং হোটেলে বোমা বিস্ফোরণের পরের দিন ২২ এপ্রিল ২০১৯-এ বরিশাল চার্চে একটি পূর্বনির্ধারিত আনন্দ অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছিলেন। হেনরি স্বপন তার ফেইসবুক পোস্টে শ্রীলংকায় বোমা হামলায় কয়েকশ’ নিহত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশপ আনন্দ আয়োজন স্থগিত করতে পারতেন, সেটা জানিয়েছেন।

হেনরি স্বপন বিশপের প্রতি যে সুরে কথা বলেছেন, সেজন্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অনেক মানুষই ক্রুদ্ধ হয়েছেন। এদের কেউ কেউ তাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন। হেনরি স্বপন বরিশালের নানান অসঙ্গতি, অন্যায়-দুর্নীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখির মাধ্যমে সোচ্চার রয়েছেন অনেক বছর ধরে।

কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান ফেইসবুকে লিখেছেন:

বাংলাদেশে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের ব্যবসাটা একচেটিয়া মুসলমান মৌলবাদীদের ছিল। এখন দেখছি খ্রিষ্টান মৌলবাদীরাও এই ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। আমার তো মনে হয় এই অনুভূতি ব্যবসায়ীরা একেকজন মানসিক রোগী। রাষ্ট্রের উচিত তার অসুস্থ নাগরিকদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কবি হেনরি স্বপনকে গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানাই। তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি চাই।

আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ গ্রেফতার

১৫ মে সকালে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদকে গ্রেফতার করে। ২০১৭ সালে দায়ের করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। সেসময়ে শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার সদর থানায় মামলা করেছিলেন।

ইমতিয়াজ মাহমুদ এতোদিন ওই মামলায় জামিনে ছিলেন। কিন্তু গত জানুয়ারি মাসে খাগড়াছড়ি কোর্ট তার নামে আরেকটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।

২০১৭ সালের জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে বাঙালি মোটরসাইকেল চালক খুনের প্রেক্ষিতে সেখানকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে একদল বাঙালি আদিবাসীদের বাড়িঘর, দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। পার্বত্য অঞ্চলের এই দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে ইমতিয়াজ মাহমুদ ফেইসবুকে মন্তব্য করেছিলেন। ঢাকা ট্রিবিউনের কাছে স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।

আইসিটি আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রূপান্তরিত হওয়ার আগে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ ধরনের অনেকগুলো মামলা হয়েছে

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর বাংলাদেশ কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একদিনেরও কম সময়ের ব্যবধানে আরেকজনকে গ্রেফতার করলো বাংলাদেশের পুলিশ। আইসিটি আইনে দায়ের করা মামলায় বুধবার সকালে লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদ গ্রেফতার হলেন।

অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন ফেইসবুকে লিখেছেন:

তিনি পাহাড় ভালোবাসেন- পাহাড়ের মানুষগুলোকে ভালেবাসেন। ফেসবুকে তাদের নিয়ে লেখেন। তার ফেসবুক লেখায় কখনও ‘জালাও পোড়াও’ তো দেখিনি!

কোথাও কোনো একটা ভুল হচ্ছে..! বেশ বড় একটা ভুল… ভুলগুলোর অবসান হোক।

বি.দ্র: আচ্ছা- ফেসবুকে অশালীন গালাগালি করে যারা পোস্ট করে তাদের নামে মামলা হলেই কি এ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বের হয়!

কবি হেনরি স্বপন আর ইমতিয়াজ মাহমুদকে গ্রেফতারের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই নিন্দা জানিয়েছেন। এই আইন পরিবর্তনেরও দাবি জানিয়েছেন অনেকে।

প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক লিসা গাজী টুইট করেছেন:

খুবই লজ্জাজনক ঘটনা।
বাংলাদেশের সরকার জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। কিন্তু দমনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দ্রুত গ্রেফতার করতে পারে। এই আইন বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী।

সাংবাদিক প্রভাষ আমিন ফেইসবুকে লিখেছেন:

কবি হেনরী স্বপনের পর অ্যাডভোকেট ইমতিয়াজ মাহমুদ। একে একে রুদ্ধ হচ্ছে মুক্তমত। সকল কালাকানুন বাতিল চাই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। কবি হেনরী স্বপন ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদের মুক্তি চাই।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে, এমন আপত্তি সত্ত্বেও গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের সংসদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুমোদন দেয়। অনলাইনে কণ্ঠরোধ করার হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের পরিবর্তে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে।

নতুন এই আইনে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা, ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করে’ এমন মন্তব্যকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে। ইন্টারনেট বা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে জননিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটালে অথবা সরকারের দলিল দস্তাবেজ ‘সংগ্রহ, প্রেরণ, সংরক্ষণ’ করলে দীর্ঘমেয়াদের কারাবাসেরও বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ এই আইন ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, তার পরিপন্থী’ বলে উল্লেখ করেছেন।

তাছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারা যে কারো কার্যকলাপ ক্ষতিকর বা হুমকি মনে হলেই সেটা তদন্ত করতে পারবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .