“আমরা বিয়ে করি ২০১৭ সালের শেষের দিকে। খুব জাঁকজমক ছিলনা বিয়ের অনুষ্ঠান তবে আমাদের ভালবাসা ছিল দৃঢ়,” বলেন সোনা (এটা তার আসল নাম নয়)।
বিয়ের ঠিক এক সপ্তাহ পরেই সোনার স্বামী তাকে প্রথম আক্রমণ করে, সে তাকে সোনার “কালো অতীত” সম্পর্কে বলার জন্য বল প্রয়োগ করে।
“আমি জানিনা কি করে তার মাথায় এই ধারণা জন্ম নিল যে অতীতে আমার কোন প্রেমিক ছিল আর তার সাথে নাকি আমার খুব গভীর সম্পর্ক ছিল, যদিও তার কাছে এর কোন প্রমাণ ছিলনা। সেই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ, কিন্তু এই সন্দেহ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।”
“সে খুবই নির্মমভাবে আমাকে আঘাত করত। সে আমকে মেরে ফেলার হুমকি দিত যদি আমি তাকে না বলি যে কার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, কিন্তু আমার কিছুই বলার ছিলনা।”
সোনা অবশেষে তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়।
“আমি আমার বাবা মায়ের কাছে চলে আসি, কিন্তু আমার স্বামী তখনই সেখানে এসে পরে। সে ক্ষমা চায়, আমাকে ফিরে আসতে বলে, কথা দেয় যে সে আর কখনই মদ স্পর্শ করবে না, কিন্তু আমি ফিরে যাই নি।”
“এর কয়েক সপ্তাহ পরে আমি বুঝতে পারি যে আমি মা হতে চলেছি। আমার জীবন যেন বদলে গেল। আমি তাকে জানালে সে আমাকে ফিরে আসতে বলে, এবং আমি আমার সন্তানকে পিতাহীন রাখতে চাইলাম না।”
ফিরে আসার কিছুদিন পরেই সোনা ও তার স্বামী রাশিয়ায় চলে আসে। আর্মেনিয়ায় সোনার “কালো অতীত” ভুলে যাবার জন্যে তার স্বামী এই সিদ্ধান্ত নেয়।
“আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কোন সেই অতীত সে ভুলতে চায়, তারপরও আমি তার সাথে গেলাম। এখন মনে হয় না গেলেই ভাল করতাম, আর্মেনিয়ায় আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে তার হাত থেকে রক্ষা করত কিন্তু রাশিয়ায় আমি ছিলাম সম্পুর্ন একা। এমন কোন দিন ছিলনা যেদিন সে মদ খেতনা। আমাকে ফুটবলের মত দেয়ালে ছুঁড়ে মারত।”
“একবার সে মেরে আমার হাত ভেঙ্গে দেয়। ওটা প্লাস্টার করা হয়, আমি তখন আট মাসের গর্ভবতী। সে আমাকে সন্তান প্রসবের জন্যে আর্মেনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। প্রসবের পরে আমার হাতে অস্ত্রোপচার করা হয় কিন্তু আমার প্লাস্টারটিতে ত্রুটি ছিল তাই হাতটি আর সম্পুর্ন ঠিক হয়নি।”
প্রসবের পর সোনা আর্মেনিয়ায় থেকে যায় আর তার স্বামী রাশিয়ায়। যদিও তার সন্তানের বয়স দুবছর হয়ে গেল কিন্তু সে এখনও তার স্বামীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
সোনা বলেন,”আমার জীবনের প্রতিটি দিন এখন নিজের নীতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে চলা। আমি আমার অধিকার সম্পর্কে সচেতন কিন্তু আমি সেই অধিকারের জন্যে লড়াই করিনা। আমি নিরব থাকি আর মানিয়ে চলার চেষ্টা করি। আমি চাইনা আমার সন্তান বাবাহীন বড় হোক। সে হয়ত স্বামী হিসেবে খুবই বাজে তবে বাবা হিসেবে সে ভাল।”
‘সহিংসতা বন্ধ হয়নি’
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আর্মেনিয়ায় ঘরোয়া সহিংসতা বন্ধের জন্য একটি আইন করা হয় যেটা ২০১৮ সালের জুলাই নাগাদ কার্যকর হয়।
এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ঘরোয়া সহিংসতা বন্ধ করা ও নির্যাতিতকে রক্ষা করা। এই আইনের আওতায় নির্যাতরে শিকার নারী মানসিক, আইনি, সামাজিক সহযোগিতা পাবে, এছাড়াও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তাও পাবার কথা।
এই আইন কার্যকর হওয়ার পর অনেকেই আশ্বস্ত হল যে এখন হয়ত ঘরোয়া নির্যাতন বন্ধ হবে।
কিন্তু আর্মেনিয়ার উইমেন্স রাইটস সেন্টারের (নারী অধিকার কেন্দ্র) ক্লিনিকাল মনোবৈজ্ঞানিক মারিনা ইয়েঘিয়াযারিয়ান বলেন যে, ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা এতটুকুও কম হয়নি।
“আমরা হাজারো অভিযোগ পাই এখনও। সহিংসতা চলছেই,” ইয়েঘিয়াযারিয়ান বলেন।
তিনি আরো যোগ করেন,”আজো অনেক নারী তার অধিকার সম্পর্কে জানেই না তাই সে তার অধিকার সংরক্ষণও করতে পারেনা। অনেকেই আবার সব জেনেও মানবাধিকার কার্যালয়ে যেতে চায়না, তারা এসব বিষয় নিয়ে কথা না বলে নিরব থাকতেই পছন্দ করে।”
‘আমি আমার সন্তানের জীবন বাচাতে পালিয়ে যাই’
গায়ানে বলেন যে সন্তান জন্মের পর থেকেই তার সংসারে অশান্তি নেমে আসে।
“সব কিছুতেই সে বিরক্ত হতে লাগলো, আমার হাটার শব্দে, বাসন ধোয়ার সময় পানির শব্দে, চুল শুকানোর যন্ত্রের শব্দে। সবচেয়ে রেগে যেত যখন বাচ্চা কেঁদে উঠত। সে সব সময় বলতঃ “ওকে চুপ করাও, আমি বিশ্রাম নিচ্ছি,” গায়ানে বলেন।
সাধারণ একটি পরিবারে নতুন শিশু এলে দম্পতির মধ্যে উষ্ণতা বাড়ে, তারা আরো কাছাকাছি আসে কিন্তু তার পারিবারে সম্পুর্ন উলটো ঘটনা ঘটেছে, তার স্বামী নরম একজন মানুষ থেকে যেন পশুতে পরিণত হয়েছে।
“ওর কি হয়েছে এটা খুবই রহস্যজনক ছিল। যেদিন সে আমাকে প্রথম চড় মারলো আমি আঁতকে উঠেছিলাম, না ব্যাথায় নয় বরং তার আচরণে। সে এর আগে কোন দিন আমার গায়ে হাত তুলেনি।”
“একদিন রাতে যখন বাচ্চা কান্না করছিল, সে তখন আমাকে হুমকি দেয় যে যদি আমি এখনই কান্না না থামাই তাহলে সে আমাদের দুজনকেই মেরে ফেলবে। এর পর থেকে সে শুধু হুমকিই দিতনা, সে আমার বাচ্চাকে আঘাত করতে লাগলো।”
“আমি আমার শরীর দিয়ে বাচ্চাকে আড়াল করে রাখতাম যেন ওর লাথি তাকে না লাগে। এভাবে একমাস চলার পর, একদিন যখন ও কাজে গেল আমি আমার সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যাই।”
সম্পদ ও সরঞ্জামের অভাব
ঘরোয়া সহিংসতার শিকার নারীদের আর্মেনিয়ায় একমাত্র আশ্রয়স্থল হল উইমেন্স সাপোর্ট সেন্টার (নারী সহায়তা কেন্দ্র)। এখানে আশ্রয়ের পাশাপাশি মানসিক ও আইনি সহায়তাও প্রদান করা হয়।
“আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আমরা সর্বমোট সাত জন নারী ও তাদের সন্তানকে আশ্রয় দিতে পারি। যেখানে তাদের রাখা হয় সেটি অবশ্যই গোপনীয়। সেখানে জীবন ধারণের সকল উপকরন রয়েছে, আর তার সাথে জায়গাটি সম্পুর্ন নিরাপদ রাখার সব ব্যবস্থাও নেয়া আছে,” এই সংস্থার ডিরেক্টর হাস্মিক গেভরগিয়ান এই তথ্য জানান।
এই মুহুর্তে সেখানে পাঁচজন নারী বসবাস করছে। আশ্রয় প্রার্থীরা এখানে তিন মাস থাকার সুযোগ পায়, যদিও তাদের অবস্থার উন্নতির উপর বিবেচনা করে সেটা বাড়তে পারে।
হোভানিসিয়ানের মতে, পারিবারিক নিগ্রহের শিকার হওয়া সকল নারীদের সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম নেই।
গায়ানে যখন তার স্বামীকে ছেড়ে গেল তখন তার যাবার কোন জায়গা ছিলনা, তার সব আত্মীয় স্বজন দেশের বাইরে থাকে। সৌভাগ্যবশতঃ কাছের এক বন্ধু পরিবার তাকে থাকার জায়গা দেয়।
তিনি জানান,”পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলে নারী প্রথমে পুলিশের কাছে অভিযোগ করবে, তবে এখানে একটা সমস্যা আছে, যদি সেই নারীর বিকল্প আশ্রয়স্থল প্রয়োজন হয়, তার কোন ব্যবস্থা রাষ্ট্র করেনি, যদিও আইন আছে।”
“আমার বন্ধু এবং তার স্বামী তখন আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল। বেশ কয়েকবার আমার স্বামী আমার বন্ধুর বাসায় জোর করে ঢুকতে চেয়েছিল, আমরা তাকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ক্ষান্ত করি। আমার স্বামীর ভাই তাকে বুঝিয়ে নিয়ে যেত, আর আমাকে অনুরোধ করেছিল যে আমি যেন আমার স্বামীকে ছেড়ে না যাই।”
“কিন্তু আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনি, আমার সব সময় মনে হত যে আমি যদি বাসায় কখনও থাকি তাহলে সে হয়ত আমার সন্তাকে আঘাত করবে।”
“ছয় মাস হয়ে গেল সেই সব দুঃসহ দিনের,” গায়ানে বলছিলেন,”এখন আমি ভাবি, কেন আমি তাকে আরো আগেই ছেড়ে দিইনি।”